সৌদি থেকে নিঃস্ব হয়ে ফিরলেন দুই নারী

সমকাল প্রতিবেদক
প্রকাশ: ২৪ নভেম্বর ২০২১ | ০৮:৩১ | আপডেট: ২৪ নভেম্বর ২০২১ | ০৮:৩৯
স্বামী রিকশা চালিয়ে যে রোজগার করেন, তা দিয়ে ছয় সদস্যের সংসারে নুন আনতে পান্তা ফুরানো অবস্থা। স্ত্রী নাজমা আক্তার অন্যের বাড়িতে কাজ করে সংসারে অর্থের জোগান দেবেন, সেই সুযোগও গ্রামে নেই। সন্তানদের মুখে তিন বেলা আহার তুলে দেওয়া আর সংসারে একটু সচ্ছলতার আশায় নাজমা গৃহকর্মী হিসেবে বিদেশে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন স্বামীর সঙ্গে পরামর্শ করে। স্বপ্ন পূরণে একটি এজেন্টের মাধ্যমে পাড়ি জমান সৌদি আরবে। কিন্তু সেখানে তার স্বপ্ন পূরণ দূরের কথা, উল্টো ভাগ্যে জোটে গৃহকর্তা-গৃহকর্ত্রীর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন। প্রায় সাড়ে ছয় মাস পর খালি হাতে অসুস্থ হয়ে দেশে ফেরেন তিনি।
তার মতো আরও এক নারী সৌদিতে নির্যাতন সয়ে খালি হাতে সম্প্রতি দেশে ফিরেছেন র্যাবের সহায়তায়। তার নাম নাজমা বেগম। এই দুই নারী সৌদি আরবে অমানবিক পরিস্থিতির বর্ণনা দিয়েছেন সমকালের কাছে। দালালের মাধ্যমে সৌদি আরবে গিয়ে তারা ছিলেন দুই গৃহকর্তার বাড়িতে। তাদের অভিন্ন ভাষ্য- গৃহকর্তার বাড়িতে ২৪ ঘণ্টায় এক বেলা খাবার জুটত। পরিশ্রম করতে হতো ১৬ থেকে ১৮ ঘণ্টা। বেতন দেওয়া হতো না।
গৃহকর্তা জানিয়ে দিয়েছিলেন, পাঁচ লাখ টাকায় কিনে নিয়েছেন। খাবার ও বেতনের টাকা চাইলেই নেমে আসত নির্যাতন। নাজমা আক্তারকে দেওয়া হতো বিদ্যুতের শক।
নাজমা আক্তার ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার বাসিন্দা। তার চার মেয়ে ও এক ছেলে। বড় মেয়ের বিয়ে হয়েছে। ছেলের বয়স চার বছর। দারিদ্র্যের কারণে গত মে মাসের শুরুতে তিনি গৃহকর্মী হিসেবে সৌদি আরবে যান। শিপন নামের এক দালাল ঢাকার আল আরাফা রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে তাকে বিদেশে পাঠায়। যেতে তার খরচ হয় ৭০ হাজার টাকা। এই টাকা জোগাড় করতে ৪০ হাজার টাকা ঋণ করেছিলেন তার স্বামী। সেই ঋণের টাকা আজও পরিশোধ হয়নি।
নাজমা আক্তার জানান, সৌদির বিমানবন্দরে নামার পর সেখানকার এক এজেন্ট অফিসে নেওয়া হয় তাকে। দু'দিন পর তাকে গৃহকর্তার বাড়িতে পাঠানো হয়। প্রথম দু'দিন ভালোই কাটে। এরপর প্রতিদিন ১৬ থেকে ১৮ ঘণ্টা কাজ করানো হয়। এ ছাড়া গৃহকর্ত্রীর ভাই ও বাবার বাড়িতেও তাকে কাজ করতে হতো। টানা কাজ করায় তিনি অসুস্থ হয়ে পড়তেন। বিশ্রাম চাইলে গৃহকর্ত্রী চুলের মুঠি ধরে বলতেন, তাকে পাঁচ লাখ টাকায় কিনে আনা হয়েছে। সব কাজ করতে হবে। তাকে প্রথম দিকে সকালে এক কাপ চা ও একটি রুটি এবং সন্ধ্যায় খাবার দিলেও পরবর্তী সময়ে শুধু সন্ধ্যার খাবার জুটত। খাবার চাইলে নির্যাতন নেমে আসত। গৃহকর্ত্রী ঘরের মধ্যে ফেলে পা দিয়ে আঘাত করতেন। দেশে থাকা ছেলেমেয়ে ও স্বামীর সঙ্গে ফোনে কথা বলতে দেওয়া হতো না ঠিকমতো। মাস শেষে বেতনও দেওয়া হয়নি। বেতন চাইলে তাকে কেনা হয়েছে বলে জানিয়ে দেওয়া হতো। নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে গত ৩০ সেপ্টেম্বর তিনি পালিয়ে আসেন সৌদি আরবের সেই এজেন্ট অফিসে। এজেন্ট অফিসের মালিক গোফরান সৌদি নাগরিক। তিনি নাজমাকে বেধড়ক মারধর করে বলেন, তাকে পাঁচ লাখ টাকায় ওই গৃহকর্তার কাছে বিক্রি করা হয়েছে।
নাজমা বলেন, 'এজেন্ট অফিসে তিন দিন বিদ্যুতের শক দিয়েছিল। আমি অজ্ঞান হয়ে যেতাম। এক দিন জ্ঞান ফিরলে দেখি বাথরুমে পড়ে আছি। বাথরুমে তিন দিন আটকে রাখা হয়েছিল। কোনো খাবার দেওয়া হয়নি। অসুস্থ হয়ে পড়ি। ওষুধও দেয়নি। দেড় মাস সেখানে আটক থাকার পর র্যাবের সহায়তায় গত ১৬ নভেম্বর দেশে ফিরে আসি।' তিনি আরও বলেন, ধারদেনা করে বিদেশ গিয়ে নিঃস্ব হয়েছেন। দেনা শোধ করবেন কী করে।
নাজমা আক্তার ফেরার আগে গত অক্টোবরের শেষের দিকে আশুলিয়ার নাজমা বেগমকে সৌদি থেকে ফিরিয়ে আনে র্যাব-৪। নাজমা বেগম র্যাবকে তথ্য দিয়েছিলেন, তার মতো আরও তিন বাঙালি নারী সৌদির গোফরানের অফিসে আটকা আছে। মূলত তার কাছ থেকে তথ্য পেয়েই নাজমা আক্তারকে ফিরিয়ে আনা হয়।
নাজমা বেগম সমকালকে জানান, সংসারে অভাব থাকায় তিনি বিদেশে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। কাতারে মালি হিসেবে পাঠানোর নাম করে তাকে সৌদি আরবে গৃহকাজে পাঠানো হয়েছিল। দালাল ইমরানকে তিনি ৭০ হাজার টাকা দিয়েছিলেন বিদেশে যাওয়ার জন্য। ২ অক্টোবর সৌদিতে পৌঁছানোর পর তাকে কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয়। পাঁচ দিন পর পাঠানো হয় গৃহকর্তার বাড়িতে। প্রথম দিনেই তাকে রাত ১টা পর্যন্ত বাড়ির সব কাজ করানো হয়। রাতে এক কাপ চা আর একটি রুটি খেতে দেওয়া হয় তাকে। পরদিন সকালে একটি রুটি, চা এবং সন্ধ্যায় খাবার দেন। দু'দিন পর থেকে শুধু সন্ধ্যায় খেতে দেওয়া হতো। ২৪ ঘণ্টায় একবার খেয়ে চলতে কষ্ট হতো। এতে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। এর পরও ১৮ ঘণ্টা কাজ করতেই হতো। গৃহকর্ত্রীর কাছে খাবার চাইলে নেমে আসত নির্যাতন। তিন দিন খাবার দেননি তাকে। পানি খেয়েই দিন পার করেন। কান্নাকাটি করে কাজ বন্ধ করে দেন তিনি। ২০-২২ দিন পর গৃহকর্ত্রী তাকে গোফরানের অফিসে নিয়ে যান। তাকেও পাঁচ লাখ টাকায় বিক্রি করা হয়েছিল ওই বাড়িতে। গোফরান তাকে বেধড়ক মারধর করেন। এজেন্ট অফিসে আটকে রেখে প্রায় প্রতিদিন মারধর করা হতো তাকে।
এদিকে স্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ করতে না পেরে তার স্বামী দালাল ইমরানের সঙ্গে যোগযোগ করেন। নাজমাকে ফিরিয়ে আনতে তিন লাখ টাকা দাবি করেন ইমরান। কিন্তু এই টাকা দেওয়ার সামর্থ্য নেই তাদের।
এ বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে জানালে, বিদেশে নাজমাকে হত্যা করে লাশ গুম করে ফেলার হুমকি দিয়েছিলেন ইমরান। এসব তথ্য জানিয়েছেন নাজমা বেগমের স্বামী। তিনি আশুলিয়া থানায় গিয়েছিলেন। পরে র্যাবের কাছে লিখিত অভিযোগ করেন ইমরানের বিরুদ্ধে এবং স্ত্রীকে দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করার অনুরোধ জানান। এর পরই ইমরানকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। ৩০ অক্টোবর নাজমা বেগমকে ফিরিয়ে আনা হয়।
- বিষয় :
- সৌদিতে নির্যাতন
- ফেরত
- নারী