সুলভ মাছের গাড়ির দেখা পাওয়াই দুর্লভ

সুলভ মূল্যে মাছ-মাংস-ডিম কিনতে ভিড়। মঙ্গলবার রাজধানীর সচিবালয় এলাকায় সমকাল
জাহিদুর রহমান
প্রকাশ: ১৩ মার্চ ২০২৪ | ০০:০৭ | আপডেট: ১৩ মার্চ ২০২৪ | ০৮:২৭
স্বামী স্বল্প বেতনের চাকুরে, তাই মিরপুরের টোলারবাগের গৃহিণী মোহসেনা আক্তার সবসময় সঞ্চয়ী মনোভাব নিয়ে পথ চলেন। চোখ-কান খোলা রাখেন, যদি সাশ্রয়ে কিছু মেলে। তিনি গণমাধ্যমে দেখেন প্রতিকেজি রুই ২৪০ টাকা, পাঙাশ ও তেলাপিয়া ১৩০ টাকা এবং পাবদা ৩৩০ টাকায় বিক্রি করবে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়। কম দামে মাছ কিনতে গতকাল মঙ্গলবার সকাল ১০টায় নির্ধারিত স্থান মিরপুর ১ নম্বরের ঈদগাহ মাঠে চলে যান মোহসেনা। ততক্ষণে সেখানে জটলা পাকিয়েছে আরও অনেকে। তবে অপেক্ষা আর শেষ হয় না। অর্ধশতাধিক মানুষ প্রতীক্ষায় থাকলেও মধ্য দুপুরেও আসেনি কাঙ্ক্ষিত মাছের গাড়ি। এতে রোজা রেখে রোদে পুড়ে দাঁড়িয়ে থাকা ক্রেতাদের মনে দানা বাঁধে ক্ষোভ।
শুধু মিরপুর নয়, গতকাল সেগুনবাগিচা বাজার, মেরুল বাড্ডা বাজার, মুগদাপাড়ার মদিনাবাগ বাজার, যাত্রাবাড়ীর দয়লাল ভরসা বাজার, মতিঝিলের বাংলাদেশ ব্যাংকের দক্ষিণ-পূর্ব কর্নার এবং পলাশী মোড়েও নির্ধারিত সময়ে দেখা যায়নি মাছের গাড়ি। শুধু খামারবাড়ির সামনে বঙ্গবন্ধু চত্বরে নির্ধারিত সময়ে একটি মাছের গাড়ি দেখা যায়।
রমজান উপলক্ষে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে সুলভ মূল্যে বিক্রি কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন, গত রোববার উদ্বোধনের দিন একটি মাছের গাড়ি মন্ত্রীর অনুষ্ঠানে দেখা গেছে। এর পর থেকে গত সোমবার নির্ধারিত কোনো স্থানেই মাছ বিক্রি হয়নি। মন্ত্রীকে দেখানো এবং গণমাধ্যমে প্রচারণার জন্যই প্রথম দিন একটি গাড়ি অনুষ্ঠানে প্রদর্শনী দিয়েছে। রোজায় মানুষকে স্বস্তি দিতে তাদের কার্যক্রম চোখে পড়ছে না।
এ ব্যাপারে মৎস্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক সৈয়দ মো. আলমগীর বলেন, ঘোষণা দিয়েই সোমবার মাছ বিক্রি বন্ধ রাখা হয়েছিল। আমাদের ঘোষণা ছিল প্রথম রমজান থেকে বিক্রি করার। প্রথম রমজানে যানজটের কারণে অনেক স্থানে মাছের ভ্রাম্যমাণ গাড়ি পৌঁছাতে পারেনি। বিক্রি কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িতরা বিকেলে বিক্রি করার পরামর্শ দিয়েছেন। তাতে অফিসফেরত মানুষ মাছ কিনে বাসায় যেতে পারবেন। এই পরামর্শ আমলে নিয়ে বিকেলে মাছ বিক্রির সিদ্ধান্ত আসতে পারে।
মৎস্য অধিদপ্তরের জ্যেষ্ঠ সহকারী পরিচালক রাজু আহমেদ বলেন, প্রতি প্রজাতির মাছ সর্বোচ্চ দুই কেজি করে কিনতে পারবেন ক্রেতা। নগরে মোট আটটি ভ্যান যাবে। প্রতিটি ভ্যানে ৩০০ কেজি করে মাছ থাকার কথা।
মাছ ছাড়াও রাজধানীর ৩০ স্থানে দুধ, ডিম ও মাংস বিক্রি করা হচ্ছে। এর মধ্যে ভ্রাম্যমাণ বিক্রয়কেন্দ্র ২৫টি এবং স্থায়ী বাজার পাঁচটি। ভ্রাম্যমাণ বিক্রয় কেন্দ্রগুলো হলো নতুন বাজার (বাড্ডা), কড়াইল বস্তি (বনানী), খামারবাড়ি (ফার্মগেট), আজিমপুর মাতৃসদন (আজিমপুর), গাবতলী, দিয়াবাড়ী (উত্তরা), জাপান গার্ডেন সিটি (মোহাম্মদপুর), ষাটফুট রোড (মিরপুর), খিলগাঁও (রেলক্রসিংয়ের দক্ষিণে), সচিবালয়ের পাশে (আবদুল গনি রোড), সেগুনবাগিচা (কাঁচাবাজার), আরামবাগ (মতিঝিল), রামপুরা, কালশী (মিরপুর), যাত্রাবাড়ী (মানিকনগর গলির মুখে), নয়াবাজার (পুরান ঢাকা), বছিলা (মোহাম্মদপুর), হাজারীবাগ (সিকশন), লুকাস (নাখালপাড়া), কামরাঙ্গীরচর, মিরপুর-১০, কল্যাণপুর (ঝিলপাড়া), তেজগাঁও, পুরান ঢাকা (বঙ্গবাজার) ও কাকরাইল। আর স্থায়ী বাজার হলো– মিরপুর শাহ আলী বাজার, মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেট, নতুন বাজার (১০০ ফুট), কমলাপুর ও কাজী আলাউদ্দিন রোড (আনন্দবাজার)।
গতকাল সবগুলো এলাকা ঘুরে স্বস্তির পাশাপাশি অস্বস্তিও দেখা গেছে। বিভিন্ন স্পট ঘুরে এবং বিভিন্ন সূত্রের মাধ্যমে খবর নিয়ে দেখা গেছে, রাজধানীর খামারবাড়ির সামনে বঙ্গবন্ধু চত্বর ছাড়া আর সব স্থানেই নির্ধারিত সময়ে গাড়ি পৌঁছেছে। বিক্রিও হয়েছে বেশ।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে সুলভ মূল্যে দুধ, ডিম ও মাংস বিক্রির তৃতীয় দিন গতকাল খামারবাড়িতে সকাল ১০টার দিকে দুধ, ডিম ও মাংস নিয়ে গাড়ি আসার কথা ছিল। বেলা ১১টায় আসে ভ্রাম্যমাণ ফ্রিজিং সেই ভ্যান। বেসরকারি চাকরিজীবী মো. জাহাঙ্গীর বলেন, ‘সকাল ৯টায় এসেছি। ভেবেছিলাম, ৯টা থেকেই মাংস, দুধ, ডিম বিক্রি করা হবে। তবে ১১টা বেজে গেল এখনও গাড়ি আসেনি। এভাবে রোদের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকতে গেলে যে কেউ অসুস্থ হয়ে পড়বেন।’
এ ব্যাপারে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মোহাম্মদ রেয়াজুল হক বলেন, ‘আমাদের কিছু ড্রেসড ব্রয়লারের ঘাটতি পড়ে গেছে। বিশেষ অর্ডার দিয়ে আনার কারণে একটু দেরি হয়েছে। আর কোথাও এমন সমস্যা হয়নি। এরপর থেকে ঢাকার আর কোথাও দেরিতে গাড়ি যাবে না।
তবে গরু ও খাসির মাংস কিনে মানুষ স্বস্তি পেলেও মুরগি ও ডিম নিয়ে আছে অস্বস্তি। ক্রেতারা বলছেন, ড্রেসড ব্রয়লার বাইরেও ২৫০-২৬০ টাকায় পাওয়া যায়। এখানে ২৪০ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে।
আসাদুজ্জামান বলেন, দাম অনেকটাই সাশ্রয়ী। তাই অনেকের আগ্রহ। জনপ্রতি পণ্যের পরিমাণ আরও বাড়ানো প্রয়োজন। গরু ও খাসির মাংস পরিমাণে দুই কেজি করে দেওয়া দরকার।
গরুর মাংস সংগ্রহ করেছিলেন গৃহিণী রিয়া আক্তার। তাঁর পরিবারের সদস্যসংখ্যা পাঁচজন। স্বামী-সন্তান নিয়ে থাকেন ফার্মগেটে। রিয়া বলেন, ‘অন্য জায়গা থেকে এখানে দাম অনেকটা কম। তাই ভেবেছিলাম কয়েক কেজি কিনব। তবে এখানে এক কেজির বেশি গরুর মাংস দেওয়া হচ্ছে না।’
আছে স্বস্তিও
রাজধানী রামপুরা বাজারের পাশেই ছোট্ট একটি পিকআপ ভ্যানের পেছনে দুই লাইনে জনাবিশেক মানুষ দাঁড়ানো। সেখানে সরকারের উদ্যোগে সুলভ মূল্যে দুধ, ডিম, মাংস বিক্রি করা হচ্ছিল। সময় যত গড়াচ্ছিল, লাইনে মানুষের সংখ্যাও ধীরে ধীরে বাড়ছিল। এরই মধ্যে বেলা সাড়ে ১১টার দিকে বিক্রেতা জানালেন, মুরগির মাংস শেষ। বিক্রেতা রিফাত বলেন, মাত্র ৪০ কেজি মুরগির মাংস দেওয়া হয়েছিল, যা দ্রুত শেষ হয়ে গেছে। তবে গরুর মাংস, দুধ ডিম আছে।
গতকাল রামপুরার পাশাপাশি কাকরাইল, রামপুরা, বছিলা, সচিবালয়, বাড্ডাসহ সুলভ মূল্যের পণ্য বিক্রির কয়েকটি স্পট ঘুরে দেখা যায়, সুলভ দরে পণ্য কেনাকাটায় মানুষের ব্যাপক আগ্রহ তৈরি হয়েছে। কারণ বাজারে যেখানে ৭৮০-৮০০ টাকায় গরুর মাংস কিনতে হচ্ছে, সেখানে ভ্রাম্যমাণ ভ্যানে গরুর মাংস বিক্রি হচ্ছে ৬০০ টাকায়। খাসির মাংস বিক্রি হচ্ছে ৯০০ টাকায়।
এক কেজি গরুর মাংস, এক ডজন ডিম ও এক লিটার দু্ধ নেওয়ার পর আছিয়া বেগমের মুখে স্বস্তির ছাপ দেখা গেল। তিনি বললেন, ‘৮০০ টাকা দিয়ে গরুর মাংস খাওয়ার চিন্তা বাদ দিয়েছিলাম। তবে বাজার করে ফেরার পথে দেখলাম ৬০০ টাকায় সরকার মাংস বিক্রি করছে। তাই নিলাম। এ ধরনের উদ্যোগ আমাদের মতো মানুষের জন্য স্বস্তির।’
সুলভ দরের ভ্রাম্যমাণ দোকানে ১৩৫ টাকার (এক ডজন) ডিম বিক্রি হচ্ছে ১১০ টাকায়। মিল্ক ভিটা কিংবা আড়ংয়ের ৯০ টাকা লিটার দুধ বিক্রি হচ্ছে ৮০ টাকায়।
কাকরাইলের বিক্রয়কেন্দ্র তদারকির দায়িত্বে থাকা প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের এলডিডিপি প্রকল্পের উপপ্রকল্প পরিচালক শাহ আলম বিশ্বাস বলেন, সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যাপক সাড়া পাওয়া যাচ্ছে।
ফ্রিজিং ভ্যানগুলোর সামনে মাংস কেনার জন্য যারা আসছেন, তাদের বেশির ভাগই মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত। কাকরাইলে গরুর মাংস কিনতে এসেছেন গৃহিণী নাজনীন জুঁই। আগের দিনও মাংস নিয়ে গেছেন তিনি। বলেন, ‘সোমবার এক কেজি নিয়েছি। ভেবেছিলাম কেমন না কেমন হবে; কিন্তু রান্নার পর বাসার সবাই পছন্দ করেছে। তাই আজ আবার নিতে এসেছি।’ আজ গরুর মাংসের সঙ্গে দুধ ও মুরগির মাংসও কিনবেন বলে জানান তিনি।
বাংলাদেশে ডেইরি ফার্মার্স অ্যাসোসিয়েশন সুলভ মূল্যের বিক্রি কার্যক্রমে সহায়তা করছে। সংগঠনের সভাপতি মোহাম্মদ ইমরান হোসেন বলেন, দেশে বেশির ভাগ ব্যবসায়ী রমজানে পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেন। একমাত্র খামারিরা সেই করোনাকাল থেকেই রমজানে কম দামে পণ্য বিক্রি করছেন। সারাদেশের ক্ষুদ্র খামারিরা সরাসরি এই বিক্রয় কেন্দ্রে পণ্য পাঠিয়ে দিচ্ছেন। এতে খামারিরাও উপকৃত হচ্ছেন আবার ভোক্তাও দাম কমে পাচ্ছেন।