খালের সীমানা নিয়ে ঢাকার দুই সিটি উভয় সংকটে

কোলাজ
অমিতোষ পাল
প্রকাশ: ১৯ মার্চ ২০২৫ | ০১:৩২ | আপডেট: ১৯ মার্চ ২০২৫ | ১২:২৩
খাল হস্তান্তরের চার বছর পেরিয়ে গেলেও মালিকানা বুঝে পায়নি ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন। এ কারণে খালের দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও অবস্থান নির্ধারণ নিয়ে বিড়ম্বনায় পড়েছে সংস্থা দুটি। খালপাড় নিয়ে পরিকল্পনাও করতে পারছে না তারা।
এদিকে, সীমানার সুরাহা না হওয়ায় খালপাড়ের জমির মালিক ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান পড়েছে মহাবিপদে। খাল এলাকার জমি হলে সিটি করপোরেশন থেকে নিতে হয় অনুমতি। ঢাকা মহানগরীর প্রায় প্রতিটি মৌজাতেই খালের অস্তিত্ব বিদ্যমান। ফলে যেসব মৌজায় খাল রয়েছে, ঘরবাড়ি বানাতে গেলেই লাগছে সিটি করপোরেশনের অনুমোদন। তবে আবেদন করেও তা মিলছে না। ওই সব জমির মালিক অবকাঠামো তৈরির জন্য রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) কাছে আবেদন করেও বছরের পর বছর ঘুরছেন।
সিটি করপোরেশনের সম্পত্তি শাখার কর্মকর্তারা বলছেন, খালের মালিকানা মুখে মুখে পেলেও কাগজপত্র, নকশার গেজেটেড কপি সিটি করপোরেশনকে বুঝিয়ে দেয়নি ঢাকা ওয়াসা বা জেলা প্রশাসক (ডিসি) কার্যালয়। লিখিত কাগজপত্র না পাওয়ায় সিটি করপোরেশনের সম্পত্তি বিভাগ খালপাড়ে ইমারত নির্মাণের অনুমতি দিচ্ছে না।
জানা যায়, ২০২০ সালের ৩১ ডিসেম্বর তৎকালীন স্থানীয় সরকারমন্ত্রী তাজুল ইসলাম রাজধানীর দুই সিটি করপোরেশনের মেয়র, ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক, জেলা প্রশাসকসহ সংশ্লিষ্টদের উপস্থিতিতে রাজধানীর ২৬টি খাল দুই সিটি করপোরেশনের কাছে হস্তান্তর করেন। এর আগে খালের মালিক ছিল ঢাকার জেলা প্রশাসকের কার্যালয়। তদারকির দায়িত্বে ছিল ঢাকা ওয়াসা। হস্তান্তরের পর বাহ্যিকভাবে খালের মালিকানা চলে যায় সিটি করপোরেশনের হাতে। এর পর দুই সিটি করপোরেশনই খালের ব্যাপারে বেশ তৎপর হয়ে ওঠে।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) খাল দখলমুক্ত রাখতে সেনাবাহিনীর সহযোগিতা নেয়। সেনাসদস্যদের দিয়ে উত্তর এলাকার খালগুলোর বিদ্যমান অবস্থান থেকে ১০ ফুট দূরত্বে লাল মার্কিং বা খুঁটি পুঁতে দেয়। তখন ডিএনসিসির পক্ষ থেকে জানিয়ে দেওয়া হয়, এই ১০ ফুট জায়গায় প্রয়োজনে ওয়াকওয়ে, সবুজায়ন বা সৌন্দর্যবর্ধন করা হবে। বাস্তবে কোনো কার্যক্রম দেখা যায়নি।
রাজধানীর মিরপুরের মোমিন গাজী নামে এক ভুক্তভোগী জানান, খালপাড়ে রয়েছে তাদের সাড়ে ১৬ শতাংশ পৈতৃক জমি। সেখানে তারা টিনশেড বানিয়ে বাস করছিলেন। পরে তারা ভাইবোন মিলে একটি বহুতল ভবন তৈরির উদ্যোগ নেন। অনেক দিন রাজউকে ঘুরে নকশা অনুমোদনের আবেদন করেন। রাজউক থেকে ডিএনসিসির নির্বাহী প্রকৌশলীকে (পরিকল্পনা) চিঠি দেয় সরেজমিন পরিদর্শন করে মতামত দেওয়ার জন্য। নির্বাহী প্রকৌশলীর কাছ থেকে সেই ফাইল তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী, অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী ও সর্বশেষ প্রধান প্রকৌশলীর অনুমোদনের পর যায় সম্পত্তি শাখায়। ফাইলটি প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তার দপ্তরে যেতে লাগে এক মাস। প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তার দপ্তর থেকে চিঠি দিয়ে ভূমির মালিকদের দলিল, সিএসআরএস ও সিটি জরিপ পর্চা, ভূমির উন্নয়ন কর, কল্যাণপুর খালের নকশার কালার প্রিন্ট কপি, গেজেটের কপি ও খালের পেন্টাগ্রাফ নকশার কালার প্রিন্ট কপি চাওয়া হয়। পরে ডিসি অফিস থেকে সেগুলো তারা আর সংগ্রহ করতে পারেননি।
প্রায় একই তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা জানান দক্ষিণ পীরেরবাগের সাত্তার হাজি নামে আরেক ভুক্তভোগী। তিনি জানান, সিটি করপোরেশন বলছে, খালের কাগজপত্র এখনও ডিসি অফিসে রয়েছে। এ জন্য ঘরবাড়ি তৈরির জন্য সিটি করপোরেশন অনাপত্তিপত্র দিচ্ছে না। সম্পত্তি বিভাগের কর্মকর্তাদের সরেজমিন জরিপ করে মতামত দেওয়ার কথা বললেও সার্ভেয়াররা মাঠ পরিদর্শনে যাচ্ছেন না।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০২৪ সালে ডিএনসিসির তৎকালীন প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা ড. মোহাম্মদ মাহে আলম খালপাড়ের বাসিন্দাদের ভোগান্তি নিরসনের উদ্যোগ নেন। তখন খালের কাগজপত্র জেলা প্রশাসকের কাছে চেয়ে একটি চিঠি তৈরি করা হয়। সেই চিঠি বিভিন্ন জনের সই শেষে গত ২৮ ফেব্রুয়ারি ডিএনসিসির প্রশাসক স্বাক্ষর করেন। তবে এখন পর্যন্ত সেই চিঠি ডিসি অফিসে পাঠানো হয়নি।
সম্পত্তি বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, এ বিষয় নিয়ে ডিসি অফিস, রাজউক, সিটি করপোরেশন ও ওয়াসার একটি সমন্বিত বৈঠক করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এ জন্য বর্তমানে চিঠি তৈরি হচ্ছে। বৈঠকের আগপর্যন্ত সার্ভেয়ারদের সাইট ভিজিট বন্ধ থাকবে।
একজন সার্ভেয়ার বলেন, তাঁর অঞ্চলে এ রকম অনেক আবেদন পড়ে আছে। তবে সাইট পরিদর্শন করতে পারছেন না। বর্তমানে দুই সিটির ২০টি অঞ্চল রয়েছে। প্রতিটিতেই ২০ থেকে ৩০টি করে আবেদন পড়ে আছে।
এ ব্যাপারে ডিএনসিসির প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা মো. নুরুজ্জামান সমকালকে বলেন, ডিটেইল এরিয়া প্ল্যানের (ড্যাপ) দোহাই দিয়ে রাজউক বলছে, খালের পাড়ে ১৫ ফুট জমি ছেড়ে ভবন তৈরি করতে হবে। আমরা বলেছি, ১৫ ফুট ছাড়লে একজনের যদি দুই কাঠা জমি থাকে, তাহলে তাঁর আর থাকে কী? এ জন্য রাজউককে বলেছি, বাড়ি বানানোর অনাপত্তিপত্রের জন্য সিটি করপোরেশনে পাঠানোর দরকার নেই। তবে তারা সেটি শুনছে না।
ঢাকার জেলা প্রশাসক তানভীর আহমেদ সমকালকে বলেন, সম্প্রতি আমি এ পদে এসেছি। বিষয়টি নিয়ে আমি এখনও অবগত নই।
এ ব্যাপারে ড্যাপের প্রকল্প পরিচালক ও রাজউকের প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ আশরাফুল ইসলাম বলেন, সিটি করপোরেশনের তো এত কাগজপত্র চাওয়ার দরকার নেই। তারা সিএস ও আরএস ম্যাপ দেখেই তো অনাপত্তিপত্র দিতে পারে। আগেও সিটি করপোরেশনের অনাপত্তিপত্র দিতে দেরির অভিযোগ এসেছে। এ জন্য রাজউক নিয়ম করতে চাচ্ছে, চার সপ্তাহের মধ্যে যদি সিটি করপোরেশন অনাপত্তিপত্র না দেয়, তাহলে ধরে নেওয়া হবে, তাদের কোনো আপত্তি নেই।
তিনি আরও বলেন, ড্যাপ প্রণয়নের আগে ঢাকা, গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জের চার মেয়র এক বৈঠকে খালের তীর রক্ষার দাবি তুলেছিলেন। তারা বলেছিলেন, খালের পাড়ে যাতে অন্তত একটা ওয়াকওয়ে তৈরি করা যায়। এ জন্য ড্যাপে খালের তীরে ১০ ফুট ছাড়ার কথা বলা আছে। আর যিনি বাড়ি বানাবেন, তিনি আরও ৫ ফুট সেটব্যাক রেখে তৈরি করবেন। এই ৫ ফুট ওই বাড়ি মালিকেরই থাকবে।
- বিষয় :
- খাল
- সিটি করপোরেশন