ঢাকা রবিবার, ০৬ জুলাই ২০২৫

বিশ্ব শিক্ষক দিবস

ফিরে দেখা বাংলাদেশের শিক্ষক আন্দোলন

ফিরে দেখা বাংলাদেশের শিক্ষক আন্দোলন

শাহজাহান আলম সাজু

প্রকাশ: ০৪ অক্টোবর ২০২০ | ১২:০০ | আপডেট: ০৪ অক্টোবর ২০২০ | ১৪:৫৯

শিক্ষকদের অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ইউনেস্কো, আইএলও বিশ্ব শিক্ষক দিবসের সূচনা করেছিল। দিবসটির সূচনার অর্ধশত বছর পরও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শিক্ষকদের ন্যায্য অধিকার ও মর্যাদার জন্য আজও আন্দোলন অব্যাহত আছে। জাতিসংঘের শিক্ষা, সংস্কৃতি ও বিজ্ঞানবিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো ঘোষিত জাতীয় বাজেটে শিক্ষা খাতে জিডিপির ৮% এবং সর্বশেষ ডাকারে অনুষ্ঠিত পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের শিক্ষামন্ত্রীদের সভায় আপাতত জিডিপির ৬% বরাদ্দের সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু পৃথিবীর অনেক দেশেই ইউনেস্কো ঘোষিত সেই সিদ্ধান্ত এখনও বাস্তবায়িত হয়নি। বাংলাদেশ সরকারও এই সিদ্ধান্তে স্বাক্ষরকারী দেশ। কিন্তু বাংলাদেশ শিক্ষা খাতে জিডিপির ২.৪-২.৫% এর বেশি বরাদ্দ সরকার দিতে পারেনি। বাংলাদেশে শিক্ষকদের অধিকার, মর্যাদা এবং শিক্ষা আন্দোলনের একটি গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস রয়েছে।

স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব নেওয়ার পরই বঙ্গবন্ধু প্রথম বাজেটেই শিক্ষা জাতীয়করণের উদ্যোগ প্রহণ করেন। তিনি যুদ্ধবিধ্বস্ত নবসৃষ্ট বাংলাদেশের সব প্রাথমিক বিদ্যালয়কে (৩৬ হাজার) জাতীয়করণের মাধ্যমে এক অনন্য সাধারণ দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর সময় আন্দোলনে শিক্ষকদের বেতন বৃদ্ধি, রেশনিং চালুসহ বেশকিছু দাবি পূরণ হয়। জিয়াউর রহমানের সময়ে ব্যাপক আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে তখনকার প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা শিক্ষক নেতৃবৃন্দের সঙ্গে এক সমঝোতা বৈঠকে বসেন। ওই বৈঠকে ১৯৮০ এবং ১৯৮১ সালের মধ্যে জাতীয় বেতন স্কেলে ৫০% বেতন কার্যকর করার বিষয়ে সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এরশাদের সময়ে শিক্ষকদের আন্দোলনের এক পর্যায়ে সরকার শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন ১০% বৃদ্ধি করে ৫০% থেকে ৬০% করা হয়।

নব্বইয়ের দশকে আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সঙ্গে শিক্ষক নেতৃবৃন্দের সমঝোতা বৈঠকে শিক্ষকদের বেতন ৭০% থেকে ৮০%, একটা টাইম স্কেল, চিকিৎসা ভাতা ১০০ টাকা থেকে দেড়শ টাকা করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ১৯৯৬ সালে নির্বাচনে সুদীর্ঘ ২১ বছর পর আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। ক্ষমতায় এসেই শেখ হাসিনা সরকার শিক্ষা সংস্কারের উদ্যোগ গ্রহণ করে। শিক্ষানীতি প্রণয়নের লক্ষ্যে গঠিত হয় সামসুল হক শিক্ষা কমিশন। শেখ হাসিনা সরকারের আমলেই ১৯৯৭ সালে বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারী কল্যাণ ট্রাস্ট পুনরায় চালু করা হয়। এ সময়ই কোনো প্রকার আন্দোলন ছাড়া স্বয়ংক্রিয়ভাবে জাতীয় পে-স্কেলে বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীরা অন্তর্ভুক্ত এবং শিক্ষকদের যার যার নামে ইনডেক্স সিস্টেম চালু করে তাদের অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠানোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। ১৯৯৭ সালে শিক্ষাব্যবস্থা জাতীয়করণের দাবিতে ৩৮ দিন শিক্ষক ধর্মঘট পালিত হয়। একপর্যায়ে সরকার শিক্ষকদের বেতন ১০% বৃদ্ধি করে ৯০%-এ উন্নীত করে।

বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকেও শিক্ষক আন্দোলন বেশ জোরালো ছিল। ২০০৬ সালের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষামন্ত্রী ওসমান ফারুক তার সরকারি বাসভবনে শিক্ষক-কর্মচারী ঐক্য পরিষদের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে বৈঠকে বসেন। সেই বৈঠকেই বেতন স্কেল ৯০% থেকে বাড়িয়ে ১০০%-এ উন্নীত করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। পূর্বেকার বর্ষীয়ান শিক্ষক নেতৃবৃন্দের সততা, মেধা, ব্যক্তিত্ব, আচার-আচরণ, সাংঠনিক প্রজ্ঞা, দূরদৃষ্টি সাধারণ শিক্ষকদের আকৃষ্ট করত। এসব নেতাদের দেশের প্রতি, পেশার প্রতি একটা কমিটমেন্ট ছিল। তাদের রাজনৈতিক ব্যাকগ্রাউন্ড ও পারবারিক ঐতিহ্য ছিল। কিন্তু বর্তমান শিক্ষক নেতাদের মেধা, প্রজ্ঞা, বিচক্ষণতা, দূরদৃষ্টি সাধারণ শিক্ষকদের আকৃষ্ট করতে পারছে না বলে অনেকেই মনে করেন। তাছাড়া শিক্ষক সংগঠনগুলো বহুদা বিভক্তি। একে অপরের প্রতি অশ্রদ্ধা, অসম্মান বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে রাতারাতি সংগঠন গড়ে তুলে দাবি আদায়ের নামে অপরিপকস্ফ কর্মসূচি প্রদান, একে অপরের প্রতি অশ্রদ্ধা, কাদা ছোড়াছুড়ি এসব বিভিন্ন কারণে শিক্ষক রাজনীতি ও শিক্ষক আন্দোলন আজ তার ঐতিহ্য হারাতে বসেছে।

বর্তমান শেখ হাসিনা সরকারের শাসনামলে গত এক দশকে তেমন কোনো শিক্ষক আন্দোলন গড়ে ওঠেনি। নন-এমপিওদের এমপিও এবং শিক্ষাব্যবস্থা জাতীয়করণের দাবিতে বিভিন্ন সংগঠনের প্রেস ক্লাবকেন্দ্রিক সভা সমাবেশ এবং কর্মসূচির মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। তবে বর্তমান সরকারের শাসনামলে শিক্ষানীতি প্রণয়ন, ২৬ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়, ৩৩০ কলেজ, ২২০ স্কুল জাতীয়করণ, জাতীয় বেতন স্কেলে শিক্ষকদের বেতন দ্বিগুণ বৃদ্ধি, ৫% ইনক্রিমেন্ট, ২০% বৈশাখী ভাতা, কল্যাণ ও অবসর বোর্ডের জন্য ১৬৭৭ কোটি টাকা বিশেষ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া এক সময় বেসরকারি শিক্ষকরা নামমাত্র বেতন পেতেন। সারাজীবন শিক্ষকতা করেও শেষ জীবনে তাদের শূন্য হাতে বাড়ি ফিরতে হতো। অবসরকালে কোনো আর্থিক সুবিধা পেতেন না। এখন সময় বদলেছে। এখন বেসরকারি শিক্ষকরা অবসরকালীন সময়ে সম্মানজনক কল্যাণ ও অবসর সুবিধা পাচ্ছেন। এসব কারণেও শিক্ষক আন্দোলন জোরদার গড়ে তোলা যায়নি।

তথাপিও বেসরকারি শিক্ষা ক্ষেত্রে এখনও অনেক বৈষম্য বিরাজমান। এখনও বিপুলসংখ্যক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিও-বহির্ভূত থাকায় সেসব প্রতিষ্ঠানে কর্মরত বিপুলসংখ্যক শিক্ষক-কর্মচারী মানবেতর জীবনযাপন করছেন। এ ছাড়া সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানের ব্যাপক বৈষম্যে বিরাজমান। বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচালনা কমিটির অযাচিত হস্তক্ষেপ, শিক্ষকদের চাকরির নিশ্চয়তা ও মর্যাদার ক্ষেত্রেও বহু সমস্যা বিরাজমান রয়েছে। এসব বিষয়কে কেন্দ্র করে শিক্ষকদের মধ্যে বিরাজমান ক্ষোভ থেকে শিক্ষক আন্দোলন যে কোনো সময় দানা বেঁধে উঠতে পারে। এসব সমস্যার সমাধান, শিক্ষকের অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য শিক্ষা খাতে অর্থ বরাদ্দের কোনো বিকল্প নেই। মনে রাখতে হবে একটি রাষ্ট্রের জন্য শিক্ষার চেয়ে উৎকৃষ্ট আর কোনো বিনিয়োগ হতে পারে না।

সাবেক ছাত্রনেতা, সাধারণ সম্পাদক স্বাধীনতা শিক্ষক পরিষদ, ফার্স্ট সেক্রেটারি ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন অব টিচার্স ইউনিয়ন

আরও পড়ুন

×