বিশ্ব শিক্ষক দিবস
শিক্ষকের নেতৃত্ব ও অবস্থান

কাজী ফারুক আহমেদ
প্রকাশ: ০৪ অক্টোবর ২০২০ | ১২:০০ | আপডেট: ০৪ অক্টোবর ২০২০ | ১৫:০১
করোনার মতো অভাবিত দুর্যোগের পটভূমিতে বাংলাদেশসহ দেশে-দেশে শিক্ষকরা আজ দিবসটি পালন করছেন। ইউনেস্কো নির্ধারিত এ বছরের প্রতিপাদ্য :'সংকটে নেতৃত্বদাতা, ভবিষ্যতের রূপদর্শী শিক্ষক'। শিক্ষকদের 'মর্যাদা সনদ' হিসেবে ইউনেস্কো-আইএলও সুপারিশকৃত বিষয়গুলোর মধ্যে রয়েছে- শিক্ষাকে রাষ্ট্রের দায়িত্ব হিসেবে স্বীকার করা, শিক্ষা পরিকল্পনা সমগ্র অর্থনৈতিক পরিকল্পনার অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে বিবেচনা করা, কোনো একতরফা সিদ্ধান্ত দ্বারা শিক্ষকদের পেশা জীবন ও অবস্থান যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, তার পর্যাপ্ত নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ইত্যাদি।
ফিনল্যান্ড, নেদারল্যান্ডস ও সিঙ্গাপুরের কথা বাদ দিলে পেশা হিসেবে শিক্ষকতা তরুণ, এমনকি মধ্য বয়সীদের খুব একটা আকর্ষণ করে না। অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাজ্য, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক উন্নত দেশেই তরুণদের কাছে পেশা হিসেবে শিক্ষকতা তাদের অগ্রাধিকার তালিকায় নেই। এমনকি তরুণদের একটা উল্লেখযোগ্য অংশই এ পেশা ছেড়ে দেওয়ার পক্ষে। যুক্তরাজ্যে বেশি কাজ ও কম বেতনের কারণে যাদের বয়স ৩৫ বছরের কম, তাদের প্রায় অর্ধেকসংখ্যক শিক্ষক আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে শিক্ষকতা ছেড়ে দিতে পারেন বলে ন্যাশনাল ইউনিয়ন অব টিচার্সের এক জরিপে জানা যায়। যুক্তরাষ্ট্রে ৪১ শতাংশ প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষক পেশায় যোগদানের পাঁচ বছরের মধ্যে পেশা ত্যাগ করেন বলে ইউনেস্কোর বিশ্ব শিক্ষক দিবস ২০১৯ উপলক্ষে প্রকাশিত ধারণাপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে।
বিভিন্ন দেশে শিক্ষকরা সংগঠিত। তাদের সংগঠনের কার্যক্রম শুধু পেশাগত দাবি আদায়ের কর্মসূচিতে সীমাবদ্ধ নয়। ওইসব সংগঠন থেকে নিয়মিত জরিপ ও গবেষণা কার্যক্রম পরিচালিত হয় এবং সদস্য শিক্ষকরাও সংগঠনের সুবাদে নানারকম প্রশিক্ষণ নিয়ে থাকেন। আমাদের দেশের সঙ্গে কোনোভাবেই তার তুলনা চলে না। তারপরও শিক্ষকতা পেশায় তারা যে অনাগ্রহী উল্লিখিত বর্ণনা তারই সাক্ষ্য দেয়। বাংলাদেশে শিক্ষকতা পেশায় সমস্যা অন্তহীন। বেতন-ভাতা, পদোন্নতিতে সরকারি খাতের একচেটিয়া অগ্রাধিকার। তারপরও গত চার দশকে বাংলাদেশে শিক্ষকদের অবস্থানের পরিবর্তন হয়েছে, এটা ঠিক। তবে সময় ও বিশ্বের তুলনায় তা এখনও আশাব্যঞ্জক নয়। এখনও মেধাবীরা শিক্ষকতায় আসছে না। অভিজ্ঞ শিক্ষকরা অবসরে চলে যাচ্ছেন। এসব শূন্যস্থান যথাযথভাবে পূরণ হচ্ছে না। মেধাবীদের শিক্ষকতা পেশায় আকৃষ্ট করার জন্য দীর্ঘমেয়াদি ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। অতি সম্প্রতি ইউনেস্কো জাতীয় শিক্ষকনীতি প্রণয়ন, প্রধান শিক্ষককে প্রধান করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠনের যে নির্দেশনা দিয়েছে এবং জাতিসংঘ ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়নের যে ১৭টি লক্ষ্য ঘোষণা করেছে, তার মধ্যে ৪ নম্বর যা শিক্ষার্থী, শিক্ষক উন্নয়ন ও শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধির সঙ্গে সম্পর্কিত। কিন্তু বিভিন্ন দেশের শিক্ষক সংগঠনগুলোর মতো বাংলাদেশে শিক্ষক সংগঠনগুলোকে সেভাবে সক্রিয় দেখা যাচ্ছে না।
প্রাথমিক স্তর ও মাধ্যমিকে নারী শিক্ষকদের উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো হলেও বিশ্ববিদ্যালয়ে নারী শিক্ষকের সংখ্যা তেমনটা নয়। তবে বাড়ছে। নারী শিক্ষকদের কেউ কেউ উপাচার্য, উপ-উপাচার্য পদেও দায়িত্ব পালন করছেন। তবে কারিগরি শিক্ষায় মেয়ে শিক্ষার্থী, নারী শিক্ষক অনুল্লেখযোগ্য। তৃতীয় লিঙ্গের শিক্ষক কোথাও কর্মরত আছে তেমনটা জানা নেই। ভারতে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য হিসেবে একজনের দায়িত্ব পালনের কথা শোনা গেলেও পরে জানা যায়, সহকর্মীদের অসহযোগিতার কারণে তাকে দায়িত্ব ছেড়ে দিতে হয়। বাংলাদেশে প্রাথমিক বাদ দিলে পরবর্তী শিক্ষা স্তরগুলোর ৯০ শতাংশের বেশি বেসরকারি। সেখানে পাঠরত শিক্ষার্থী ও কর্মরত শিক্ষক উভয়ই বৈষম্য-বঞ্চনার শিকার। তারপরও এ কথা স্বীকার করতে হবে, বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত যেটুকু ইতিবাচক অর্জন, তার সিংহভাগই শেখ হাসিনার হাত দিয়ে হয়েছে। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী বিধ্বস্ত বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শুধু স্বাধীন দেশের উপযোগী শিক্ষানীতি (কুদরাত-এ খুদা) রিপোর্ট দিয়েই ক্ষান্ত থাকেননি। তা বাস্তবায়নের পরিকল্পনা-নির্দেশনাও দিয়ে যান। কিন্তু তাকে হত্যার পর ক্ষমতাসীন সরকারগুলো শিক্ষায় মৌলিক কোনো পরিবর্তনে হাত দেয়নি। সেজন্য প্রাথমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সরকারীকরণের পুরোটাই হয়েছে বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনার হাত দিয়ে। শিক্ষা কারিকুলামে পরিবর্তন, তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার, মূল্যায়ন ব্যবস্থায় পরিবর্তন, সরকারি কর্মচারীদের সঙ্গে সঙ্গে এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের মূল বেতন বৃদ্ধি তার অন্যতম।
তার পরও কথা থাকে। বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারে বড় পদোন্নতি হলেও বেসরকারি কলেজ শিক্ষকদের পদোন্নতির হাল আগে যে তিমিরে ছিল, এখনও সে তিমিরেই। সহকারী অধ্যাপকের পদই সেখানে শেষ কথা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শিক্ষা উপদেষ্টার নেতৃত্বে গঠিত এমপিও নীতিমালা প্রণয়ন কমিটিসহ একাধিক কমিটির সুপারিশ সত্ত্বেও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে রশি টানাটানির কারণে সহযোগী অধ্যাপক ও অধ্যাপক পদ সৃষ্টি হয়নি। এমনকি এমপিওভুক্ত বেসরকারি ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ-উপাধ্যক্ষরা যথাক্রমে সরকারি কলেজের অধ্যাপক ও সহযোগী অধ্যাপকের মূল বেতন পেয়ে এলেও তাদের পর্যন্ত অধ্যাপক ও সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে যথাযথ পদায়ন করা হয়নি। ১৯৯৪ সালে জমিরউদ্দিন সরকার শিক্ষামন্ত্রী থাকাকালে বেসরকারি মাধ্যমিক স্কুলের প্রধান শিক্ষকদের বেতন অন্যায়ভাবে সরকারি প্রধান শিক্ষকদের এক ধাপ নিচে মূল বেতন নির্ধারণ করা হয়। এ বঞ্চনার এখনও অবসান হয়নি। অথচ প্রাথমিক পরবর্তী বেসকারি স্কুল-কলেজের শিক্ষকরাই দেশে শিক্ষার ৯০ ভাগের বেশি দায়িত্ব পালন করে থাকেন। বেসরকারি স্কুল, ডিগ্রি কলেজ, অনার্স মাস্টার্স কলেজ, মাদ্রাসা, কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যারা কর্মরত, তাদের মধ্যে অনেকে হয় প্রতিষ্ঠান থেকে, না হয় সরকার থেকে অথবা দুটো উৎস থেকেই বেতন-ভাতা, পদোন্নতি থেকে বঞ্চিত। সরকারি প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষকরা বেতন বৈষম্যের অবসান, টাইম স্কেল বাস্তবায়ন ও পদোন্নতি দাবিতে সোচ্চার। এদিকে ইবতেদায়ি মাদ্রাসা, বেসরকারি স্কুলের প্রাথমিক শ্রেণিগুলোর সঙ্গে সরকারি প্রাথমিক স্কুলের আর্থিক ও ব্যবস্থাপনাগত দুস্তর ব্যবধান দূর করতে কার্যকর পদক্ষেপ এখনও দৃষ্টিগোচর নয়। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা গবেষণা কার্যক্রমের জন্য পর্যাপ্ত বরাদ্দ পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ রয়েছে। ৬৬ হাজার কিন্ডারগার্টেনে কর্মরত ১০ লাখের কাছাকাছি শিক্ষক করোনাকালে প্রতিষ্ঠান ও পেশার অস্তিত্ব রক্ষার সংকটে ব্যস্ত। পদোন্নতির প্রশ্ন সেখানে বাস্তবেই অপ্রাসঙ্গিক। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রয়োজনীয় স্থায়ী শিক্ষক জনবল নেই। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সুপারিশ দেওয়ার বিধান আছে। সুপারিশ কার্যকরের ক্ষমতা নেই।
অন্যদিকে, শিক্ষার্থী সংখ্যার দিক থেকে সর্বোচ্চ এবং দেশজুড়ে অবস্থান হলেও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় এখনও উপেক্ষার পাত্র। তবে এ কথা স্বীকার করতে হবে, ইউজিসির বর্তমান চেয়ারম্যানের সময়কালে প্রতিষ্ঠানটি আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি সক্রিয়।
বর্তমান পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের ২০ লাখ শিক্ষকের কাছে বিশ্ব শিক্ষক দিবস ২০২০ কী বার্তা এনেছে? দিবসটি উপলক্ষে ইউনেস্কোর প্যারিস প্রধান কার্যালয় থেকে যে ধারণাপত্র প্রকাশ করা হয়েছে, তা বাংলাদেশে কতটা প্রাসঙ্গিক? এ ক্ষেত্রে শিক্ষকদের যথোচিত গুরুত্বদানের প্রশ্ন যেমন আছে, শিক্ষকদের সংগঠিত উদ্যোগের বিষয়টিও কম গুরুত্বের নয়। দুটোই যুগপৎ গুরুত্ববহ। করোনার মতো সংকটে নেতৃত্বদানের সক্ষমতা ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার রূপরেখা সৃজনের নৈপুণ্য দুটোই তাৎপর্যপূর্ণভাবে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। এবারের বিশ্ব শিক্ষক দিবসের প্রতিপাদ্যের এটাই মূল কথা। তারা কি করোনার মতো সংকটকালে নেতৃত্ব দিতে ও শিক্ষার ভিত্তিতে নতুন সম্ভাবনা সৃষ্টিতে যথাযথ ভূমিকা রাখতে পারছেন? বিশেষ করে তৃণমূলের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের কথা, তাদের প্রযুক্তিগত দক্ষতা ও অপ্রাপ্তির বেদনা আমলে নিয়ে, অগ্রাধিকার দিয়েই স্কুল খোলা না খোলা, মূল্যায়ন ব্যবস্থার পুনর্বিন্যাস জরুরি। যে কোনো সংকটকালে সংশ্নিষ্ট সব স্টেক হোল্ডারের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত গ্রহণের যে দক্ষতা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অব্যাহতভাবে দেখিয়ে চলেছেন, সে দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে আমাদের শিক্ষার দুই মন্ত্রণালয় শিক্ষা ও প্রাথমিক ও গণশিক্ষা- পদক্ষেপ নেবে এটাই প্রত্যাশিত। আমি আশাবাদী প্রতিকূল পরিবেশেও পেশাগত দক্ষতা উন্নয়ন ও নেতৃত্ব বিকাশে বাংলাদেশের শিক্ষক সমাজ পিছপা হবেন না।
বিশ্ব শিক্ষক দিবস জাতীয় উদযাপন কমিটির সমন্বয়ক ও জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ প্রণয়ন কমিটির সদস্য
[email protected]
- বিষয় :
- বিশ্ব শিক্ষক দিবস
- কাজী ফারুক আহমেদ