শুভ জন্মদিন
তার মাটির ঘরে জনতার পদচিহ্ন আছে

ফজলুল হক
প্রকাশ: ০৬ অক্টোবর ২০২০ | ১২:০০
যে সময় পেরিয়ে যাচ্ছি এখন। তথ্যের চমকপ্রদ বিস্টেম্ফারণে হারিয়ে যাচ্ছে বিস্ময়, পরম্পরাবোধ, গভীরতার তৃষ্ণা। মেঘ না চাইতে জল নয় শুধু, বর্ষা নেমে আসছে। তাতে জিজ্ঞাসা নেই, জিজ্ঞাসা নির্মাণের অধ্যবসায় নেই। আধুনিকোত্তর কৃষ্ণ বিবরে নিজেদের মিলিয়ে দেওয়ার জন্য আত্মহননের বৌদ্ধিক মাদকে আচ্ছন্ন হওয়া আছে বরং বিশ্বায়ন সব শিকড়বাকড় উপড়ে ফেলছে বেপরোয়া আগ্রাসনে, উন্মাদের পাঠক্রম রচিত হচ্ছে সর্বত্র। আমাদের স্মৃতি নেই, দায়বোধ নেই। পৌরসমাজের ওপর এমনভাবে আক্রমণ নেমে এসেছে যে আমাদের চিরায়ত ইতিহাস-শিক্ষা-সংস্কৃতি দিয়ে গড়া স্বাতন্ত্র্যের সৌন্দর্যটুকুও মুছে যাচ্ছে।
অথচ কত বিচিত্রভাবে দেখা যায় জীবনকে, তৈরি করা যায় মনন ও কল্পনার কত অজস্র সৃজনমেদুর পরাপৃথিবী। আজ এই করোনাদগ্ধ মহামারি ও সভ্যতার বিধ্বস্ত পোড়োবাড়িতেও সবুজ ফলানো যায়। পৃথিবীতে করোনার মতো বহুবিধ প্রাকৃতিক বিপর্যয় যতবারই এসেছে, মানুষ তা মোকাবিলা করেই এগিয়ে এসেছে, এগিয়ে নিয়ে চলেছে সভ্যতার দীপশিখা। এসব আত্মপ্রতারক, সমঝোতা-প্রবণতার দুঃসহ ঘোর কেটে যাবে এক দিন। নেতি ও নৈরাজ্যের বিশ্বায়ন যত উৎকট হোক, নবায়মান সৃজনচর্যাই হবে আমাদের পথ ও পাথেয়।
কবিতা, এই সৃজন পৃথিবীর একমাত্র বিশল্যকরণী। মানবিক নির্মাণ পর্বের অনুভব-স্থাপত্য। মননবিশ্ব ও বিশ্বাসের ত্রিপাদভূমি। বিবেচনা করি, কবিতা আসলে সংবেদন ও মননের সেই সংশ্নেষণ,যা জীবনের নিখিল রেখামালাকে স্পর্শ করতে চায়।
হেলাল হাফিজ কবিতার এই ত্রিপাদ মোহানায় এক নির্জন এককের কবি। তার কবিতা কেবল জনপ্রিয়ই নয়, সর্বজনপ্রিয়। সমকালীন বাংলাদেশের কবিতায় তিনি তুলনারহিত এবং আমাদের কবিতা সাধনায় রয়েছে তার অর্জিত সফলতা।
কবিতা কার জন্য? এমন প্রশ্নের জবাবে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় জানান, 'কবিতা দুর্বোধ্য হবেই। আমি সব জায়গাতেই বলি, সকলের কবিতা পড়ার দরকার নেই। কারণ, কবিতাকে যদি একটা সূক্ষ্ণ শিল্প হিসেবে রাখতে হয়, তার বিশুদ্ধতা রক্ষা করতে হয়, তাহলে যারা দীক্ষিত পাঠক তারাই কবিতা পড়বে। সকলের জন্য লিখতে হলে কবিতাকে সরল করতে হবে। জল মেশাতে হবে। সুতরাং আমি বলব যে, একশ্রেণির পাঠক যাদের আগ্রহ আছে কবিতার বিষয়ে, তারাই পড়ূক। যদি কেউ একটা পাতা উল্টে বলে দুর্বোধ্য, আমি তাদের বলব, তোমাদের কবিতা পড়ার দরকার নেই। গল্প, উপন্যাস পড়ো কিংবা সিনেমার ম্যাগাজিন পড়ো। তোমার জন্য কবিতা লেখা হবে না। কবিতা তার জন্যই লেখা হবে যে রবীন্দ্রনাথ পড়েছে, জীবনানন্দ পড়েছে, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায় পড়েছে।'
(কবিতা কার জন্য? সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়।। পরম্পরা, কলকাতা-১২)
হেলাল হাফিজ কবি ও কবিতার এই তর্জনী নির্দেশনা ডিঙিয়ে তার কবিতাকে নিয়ে গেছেন সর্বসাধারণের কাছে। কবিতা ও নন্দনের প্রথাগত মিথকে ভেঙেছেন নিজস্ব নিয়মে। বাংলাদেশের জন থেকে সর্বজন সকলেই আনন্দের সঙ্গে ভক্তিভরে গ্রহণ করেছেন। তার আপাত সরল কাব্যভাষার ধ্রুপদি কবিতা। সুনীল কথিত সকলের উপযোগী সরল কবিতা লিখে অতুলনীয় সমাদর ও সফলতা তাকে বাংলাদেশের সমকালীন কবিতায় সর্বজনপ্রিয় কবি হিসেবে হিরণ্ময় নিয়তির অধিকারী করেছে।
একটি একক কাব্যগ্রন্থ 'যে জলে আগুন জ্বলে'র ২৮তম বৈধ সংস্করণ ও পুনর্মুদ্রণ পাঠক-দ্রষ্টাকে জানিয়ে দেয় তার কবিতার নিয়তি। দুই বাংলায় কবিতা বইয়ের প্রিয়-অপ্রিয়তার ইতিহাসে এ এক বিরল ঘটনা। হেলাল হাফিজের জীবন ও কবিতা নিয়ে অনেকানেক আলোচনা-সমালোচনা চর্চাচিন্তা বিস্তর। বড় বড় বইও আছে। এ নিয়ে এ পরিসরে আলোচনা ও উদ্ৃব্দতি অবান্তর। তবুও আলাদা করে বলা দরকার, ... তার মাটির ঘরে জনতার পদচিহ্ন আছে। কবিতায় প্রাণের যোগ আছে, আছে লোকধর্ম ও সংস্কৃতি। বাংলাদেশের সমাজ, রাজনীতি, যুদ্ধ, বিদ্রোহ, ঘাত-সংঘাত, আশা-নিরাশা, আনন্দ-বেদনা, প্রেম-বিরহ, এসবের এক মহাপৃথিবীর মোহানা হেলাল হাফিজের কবিতা। তার কবিতা কঠিন নয়, তাকে জানতে হয় না। সে নিজেই নিজেকে জানিয়ে যায়। হলুদ শস্যের ক্ষেতে করতল পেতে দাঁড়ালে তাই, 'পূর্ণ হয়ে যায় তার শূন্য করতল'। এই পূর্ণতাই একজন কবির নির্জন নিয়তি।
আজ কবি হেলাল হাফিজের শুভ জন্মদিন।
পাঁচ দশকের কবিতা যাপনের গোধূলি পর্বে এসে আজ তার দিকে তাকিয়ে আমাদের বিস্ময়ের সীমা নেই। আমরা যারা তার চার দশকের সহযাত্রী তাদের কাছে তিনি আরও বড় বিস্ময়। এত অল্প লিখেও তিনি আজ বাংলাদেশের কবিতার এক বিস্ময় ও গল্প। এ মুগ্ধতা সহসা শেষ হয় না। পথে যেতে যেতে তার কবিতার দিকে নিরন্তর তাকিয়ে থাকি আর মনে মনে ভাবি, হেলাল হাফিজের কবিতাগুচ্ছ ...
তারা কি একা একা জলের মতো বলছে, এক দিন সময়ের বালু পলিতে মিলিয়ে যাবে বলে, এই সামান্য নিবেদন। অন্তহীন নির্লিপ্তি নিয়ে এই যে তাকিয়ে থাকা। বাংলার সবুজ-শ্যামল প্রকৃতি, জীবন ও ইতিহাসের জল-জঙ্গল পেরিয়ে পর্ব-পর্বান্তর। ছায়া যেভাবে তাকিয়ে থাকে জমির দিকে, তেমনই নিরন্তর জেগে থাকা। এটুকুই হেলাল হাফিজের সম্বল তার জীবন ও কবিতার পঙ্ক্তিমালায়। আমাদের কবিতায় কিছু প্রত্যাশাহীন ও সার্থক মৌন শব্দলিপি ফিরে আসে অবিরাম, 'যে জলে আগুন জ্বলে'। জন্মদিনে প্রণতি জানাই, হে বন্ধু হে প্রিয়...।
কবি
অথচ কত বিচিত্রভাবে দেখা যায় জীবনকে, তৈরি করা যায় মনন ও কল্পনার কত অজস্র সৃজনমেদুর পরাপৃথিবী। আজ এই করোনাদগ্ধ মহামারি ও সভ্যতার বিধ্বস্ত পোড়োবাড়িতেও সবুজ ফলানো যায়। পৃথিবীতে করোনার মতো বহুবিধ প্রাকৃতিক বিপর্যয় যতবারই এসেছে, মানুষ তা মোকাবিলা করেই এগিয়ে এসেছে, এগিয়ে নিয়ে চলেছে সভ্যতার দীপশিখা। এসব আত্মপ্রতারক, সমঝোতা-প্রবণতার দুঃসহ ঘোর কেটে যাবে এক দিন। নেতি ও নৈরাজ্যের বিশ্বায়ন যত উৎকট হোক, নবায়মান সৃজনচর্যাই হবে আমাদের পথ ও পাথেয়।
কবিতা, এই সৃজন পৃথিবীর একমাত্র বিশল্যকরণী। মানবিক নির্মাণ পর্বের অনুভব-স্থাপত্য। মননবিশ্ব ও বিশ্বাসের ত্রিপাদভূমি। বিবেচনা করি, কবিতা আসলে সংবেদন ও মননের সেই সংশ্নেষণ,যা জীবনের নিখিল রেখামালাকে স্পর্শ করতে চায়।
হেলাল হাফিজ কবিতার এই ত্রিপাদ মোহানায় এক নির্জন এককের কবি। তার কবিতা কেবল জনপ্রিয়ই নয়, সর্বজনপ্রিয়। সমকালীন বাংলাদেশের কবিতায় তিনি তুলনারহিত এবং আমাদের কবিতা সাধনায় রয়েছে তার অর্জিত সফলতা।
কবিতা কার জন্য? এমন প্রশ্নের জবাবে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় জানান, 'কবিতা দুর্বোধ্য হবেই। আমি সব জায়গাতেই বলি, সকলের কবিতা পড়ার দরকার নেই। কারণ, কবিতাকে যদি একটা সূক্ষ্ণ শিল্প হিসেবে রাখতে হয়, তার বিশুদ্ধতা রক্ষা করতে হয়, তাহলে যারা দীক্ষিত পাঠক তারাই কবিতা পড়বে। সকলের জন্য লিখতে হলে কবিতাকে সরল করতে হবে। জল মেশাতে হবে। সুতরাং আমি বলব যে, একশ্রেণির পাঠক যাদের আগ্রহ আছে কবিতার বিষয়ে, তারাই পড়ূক। যদি কেউ একটা পাতা উল্টে বলে দুর্বোধ্য, আমি তাদের বলব, তোমাদের কবিতা পড়ার দরকার নেই। গল্প, উপন্যাস পড়ো কিংবা সিনেমার ম্যাগাজিন পড়ো। তোমার জন্য কবিতা লেখা হবে না। কবিতা তার জন্যই লেখা হবে যে রবীন্দ্রনাথ পড়েছে, জীবনানন্দ পড়েছে, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায় পড়েছে।'
(কবিতা কার জন্য? সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়।। পরম্পরা, কলকাতা-১২)
হেলাল হাফিজ কবি ও কবিতার এই তর্জনী নির্দেশনা ডিঙিয়ে তার কবিতাকে নিয়ে গেছেন সর্বসাধারণের কাছে। কবিতা ও নন্দনের প্রথাগত মিথকে ভেঙেছেন নিজস্ব নিয়মে। বাংলাদেশের জন থেকে সর্বজন সকলেই আনন্দের সঙ্গে ভক্তিভরে গ্রহণ করেছেন। তার আপাত সরল কাব্যভাষার ধ্রুপদি কবিতা। সুনীল কথিত সকলের উপযোগী সরল কবিতা লিখে অতুলনীয় সমাদর ও সফলতা তাকে বাংলাদেশের সমকালীন কবিতায় সর্বজনপ্রিয় কবি হিসেবে হিরণ্ময় নিয়তির অধিকারী করেছে।
একটি একক কাব্যগ্রন্থ 'যে জলে আগুন জ্বলে'র ২৮তম বৈধ সংস্করণ ও পুনর্মুদ্রণ পাঠক-দ্রষ্টাকে জানিয়ে দেয় তার কবিতার নিয়তি। দুই বাংলায় কবিতা বইয়ের প্রিয়-অপ্রিয়তার ইতিহাসে এ এক বিরল ঘটনা। হেলাল হাফিজের জীবন ও কবিতা নিয়ে অনেকানেক আলোচনা-সমালোচনা চর্চাচিন্তা বিস্তর। বড় বড় বইও আছে। এ নিয়ে এ পরিসরে আলোচনা ও উদ্ৃব্দতি অবান্তর। তবুও আলাদা করে বলা দরকার, ... তার মাটির ঘরে জনতার পদচিহ্ন আছে। কবিতায় প্রাণের যোগ আছে, আছে লোকধর্ম ও সংস্কৃতি। বাংলাদেশের সমাজ, রাজনীতি, যুদ্ধ, বিদ্রোহ, ঘাত-সংঘাত, আশা-নিরাশা, আনন্দ-বেদনা, প্রেম-বিরহ, এসবের এক মহাপৃথিবীর মোহানা হেলাল হাফিজের কবিতা। তার কবিতা কঠিন নয়, তাকে জানতে হয় না। সে নিজেই নিজেকে জানিয়ে যায়। হলুদ শস্যের ক্ষেতে করতল পেতে দাঁড়ালে তাই, 'পূর্ণ হয়ে যায় তার শূন্য করতল'। এই পূর্ণতাই একজন কবির নির্জন নিয়তি।
আজ কবি হেলাল হাফিজের শুভ জন্মদিন।
পাঁচ দশকের কবিতা যাপনের গোধূলি পর্বে এসে আজ তার দিকে তাকিয়ে আমাদের বিস্ময়ের সীমা নেই। আমরা যারা তার চার দশকের সহযাত্রী তাদের কাছে তিনি আরও বড় বিস্ময়। এত অল্প লিখেও তিনি আজ বাংলাদেশের কবিতার এক বিস্ময় ও গল্প। এ মুগ্ধতা সহসা শেষ হয় না। পথে যেতে যেতে তার কবিতার দিকে নিরন্তর তাকিয়ে থাকি আর মনে মনে ভাবি, হেলাল হাফিজের কবিতাগুচ্ছ ...
তারা কি একা একা জলের মতো বলছে, এক দিন সময়ের বালু পলিতে মিলিয়ে যাবে বলে, এই সামান্য নিবেদন। অন্তহীন নির্লিপ্তি নিয়ে এই যে তাকিয়ে থাকা। বাংলার সবুজ-শ্যামল প্রকৃতি, জীবন ও ইতিহাসের জল-জঙ্গল পেরিয়ে পর্ব-পর্বান্তর। ছায়া যেভাবে তাকিয়ে থাকে জমির দিকে, তেমনই নিরন্তর জেগে থাকা। এটুকুই হেলাল হাফিজের সম্বল তার জীবন ও কবিতার পঙ্ক্তিমালায়। আমাদের কবিতায় কিছু প্রত্যাশাহীন ও সার্থক মৌন শব্দলিপি ফিরে আসে অবিরাম, 'যে জলে আগুন জ্বলে'। জন্মদিনে প্রণতি জানাই, হে বন্ধু হে প্রিয়...।
কবি
- বিষয় :
- শুভ জন্মদিন