ঢাকা শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫

ইতিহাস

আমাদের কালের তিন নায়ক ও তাদের সংগ্রাম

আমাদের কালের তিন নায়ক ও তাদের সংগ্রাম

ইমতিয়ার শামীম

প্রকাশ: ২৩ নভেম্বর ২০২০ | ১২:০০ | আপডেট: ২৩ নভেম্বর ২০২০ | ১৫:৩৬

রাজনৈতিক উৎস কিংবা চলার পথ এক ছিল না আমাদের কালের সেই তিন নায়কের। কিন্তু কাকতালীয় ব্যাপার, ভিন্ন ভিন্ন বছরে হলেও তাদের মৃত্যু ঘটে ১০ নভেম্বর। মৃত্যুর মধ্য দিয়ে তারা এসে দাঁড়ান একই সমতলে, আর আমরা ইতিহাসের সেই প্রান্তরের দিকে তাকিয়ে অকস্মাৎ খুঁজে পাই তাদের অভিন্ন এক চেতনার জগৎ- যে চেতনা মানুষের মুক্তির জন্য নিজেকে উৎসর্গ করার; যে চেতনা স্বৈরশাসন ভেঙে গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম অব্যাহত রাখার; যে চেতনা শোষণমুক্ত সমাজের জন্য নিরন্তর পথ চলার। এভাবে ১০ নভেম্বর তারা তিনজন যেন বইয়ে দিয়ে গেছেন নানা পথে, নানা মতে চলমান মুক্তি-সংগ্রামের এক মহামিলনের স্রোত।

আমাদের কালের এই তিন নায়ক হলেন মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা, নূর হোসেন এবং আ ফ ম মাহবুবুল হক। মানুষের হৃদয়ের খুব কাছাকাছি ছিলেন তারা, হয়ে উঠেছিলেন স্বৈরশাসকদের ত্রাস এবং তিনজনের কেউই স্বাভাবিক মৃত্যুর স্বাদ পাননি। তাদের মধ্যে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমাকে মৃত্যুর স্বাদ নিতে হয়েছে ১৯৮৩ সালে আততায়ীদের হাতে। নূর হোসেনের জীবন কেড়ে নিয়েছে ১৯৮৭ সালে সামরিক জান্তা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের বাহিনী। আর আ ফ ম মাহবুবুল হককেও এক অর্থে হত্যাই করা হয়েছে; কেননা ২০০৪ সালে আততায়ী তার মাথায় আঘাত হানার পর বলতে গেলে সব কিছুই বিস্মৃত হন তিনি। ভালো করে চিনতে পারতেন না কাউকে, নিজের দলের নামটিও মনে ছিল না, তবু যারা তার সান্নিধ্যে যেতেন, তাদের উদ্দেশে বলতেন, 'বুর্জোয়া গণতন্ত্রে মুক্তি নেই'। ওই অবস্থার মধ্যেই তার মৃত্যু ঘটে ২০১৭ সালে। কিন্তু যেভাবেই মৃত্যু ঘটুক না কেন, মৃত্যুর মধ্য দিয়ে চিরভাস্বর হয়ে আছেন তারা।

কেন বলছি, চিরভাস্বর তারা? কেননা তাদের সেই সংগ্রাম অসমাপ্ত আর তারা সেই সংগ্রামের প্রতীক। মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার কথাই ধরা যাক। তিনি তো শুধু ভিন্ন জাতিসত্তার মুক্তি-সংগ্রামের বিবেচনায়ই নয়- বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কত দূর বিস্তৃত, তা বুঝবার জন্যও অপরিহার্য। জীবন তার কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। সংগ্রামের এক পর্বে সশস্ত্র সংগ্রামের পথে পা বাড়িয়েছিলেন বটে, কিন্তু সেই পথের দিকে তাকালেই উপলব্ধি করা যায়, কতটা অনন্যোপায় হতে হয়েছিল তাকে। ১৯৫৭ সালে অনুষ্ঠিত হয় প্রথম পাহাড়ি ছাত্র সম্মেলন- যার কেন্দ্রীয় উদ্যোক্তাদের মধ্যে তিনি একজন আর তার বয়স তখন মাত্র ১৭-১৮। নিজের এবং আরও সব জাতিসত্তার মুক্তির সংগ্রামের পথে হেঁটেছেন তিনি; ১৯৭০ সালে তিনি যখন পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হচ্ছেন, তখন বয়স মাত্র ত্রিশের মতো। রাজা ত্রিদিব রায়ের মতো এক কুমিরছানাকে দেখিয়ে আমাদের অনেকেই বারবার বলার চেষ্টা করেন, এসব 'আদিবাসী'র মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকাটি আসলে কেমন ছিল; অথচ এই কথাটি ভাবার চেষ্টা করি না, একটি বড় জাতি হিসেবে বাঙালি তার মুক্তি-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অধিকার প্রতিষ্ঠার যে ঢেউ সৃষ্টি করেছিল, তা স্পর্শ করেছিল কি সমতলের কি পাহাড়ের অন্য জাতিসত্তাগুলোকেও। তাদের প্রতিনিধিত্ব করার মতো বড় কোনো নেতা ছিলেন না, কিন্তু তারা বাঙালিদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধ ঠিকই করেছিলেন।

জাতিসত্তার অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা সব সময়েই চেয়েছেন গণতান্ত্রিক সংগ্রামের পথে হাঁটতে। দেশ স্বাধীন হলো, ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে তিনি আবারও সংসদ সদস্য নির্বাচিত হলেন এবং চাইলেন সাংবিধানিকভাবে নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে। এর আগেই ১৯৭২ সালের ২৫ অক্টোবর বাংলাদেশ গণপরিষদ অধিবেশনে সংবিধান বিতর্কে এক তাৎপর্যপূর্ণ ভাষণ দেন তিনি, বলেন, 'আমি ক্ষুদ্র মানুষ, সংসদীয় অভিজ্ঞতা আমার সেরকম নেই। তবু আমার বিবেক বলছে, এই সংবিধানের কোথায় যেন গলদ রয়েছে।' সেই গলদ দূর করতে, সংবিধানে সব জাতিসত্তার অধিকার নিশ্চিত করতে একাগ্র নিবেদিতপ্রাণ নিয়ে এগিয়েছেন এম এন লারমা, পাবর্ত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি গঠন করেছেন, ১৯৭২ সালের ৩১ অক্টোবর গণপরিষদ অধিবেশন বর্জন করেছেন; আবার দেখি বাকশালেও যোগ দিয়েছেন; যে পরিস্থিতিতে, যেভাবেই হোক না কেন, এসব সিদ্ধান্তে এ ইঙ্গিতও মেলে, আলোচনার মধ্য দিয়েই পৌঁছতে চান তিনি ঈপ্সিত লক্ষ্যে। যদিও ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব হত্যার পর পরিস্থিতি আর স্বাভাবিক থাকেনি, জনসংহতি সমিতি কিংবা এম এন লারমাও থাকতে পারেননি আগের অবস্থানে। আত্মগোপন করতে হয়েছে তাকে এবং তার সহযোদ্ধাদের, পাহাড়ে সেনা নেমেছে এবং পাহাড় রক্তাক্ত হয়েছে। ঐক্যবদ্ধ পাহাড়িদের মধ্যে ভাঙন ধরানোর চেষ্টা অব্যাহত ছিল প্রথম থেকেই- ১৯৮৩ সালের ১০ নভেম্বর সেই চেষ্টায় খানিকটা হলেও সফলতা আসে, নিহত হন মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা। দৃশ্যত তা দলেরই বিভেদপন্থিদের হাতে বইকি; কিন্তু নেপথ্যের কাহিনি জানতে আমাদের হয়তো অপেক্ষা করতে হবে আরও বহুদিন।

মানবেন্দ্র লারমা নিহত হয়েছিলেন সামরিক জান্তা এরশাদের শাসনামলের প্রথম দিকে; অন্যদিকে নূর হোসেন নিহত হন এরশাদেরই শাসনামলের শেষ হওয়ার বছর তিনেক আগে একই দিনে। ১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর সচিবালয়ের অবরোধ কর্মসূচির সময় বুকে 'স্বৈরাচার নিপাত যাক' আর 'গণতন্ত্র মুক্তি পাক' লেখা শ্রমজীবী পরিবারের টগবগে তরুণ সন্তান নূর হোসেন শ্বেত সন্ত্রাসীদের টার্গেটে পড়ে যান। বুকে-পিঠে তিনি কথাগুলো লিখিয়ে নিয়েছিলেন মতিঝিলে বিসিআইসি ভবনের কাছের 'পপুলার আর্ট' নামের একটি কমার্শিয়াল আর্টের দোকান থেকে। সেখানে ব্যানার, সাইনবোর্ড এসব লিখতেন ইকরাম হোসেন। পরের দিন সচিবালয় অবরোধের কর্মসূচি আছে বলে ৯ নভেম্বর বিকেল ৫টাতেই দোকান বন্ধ করে বাসায় ফিরতে চেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু নূর হোসেন সাড়ে ৪টার দিকেই হাজির হয়েছিলেন সেখানে। খোঁচা খোঁচা দাড়ি মুখে, কিন্তু স্বপ্নিল চোখে আর্টিস্টকে তিনি বলেছিলেন, 'আজ আপনি এমন এক জায়গায় এমন এক জিনিস লিখবেন, যা জীবনেও লেখেন নাই।' বলতে বলতে ঝট করে খুলে ফেলেছিলেন গায়ের জামা। ইকরাম সব শুনে লিখতে রাজি হননি। সবচেয়ে বড় ভয় ছিল এই যে, তার বড় ভাই তখন এরশাদেরই চাপরাশি! এত বড় ঝুঁকি তিনি নেবেন কেমন করে! কিন্তু নাছোড়বান্দা নূর হোসেন তাকে বাধ্য করেছিলেন স্লোগান লিখে দিতে। তবে নূর হোসেন তাকে বলেছিলেন, খালি তিনি নন, তার মতো ১০০ জন একইভাবে রাজপথে নামবে। কিন্তু পরদিন রাজপথে ওইভাবে শুধু নূর হোসেনই নেমেছিলেন এবং মৃত্যুকে বরণ করেছিলেন। আজও নূর হোসেনই আমাদের বড় আশ্রয়- তিনি আমাদের বারবার মনে করিয়ে দেন, একদম অচেনা, সাধারণ, নিভৃত মানুষও একটি সময়ের পথদ্রষ্টা হয়ে উঠতে পারেন, প্রতীক হয়ে উঠতে পারেন কোনো সুদীর্ঘ আন্দোলনের।

আমাদের সময়ের এই তিন নায়কের মধ্যে আমার প্রথম পরিচয় মাহবুবুল হক নামটির সঙ্গে। কারণ মুক্তিযুদ্ধের সময় দেরাদুনে বিএলএফের প্রথম ব্যাচে প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন তিনি, আর একই ব্যাচে ছিলেন আমার সেজভাই ইফতেখার মবিন চৌধুরী পান্নাও। জীবৎকালেই বারবার মৃত্যুঞ্জয়ী হয়েছেন মেধাবী মাহবুব- যিনি এসএসসিতে ছিলেন মেধাতালিকায় চতুর্থ স্থানে, এইচএসসিতে ছিলেন একাদশ স্থানে। সবাই ভেবেছিল, তিনি হবেন মেধাবী এক অর্থনীতিবিদ- কিন্তু তিনিই কিনা সব মোহ ত্যাগ করে দাঁড়িয়েছিলেন গণমানুষের সারিতে। মুক্তিযুদ্ধের আগে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এনএসএফ আর ইসলামী ছাত্র সংঘের সন্ত্রাস প্রতিরোধের মধ্য দিয়ে আলোচনার পাদপ্রদীপে উঠে আসেন। মুক্তিযুদ্ধ-উত্তর সময়ে একাধিকবার নির্যাতন, এমনকি গুলিবর্ষণ করেও তাকে হত্যা করা যায়নি। বলা হতো তার রয়েছে 'বিলাইয়ের হাড্ডি'।

মানুষের মনে কতটুকু জায়গা করে নিয়েছিলেন মাহবুবুল হক? দু-একটি ঘটনা বলি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে ভর্তির জন্য মনোনীত হয়েছিলেন সদ্য এইচএসসি উত্তীর্ণ হুমায়ুন ফরীদি। তারপর সংগঠনের অফিসে সবার সঙ্গে দেখা করতে গেলে মাহবুবুল হক তাকে বলেছিলেন, সবাই যদি ঢাকায় আসে, তা হলে এলাকার কী হবে? ফরীদি এ কথার উত্তর দিয়েছিলেন চাঁদপুরে ফিরে গিয়ে সেখানকার কলেজে বিএসসিতে ভর্তি হয়ে। বিএসসি পরীক্ষা দেওয়ার পর এসে ভর্তি হয়েছিলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। একুশে পদকপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক মইনুল হোসেন লিখেছেন, '... তিনিই (মাহবুব) আমার একমাত্র নেতা, যাঁকে আমি নির্দি্বধায় অনুসরণ করেছি ছাত্রজীবনে।' কী জনপ্রিয় ছিলেন মাহবুবুল হক, তার প্রমাণ ১৯৭৩ সালের ডাকসু নির্বাচন। বিজয়ী হিসেবে ঘোষিত হতে পারেননি, কিন্তু ইতিহাসবিদরা তো এই সত্যকে অস্বীকার করতে পারবেন না, ডাকসুর ইতিহাসে একজন অঘোষিত কিন্তু নির্বাচিত ভিপি রয়েছেন- তিনি মাহবুবুল হক।

তবে মাহবুবুল হক বারবার ঘুরে দাঁড়িয়েছেন, পথ চলার জন্য এগিয়েছেন। যুদ্ধাপরাধীর বিচার, তেল-গ্যাস-প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষার সংগ্রাম, গণমানুষের নিত্যদিনের সংগ্রাম- সবখানে ছিলেন তিনি। তবে ২০০৪ সালের ২৫ অক্টোবর তার জগৎকে পাল্টে দেয়। সন্ধ্যায় তিনি হাঁটতে বেরিয়েছিলেন, আততায়ীরা তাকে পেছন থেকে আঘাত করে। যারা তাকে আঘাত করেছিল, তারা মাহবুবের পকেটে থাকা টাকা নেয়নি, শুধু আঘাতই করেছে; বোঝা যায়, সেটি ছিল পরিকল্পিত আক্রমণই। দীর্ঘ চিকিৎসা ও শুশ্রূষায় তিনি খানিকটা সুস্থ হয়ে উঠলেও স্মৃতিশক্তি লোপ পায় তার। স্মৃতিশক্তি লোপ পেলেও তার প্রত্যাশা ছিল চিরজাগরূক- যার সঙ্গে কথা হতো, তাকেই বলতেন, 'বুর্জোয়া গণতন্ত্রে মুক্তি নেই; সমাজতন্ত্রই মুক্তির পথ'; বলতেন, 'আমি তো ভালোই আছি, তবে দেশের জন্য অনেক কাজ করা এখনও বাকি।' এ রকম স্মৃতি-বিস্মৃতির মধ্য দিয়েই না ফেরার দেশে চলে যান তিনি ২০১৭ সালের ১০ নভেম্বরে।

প্রতি বছর ১০ নভেম্বর আসে, আমাদের কালের এই নায়কেরাও ফিরে আসেন। আমাদের মনে করিয়ে দেন, একাগ্রতার বিকল্প নেই, আদর্শের মৃত্যু নেই আর মানুষের জীবনের সবচেয়ে সুন্দরতম লক্ষ্য হলো একলব্য হওয়া, সংশপ্তক হওয়া।

লেখক ও সাংবাদিক

আরও পড়ুন

×