নদী সুরক্ষা
দখলমুক্তিই শেষ কথা নয়

সম্পাদকীয়
প্রকাশ: ১৯ ডিসেম্বর ২০২০ | ১২:০০ | আপডেট: ১৯ ডিসেম্বর ২০২০ | ১৬:০৩
দেশে প্রবাহিত চার শতাধিক নদনদী দখলে জড়িত কমবেশি অর্ধলাখ ব্যক্তির যে তালিকা জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন জনপরিসরে প্রকাশ এবং সরকারের কাছে উপস্থাপন করেছে- সেখানে কারা আছে এই প্রশ্ন অবান্তর। বরং প্রশ্ন করা যেতে পারে যে, কারা নেই? শনিবার সমকালে প্রকাশিত এক শীর্ষ প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে প্রভাবশালীরা ছাড়াও জনপ্রতিনিধি ও আমলারাও জড়িত নদী দখলের সঙ্গে। আমরা জানি, নদী সুরক্ষার প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে এভাবে তালিকা প্রকাশের গুরুত্ব অপরিসীম। বস্তুত এই সম্পাদকীয় স্তম্ভে আমরা অনেক দিন ধরেই এই পরামর্শ দিয়ে আসছিলাম। এভাবে জনসমক্ষে তালিকা প্রকাশ হলে এর যে 'সামাজিক চাপ' তৈরি হয়- তাতে আর কিছু না হোক, দখলদারের অন্তত 'চক্ষুলজ্জা' হওয়ার কথা। কিন্তু এ কথাও সত্য যে, চোরে না শোনে ধর্মের কাহিনি। তালিকাটি এমন সময় প্রকাশ হয়েছিল, যখন ঢাকা ও চট্টগ্রামের মতো নগরসংলগ্ন নদীগুলোতে দখল উচ্ছেদ অভিযানও চলছিল। অতীতের মতো স্থানবিশেষে নয়, বরং নদীর সমান্তরালে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালিত হওয়ায় আমরা প্রত্যাশা করেছিলাম, এবারের উদ্ধারপর্ব টেকসই হবে। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে, অনেক এলাকাই পুনর্দখল হয়ে গেছে। ফলে সমকালের আলোচ্য প্রতিবেদনের সঙ্গে প্রকাশিত পরিবেশকর্মী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের এই বক্তব্য যথার্থ যে, দখলমুক্তির পর উদ্ধারকৃত জায়গা সংরক্ষণেও সমান মনোযোগী হতে হবে। অস্বীকার করা যাবে না যে, নগরসংশ্নিষ্ট নদীগুলো দখলদারদের হাত থেকে উদ্ধার সহজ নয়। তাদের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতা ছাড়াও দীর্ঘদিনের ঔদাসীন্যে তৈরি হয়েছে নানা আইনি জটিলতাও। দখলকৃত অনেক এলাকায় কেবল স্থাপনাই তৈরি হয়নি; সেগুলোর 'বৈধ' দলিলপত্রও অনুমোদন করেছে খোদ সরকারের ভূমিবিষয়ক সংস্থাগুলো।
মালিকানাও একাধিকবার হাতবদল হয়েছে। পাশাপশি এই বিপুল এলাকায় ভাঙচুর ও উচ্ছেদ অভিযানের অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রতিক্রিয়াও মনে রাখতে হয়। তারপরও কঠিনেরে ভালোবাসার বিকল্প নেই। যে কোনো মূল্যে দখল উচ্ছেদ করতেই হবে। একই সঙ্গে মনে রাখতে হবে, নদীর দখলমুক্তিই শেষ কথা নয়। দখলমুক্তির মাধ্যমে নদীকে দৈহিকভাবে উদ্ধারের পাশাপাশি দূষণমুক্তির মাধ্যমে জৈবিকভাবেও উদ্ধার করতে হবে। আমাদের স্বচ্ছতোয়া নদীগুলো ক্রমেই সুপেয় পানি, সেচকাজ, গৃহস্থালি ব্যবহার অযোগ্য হয়ে পড়ছে। বিনষ্ট হচ্ছে মৎস্যসম্পদ, নদী তীরবর্তী অঞ্চলগুলোতে ছড়িয়ে পড়ছে রোগব্যাধি। নির্মম পরিহাসের বিষয়, যে শিল্পদূষণে নদনদীর পানি ও জীববৈচিত্র্য বিনষ্ট হচ্ছে, সেই প্রবাহ শিল্প উৎপাদনের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। নদীর পানি দূষিত হওয়ায় তা শিল্পের জন্যও ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়ছে। ফলে চাপ বাড়ছে ভূগর্ভস্থ জলস্তরে। আর তার সুদূরপ্রসারী ক্ষতির কথা আমরা জানি। এমন পরিস্থিতিতে আমরা আশা করি, দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলোও দূষণবিরোধী আইন ও বিধির যথার্থ প্রয়োগে উদ্যোগী হবে। একই সঙ্গে আমাদের শিল্পপতিদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনাও জরুরি। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে শিল্প উদ্যোগের যে ভূমিকা, নদীদূষণ বন্ধের মাধ্যমে তা যে আরও গৌরবোজ্জ্বল হয়ে উঠতে পারে, তাদের বোঝাতে হবে। শিল্পদূষণের পাশাপাশি নাগরিকদূষণও বন্ধ করার বিকল্প নেই।
আমরা গভীর হতাশা ও উদ্বেগের সঙ্গে দেখি যে, প্রায় সব নগর ও শহরে পয়ঃনিস্কাশন ব্যবস্থায় পর্যাপ্ত শোধনাগার নেই। নাগরিক বর্জ্যের একটি বড় অংশ সরাসরি নদীতে ফেলা হয়। নগরের দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারি সংস্থাই যদি এভাবে নদীদূষণ করে, তারচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক আর কী হতে পারে? আমরা মনে করি, নদনদীর অন্যান্য সংকট মোচনেও এখনই নজর দিতে হবে। আমরা জানি, প্রাকৃতিক ভাঙন রোধে আগের তুলনায় মনোযোগ, বরাদ্দ, বাস্তবায়নে দক্ষতা ও নজরদারি বাড়লেও দেশের প্রায় সর্বত্র নির্বিচার বালু উত্তোলন মনুষ্যসৃষ্ট ভাঙনের ঝুঁকি আগের তুলনায় বাড়িয়ে দিয়েছে। ওদিকে ভারতের সঙ্গে অভিন্ন নদীগুলোতে বাংলাদেশের অধিকার প্রতিষ্ঠারও বিকল্প নেই। এখন সময় এসেছে নদী সংকটের সামগ্রিক সমাধানে উদ্যোগী হওয়ার। একটি সংকটে বেশি মনোযোগ দিয়ে অপরাপর সংকটে ঔদাসীন্য কাঙ্ক্ষিত সুফল নিয়ে আসবে না।
- বিষয় :
- নদী
- নদী সুরক্ষা
- দখলমুক্তি