ঢাকা শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫

পানি নিরাপত্তা

আমলার মামলা থেকে নদী হোক অংশীজনের

আমলার মামলা থেকে নদী হোক অংশীজনের

ড. মুহাম্মদ ইদ্রিস আলী

প্রকাশ: ০৩ জানুয়ারি ২০২১ | ১২:০০ | আপডেট: ০৩ জানুয়ারি ২০২১ | ১৫:০৪

সভ্যতার বিকাশ ও বিস্তৃতিতে অনন্যসাধারণ ভূমিকা পানির। পৃথিবীর তিন ভাগের দুই ভাগ পানি। পানির এ পরিমাণগত বিস্তৃতি ও প্রাচুর্যের কথা আমরা জন্মের পর থেকে শুনে আসছি। ভ্রূণাবস্থা থেকে জন্ম, তারপর বেড়ে ওঠা সব স্তরেই পানির প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। সেই কবে যে প্রথম পানির সঙ্গে আমাদের পরিচয়, তা মনে থাকার কথা নয়। কারণ, প্রত্যেক মানুষের সঙ্গে পানির পরিচয় খুব ছোটবেলা থেকেই।

পানি নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সংবেদনশীলতা দৃশ্যমান হয়েছে হাঙ্গেরির বুদাপেস্টে আন্তর্জাতিক পানি সম্মেলন থেকে। এই হাঙ্গেরিই ২০১৩ সালে পানি নিয়ে বিশ্ব সম্মেলন করে পানি সংকটের ক্রমবর্ধমান উদ্বেগের কথা জানান দিয়েছে বিশ্ব সম্প্রদায়ের কাছে। চলমান পরিবর্তিত সভ্যতার এ পৃথিবীতে প্রাকৃতিক যে সম্পদটির ওপর সবচেয়ে বেশি চাপ সৃষ্টি হয়েছে, তা নির্দি্বধায় পানি। খাদ্যের প্রয়োজনে কৃষিতে, শক্তির প্রয়োজনে বিদ্যুতে, শুদ্ধি-শুচির প্রয়োজনে পরিচ্ছন্নতায়, ব্যবসা-বাণিজ্যে, যোগাযোগের প্রয়োজনে যাতায়াতে, এমনকি বহুমাত্রিক জীবন অনুসন্ধানের তাগিদে জলধি, অন্তরীক্ষে পানি অপরিহার্য ও অপচয়ের উপাদান। পৃথিবীতে মিঠা পানি, বরফ পানি, হিমবাহ পানি, লোনা পানি, খনিজ পানি, অম্ল পানি, খর পানিসহ আঙ্গিক ও উৎস বৈচিত্র্য নিয়ে পানি বিরাজ করছে। আর বৈচিত্র্যপূর্ণ সবগুলো উৎসের পানিতে সংকোচনের প্রতিধ্বনি। সভ্যতার অভিযাত্রী মানুষ বিভিন্নভাবে জীবন ও সমাজকে সাজাতে বিভিন্ন পরিকল্পনা ও প্রক্রিয়া হাতে নিয়েছে।

পানি বিশ্বমানবতার অভিন্ন, সীমিত, অমূল্য সম্পদ। জীবন ও মানবতার প্রকাশ ও বিকাশের অন্যতম অনুষঙ্গ। পানি প্রাকৃতিক আন্তঃসীমান্ত সম্পদ। দেশে দেশে, মানুষে মানুষে, জীবনে জীবনে বৈষম্য সৃষ্টি করেছে পানি। দৃঢ়ভাবে মনে করা হয় পানি সংকট পানির দুষ্প্রাপ্যতার জন্য নয়, অপচয় ও অন্যায্য বণ্টনের জন্য। দেশে দেশে সুপ্ত বা ব্যক্ত অস্থিরতার কারণ অনেক সময়ই পানি। অনেক উত্তেজনা, অনেক অসহিষুষ্ণতার জন্ম দেয় পানি। অনেক অস্থিরতার স্রষ্টা পানি। পানি অন্যতম মানবাধিকারও বটে। ইউএন ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা-৬ আমাদের সর্বজনীন পানি নিরাপত্তা ও স্যানিটেশনের কথা বলে। নদীমাতৃক এই বাংলাদেশ ঋতুবৈচিত্র্যে পানিকেন্দ্রিক সংকটাপন্নতায় পতিত হয়, নিমজ্জিত হয়। বর্ষায় পানির আধিক্য, জলোচ্ছ্বাসে, বন্যা-প্লাবনে আক্রান্ত হয় দেশটি। আবার শীতের কুয়াশায়, চৈত্রের খরতাপে, খরায় পীড়িত হয় দেশটি। বিপদাপন্ন হয় দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী। বদলে যায় সংস্কৃতি, সামাজিকতা, আচার-বিচার। বদলে যায় মানুষের সামাজিক মন-মনন ক্রিয়াকলাপ।

দেশের প্রধান ২৩০টি নদীর ৫৭টির উৎস সীমান্তের বাইরের। এগুলো আন্তর্জাতিক নদী। এ নদীগুলোর প্রবাহে অর্থনীতির সম্পৃক্ততা, সামাজিকতার সংশ্নিষ্টতা অনেক বেশি। পৃথিবী যতই ছোট হয়ে আসছে, ততই নদী ও আন্তঃদেশীয় সংকটের দেয়াল দৃঢ় এবং প্রশস্ত হচ্ছে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী এ সম্মেলনে স্পষ্ট করে ব্যক্ত করেছিলেন, 'আমাদের সংস্কৃতি, ধ্যান-ধারণা ও জীবনযাত্রার প্রধান অংশ জুড়ে রয়েছে পানি। এটি অস্বীকার করার পথ নেই যে, পানির সুষম বণ্টনই আমাদের অনেক ভাবনাকে সুসমন্বিত, পারস্পরিক সহমর্মিতার চাদরে ঢেকে দিতে পারে। আমাদের নদনদীগুলো নাব্য হারাচ্ছে। বছরের বিভিন্ন সময় এরা প্রবাহের পানি পাচ্ছে না।' কোনোটার অঙ্গজুড়ে দস্যুতা, কোনোটার উজানে মমতা। আন্তঃসীমানার নদীগুলো তো আছেই, দেশীয় নদীগুলোকেও পরিচর্যায় আমাদের আন্তরিকতা, মনঃসংযোগের অপর্যাপ্ততা এবং অভাব দারুণভাবে দৃশ্যমান। দেশের নদী দখলদারদের তালিকা প্রণীত হয়েছে। এ তালিকায় রাজনীতিবিদ, সংসদ সদস্য, ব্যবসায়ী, আমলা প্রভৃতি সামাজিক স্তর নির্বিশেষ মানুষদের নাম উঠে এসেছে। সহস্রাব্দ উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা সফলভাবে অর্জন করেও সামাজিক অনেক সূচকে দেশ ও দেশের মানুষকে এগিয়ে নিয়েও কোথায় যেন চরম ও ব্যাপক ঘাটতিতে নিমজ্জিত আছি আমরা। অথচ টেকসই উন্নয়নসহ জাতীয়, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক পর্যায়ে এগিয়ে চলার সুসমন্বয় অনিবার্য ও অত্যাবশ্যক। এই এগিয়ে চলার প্রত্যয় পরিবেশ ও জীবনকে সচল, শুদ্ধ, জীবনাশ্রিত রাখতে পানি এ যাত্রার অবিচ্ছেদ্য, অপরিহার্য, অনিবার্য অঙ্গ-অনুষঙ্গ। বুদাপেস্ট সম্মেলনে আমাদের প্রধানমন্ত্রী সাত দফা সুপারিশমালা পেশ করেন।

দেশের নদীগুলোর যথাযথ সংস্কার ও খনন অপরিহার্য। আমলাতান্ত্রিকতার নিকৃষ্টতম জটিল জালে আবদ্ধ হয়ে আছে চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদী। দেশের প্রধান অর্থকরী নদী হয়েও কর্ণফুলীর বিলাপ আমলাদের কর্ণকুহরে পৌঁছাতে বারবার ব্যর্থ হচ্ছে। প্রধান অর্থকরী এ নদীকে বাদ দিয়ে দেশকে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নেওয়া যাবে না। কর্ণফুলীর শাখা নদীগুলোর অন্যতম প্রধান হালদা নদী। কার্পজাতীয় মাছের প্রাকৃতিক প্রজনন কেন্দ্র। একমুখী গবেষণা, সিন্ডিকেট গবেষণা, আমলাতান্ত্রিক গবেষণা, রাজনৈতিক গবেষণা পরিকল্পনা ও পরিচর্যা নদীটিকে বিভ্রান্ত করে চলেছে। কর্ণফুলীর আর্থিক রিটার্নকে আমলে নিতে হবে। এর প্রতি সর্বপ্রকার নির্লিপ্ততা পরিহার করতে হবে। এর প্রবাহের সকল ধরনের সংকট, সংশয় ও বাধা নির্মূল করতে হবে। নদীটিকে যেকোনো মূল্যে দূষণমুক্ত রাখার সর্বাত্মক প্রক্রিয়া গ্রহণ করতে হবে। দখলদারদের তালিকা নিশ্চিত ও চিহ্নিত করে তাদের কালগ্রাস থেকে নদীকে, নদীর স্বাস্থ্যকে উন্মুক্ত করতে হবে। জীবন্ত সত্তা এই নদীকে আদালতের নির্দেশনা মোতাবেক যথাযথ অভিভাবকত্ব দিতে হবে। নদীর আদালতে যাওয়া সভ্যতার জন্য, সমৃদ্ধির জন্য, মানবতার জন্য সুখকর নয়। আমলার মামলা থেকে নদীকে অংশীজনের, জনগণের নদীতে রূপান্তর করতে হবে। হাতুড়ে গবেষক, ইতিহাসবিদ, কৌশলী, ধূর্ত মানুষের হাত থেকে এ নদীকে মুক্তি দিতে হবে। নদীর মুক্তির মধ্য দিয়ে অর্থনীতি মুক্তি পাবে। সংস্কৃতি মুক্তি পাবে। সামাজিকতা মুক্তি পাবে। হাজার বছরের ইতিহাস উন্মুক্ত হবে। পানি পৃথিবীর জীবনের জন্য অপরিহার্য উপাদান। প্রয়োজনীয় পানি প্রাপ্তি, পানির উৎস, পানির জলাধার, বিল-হাওর সুরক্ষা সাংবিধানিক দায়িত্ব। সে দায়িত্ববোধের বিকাশই বিস্তৃত করতে হবে। পানি আজ মানবাধিকারের অন্যতম উপাদান। এ জন্যই পানির অপচয়, অসম বণ্টন, অব্যবস্থাপনা সমাজ থেকে, দেশ থেকে ও পৃথিবী থেকে নির্মূল করতে হবে।

মুক্তিযোদ্ধা; অধ্যাপক ও কর্ণফুলী গবেষক

আরও পড়ুন

×