ঢাকা শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫

পোশাক খাতে নিরাপত্তা, প্রতিকার ও পরিবেশগত উন্নয়ন

পোশাক খাতে নিরাপত্তা, প্রতিকার ও পরিবেশগত উন্নয়ন

ফাইল ছবি

আফসানা চৌধুরী, ফারিয়া আহমদ, ফাহিম এস. চৌধুরী, সাদরিল শাহজাহান

প্রকাশ: ১৬ জানুয়ারি ২০২১ | ১২:০০ | আপডেট: ১৬ জানুয়ারি ২০২১ | ১৫:৩১

তৈরি পোশাক খাত কয়েক দশক ধরেই দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে আসছে। রপ্তানি, বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন, কর্মসংস্থান, দারিদ্র্য কমানোর মাধ্যমে এই খাত দেশের উন্নয়নে ব্যাপক সহযোগিতা করে আসছে। বাংলাদেশ ক্রমান্বয়ে অন্যতম বৃহৎ রপ্তানিমুখী দেশে পরিণত হয়েছে। কিন্তু পোশাক খাতে দুটি বড় দুর্ঘটনা নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। একটি হলো ২০১২ সালের নভেম্বরে তাজরীন ফ্যাশনস লিমিটেডে অগ্নিকাণ্ড; অন্যটি ২০১৩ সালের এপ্রিলে সাভারের রানা প্লাজা ভবনধস।

বিশেষত রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর তৈরি পোশাক খাতের অগ্নি, স্থাপনা এবং বৈদ্যুতিক উন্নতিতে গুরুত্ব ও মনোযোগ দেওয়া হয়। পোশাক খাতকে নির্দিষ্ট কিছু নিরাপত্তা সংস্কার ও প্রতিকারের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। যদিও এর মাধ্যমে, এই খাতের উন্নতি এবং কারখানা মালিক ও বিশেষ করে শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের সুযোগ তৈরি হয়। মূলত, তখন থেকেই বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত বৈশ্বিক অনুবর্তিতা (কমপ্লায়েন্স) ও উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। অগ্নি, স্থাপনা ও বৈদ্যুতিক নিরাপত্তা পরিদর্শনে তিনটি উদ্যোগ গৃহীত হয়- অ্যাকর্ড, অ্যালায়েন্স এবং ন্যাশনাল ইনিশিয়েটিভ। এই তিন উদ্যোগের পক্ষে পরিদর্শনের ফলস্বরূপ কারখানার নিরাপত্তার জন্য বিভিন্ন সংস্কার পরিকল্পনা প্রণোদিত হয় এবং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কারখানাগুলো এই সময়-আবদ্ধ প্রতিকার ব্যবস্থা গ্রহণ করে। এসব উদ্যোগ পোশাক কারখানাগুলোর জন্য কিছু প্রাথমিক নীতিমালা ও বিধিবিধান করেছে যেগুলো নিশ্চিত করা কারখানাগুলোর জন্য অত্যাবশ্যকীয়।

যদিও এসব সংস্কার পরিকল্পনার উদ্যোগ থেকে পোশাক কারখানাগুলোর যথেষ্ট অগ্রগতি হয়েছে; অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র কারখানাগুলোর ক্ষেত্রে কিছু প্রতিবন্ধকতা বা চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এর অন্যতম অনুবর্তিতা বা কমপ্লায়েন্সের শর্ত পূরণে যে বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করতে হয় তার অক্ষমতা বা তহবিল সংকট।

২০১৬ সালে আইএলও এবং আইএফসি যৌথভাবে পরিচালিত এক জরিপে দেখা গেছে, কারখানা সংস্কারের কার্যক্রমগুলো আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের অনুরোধ এবং কারখানা ও ক্রেতাদের মাঝে সম্পর্ক দ্বারা প্রভাবিত। আরেকটি উপাদান হলো কারখানার আকার (শ্রমিক সংখ্যা ও কারখানার আর্থিক লেনদেনের পরিমাণ)। স্থানীয় ঋণ প্রদানকারী ব্যাংকগুলো, কারখানার ঋণ আবেদন অনুমোদন বা ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রেও কারখানার আকার গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করে। সেক্ষেত্রে অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্রতর কারখানাগুলোর জন্য সংস্কার অর্থায়নের ব্যবস্থা করা যথেষ্ট কষ্টকর। বিভিন্ন নিরাপত্তা উদ্যোগ ও পরিবেশ সংস্কার কর্মসূচির ক্ষেত্রে কারখানার সংস্কার পদ্ধতি ত্বরান্বিত করার বিষয়ে আর্থিক সহযোগিতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

এখন পর্যন্ত, কেবল তৈরি পোশাক খাতের সংস্কারের জন্য আলাদা কোনো আর্থিক অফার নেই, তাছাড়া ঋণ আবেদনের দীর্ঘ ও জটিল প্রক্রিয়া, উচ্চ ও অনাকর্ষণীয় সুদের হার, ঋণ আনুমোদন ও ঋণ প্রদানের দীর্ঘ সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া, ঋণ গ্রহণে কারখানাগুলোকে আকৃষ্ট করার ক্ষেত্রে তাই বেশিরভাগ ঋণ কার্যক্রমই ব্যর্থ হয়েছে। এছাড়া, এ সকল ঋণ কার্যক্রমে আবেদনের জন্য কারখানাগুলো ভালোভাবে প্রস্তুত বা যথেষ্ট সক্ষম নয়। ব্যাংকের কাছে যথাযথ, নির্ভরযোগ্য ও নিরীক্ষিত আর্থিক বিবৃতি উপস্থাপনের ক্ষেত্রেও কারখানাগুলোর ভুল ধারণা রয়েছে। ফলে দেখা যায়, অল্প কিছু কারখানা নিজেদের নিরাপত্তা পরিস্থিতি উন্নয়নের জন্য ঋণ গ্রহণে সক্ষম হয়।

এছাড়া স্থানীয়ভাবে সেবা প্রদানকারী কিছু সংস্থা রয়েছে, যারা কারখানার নিরাপত্তা সংস্কারের কার্যক্রমগুলোর শর্ত এবং পরিবেশ সম্পর্কিত সমর্থন উন্নয়নে নানা সেবা দিয়ে থাকে। কিন্তু এসব সেবা প্রায়োগিক বা প্রযুক্তিগত দিকেই সীমাবদ্ধ থাকে, ফলে আর্থিক ও হিসাবগত দিকগুলোতে কারখানাগুলো প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা পেতে ব্যর্থ হয়।

এসব বাস্তবতা বিবেচনা করে, জিআইজেডের সহায়তায় 'বাংলাদেশ তৈরি পোশাক খাতে নিরাপত্তা সংস্কার, প্রতিকার ও পরিবেশগত উন্নতিতে সমর্থন' শীর্ষক প্রকল্প অনুমোদন হয়। এর উদ্দেশ্য হলো- পোশাক খাতে প্রয়োজনীয় সংস্কার ও তা সম্পাদনে প্রাপ্য আর্থিক সেবা চিহ্নিতকরণের যে দূরত্ব তা ঘুচিয়ে দেওয়া। এ প্রকল্পের নেতৃত্বে রয়েছে অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও উন্নয়নবিষয়ক জার্মান কেন্দ্রীয় মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। দেশীয় সহযোগী অংশীদার হিসেবে রয়েছে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর এন্ট্রাপ্রেনারশিপ ডেভেলপমেন্ট (সিইডি)।

এ প্রকল্পের আওতায় বাংলাদেশি টাকায় বার্ষিক ৭ শতাংশ সুদের হারে ঋণ বিতরণ করা হবে। ঋণের সর্বাধিক পরিমাণ ৩ থেকে ৫ বছর মেয়াদসহ ১০ কোটি টাকা হবে। যথাযথ দলিল এবং পরিবেশগত উন্নয়নের যৌক্তিকতা বা অন্য কোনো যৌক্তিক ও দালিলিক ঘটনাসাপেক্ষে ঋণের পরিমাণ ৩০ কোটি টাকা পর্যন্ত হতে পারে এবং সেক্ষেত্রে ঋণের মেয়াদকাল ৭ বছর পর্যন্ত উন্নীত করা যাবে।

প্রকল্পের আওতায় তৈরি পোশাক কারখানাগুলো কর্মক্ষমতাভিত্তিক প্রণোদনাও পাবে, যার ফলে ঋণের মূল পরিমাণ কমে যাবে। এ প্রণোদনাগুলো হলো নিরাপত্তা সংস্কার বিনিয়োগ সম্পর্কিত মোট ঋণের পরিমাণের ১০ শতাংশ এবং পরিবেশ বা সামাজিক বিনিয়োগ সম্পর্কিত মোট পরিমাণের ২০ শতাংশ।

কারখানার নিরাপত্তা সংস্কার ও প্রতিকারে এবং সামাজিক ও পরিবেশগত উন্নয়নে বিনিয়োগ সহজতর করার পরিকল্পনায় যে প্রায়োগিক সহায়তা এবং সক্ষমতা তৈরির ব্যবস্থা দরকার তা নির্ধারণের সক্রিয় পরিবেশকে সমর্থন জোগাতেই এই প্রকল্পের প্রবর্তন। বেসরকারি ও আর্থিক খাতের সক্ষমতার বৈসাদৃশ্য নির্ণয়েও এ প্রকল্পটি কাজ করবে। প্রকল্পের অংশ হিসেবে, প্রকল্পের পক্ষ থেকে সিইডি, তৈরি পোশাক খাতের স্টেকহোল্ডারদের সক্ষমতা বাড়ানোর প্রশিক্ষণ দেবে।

লেখকবৃন্দ সিইডি, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত

আরও পড়ুন

×