চারদিক
মানুষের মনের ভেতরের মানুষ

মুজিবুর রহমান দিলু (১৯৫২-২০২১)
তুষার কান্তি সরকার
প্রকাশ: ২২ জানুয়ারি ২০২১ | ১২:০০ | আপডেট: ২২ জানুয়ারি ২০২১ | ১৩:৩১
১৯৯৬ সাল। আমি তখন জামালউদ্দিন হোসেনের নাগরিক নাট্যাঙ্গনে কাজ করি। শাহবাগের পরীবাগে কিছুদিন রিহার্সাল হলো। এরপর গ্রিন রোডে। আমার মতো অনেকে কাজ শেষে সন্ধ্যার পর এক হতো। রওশনারা হোসেন ভাবি, আবুল কাশেম ভাই, দিলু ভাই, তনিমা আহমেদ, পল্লব মাহমুদ ভাই, শরীফ ভাই, রিমু, নোরা, রুমা, তাপস দা, তপন ভাই, চঞ্চল সৈকত ভাই, হাসান ভাই, রবিবাবু ভাই, অপু শহীদ ভাই, শওকত ভাই, ডালিয়া আপু, কাজী প্যারিস, মুরাদ প্রমুখ মিলে জমে উঠত নাটকের মহড়া। আমরা তখন জার্মান নাট্যকার ব্রেশটের 'দ্য থ্রিপেনি অপেরা' অবলম্বনে জনতার রঙ্গশালা মহিলা সমিতিসহ বিভিন্ন মঞ্চে মঞ্চস্থ করছি। নাটকটি অনুবাদ করেছিলেন মুজিবুর রহমান দিলু।
পড়াশোনার পাশাপাশি আমি তখন নাগরিক নাট্যাঙ্গনে যাতায়াত শুরু করেছি। মুজিবুর রহমান দিলুর সঙ্গে আমার তখন থেকে পরিচয়। দিলু ভাইকে প্রথম দিন দেখেই আমার 'সংশপ্তক'-এর মালুর কথা মনে পড়ে। কী শক্তিশালী অভিনেতা! অভিনয়ের কী দম! কয়েক বাড়ি পেরিয়ে রাতের অন্ধকারে ছোটবেলা 'সংশপ্তক' দেখতে যেতাম। পরিবারের বাধা ছিল তুচ্ছ। সেখান থেকেই দিলু ভাই আমার মনের ভেতরে গেঁথে গেছেন। শুধু আমার কেন, দেশের অনেক মানুষের মনে স্থান করে নিয়েছিলেন দিলু ভাই মালুর চরিত্রে অভিনয় করে। আমি তখন মতিঝিলের আরামবাগে থাকি। চঞ্চল সৈকত ও হাসান ভাই দিলকুশায় সরকারি ব্যাংকে চাকরি করেন। তাদের সঙ্গে প্রায়ই দেখা করতে যেতাম। পাশেই একটি বেসরকারি ব্যাংকে চাকরি করতেন কাজী প্যারিস। ব্যাংকের ছুটি শেষে সবাই মিলে হানা দিতাম বিমান অফিসের পাশে অবস্থিত মুজিবুর রহমান দিলুর অফিসে। তখন তিনি নামকরা পূর্বাণী হোটেলের বড় কর্মকর্তা। আমরা নানা ধরনের খাবারে আপ্যায়িত হতাম সেখানে। চলত প্রাণখোলা বাঁধভাঙা আড্ডা। উঠে আসত ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার নানা চিত্র।
সৃষ্টিশীল এই মানুষটি হোটেল পূর্বাণীতে থাকা অবস্থায় শিশুদের জন্য 'টোনাটুনি' নামে একটি সংগঠন গড়ে তোলেন। সংগঠনটির সমন্বয়ক ছিলেন তিনি। শিশুদের নিয়ে আরও নানা রকম কাজ করেছেন। আশির দশকে ছোটদের জনপ্রিয় গল্প ও সংগীতের সমন্বয়ে শ্রুতি নাটক 'টোনাটুনি' প্রকল্পের নির্দেশক ছিলেন। শিশুদের জন্য টোনাটুনির প্রায় সব প্রযোজনা বলা যায় তার হাতেই হয়েছিল। ২০০৫ সালে নাটক নিয়ে ভারতে গিয়ে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। বন্ধুদের সহযোগিতা ও সরকারি অনুদানে ব্যয়বহুল চিকিৎসা শেষে আবার নাট্যাঙ্গনে ফিরে আসেন।
মুজিবুর রহমান দিলু ভাইকে আমরা দিলু ভাই বলে ডাকতাম। রিহার্সালে প্রায়ই তিনি রানী ভাবিকে সঙ্গে নিয়ে আসতেন। হাসিখুশি আর প্রাণবন্ত মানুষ ছিলেন। অহংকারবোধ ছিল না মোটেও। বিনয়ের সঙ্গে কথা বলতেন। সবার সঙ্গে বন্ধুর মতো ব্যবহার করতেন। মুখে হাসি লেগেই থাকত। ভুল করলে ঠান্ডা মাথায় শুধরে দিতেন। নাটকের চরিত্রগুলো কীভাবে আরও ভালো করা যায়, তা নিয়ে আলোচনা করতেন। আমার চোখে তার রাগান্বিত মুখের অভিব্যক্তি কোনোদিন ধরা পড়েনি। ১৯৭২ সালে তিনি বাংলাদেশ টেলিভিশনের তালিকাভুক্ত শিল্পী হন। ১৯৭৬ সাল থেকে টেলিভিশনে নিয়মিত অভিনয় শুরু করেন। অভিমান করে দীর্ঘ সময় অভিনয় থেকে নিজেকে দূরে রাখেন। মুজিবুর রহমান দিলুর উল্লেখযোগ্য মঞ্চনাটক হলো- 'আমি গাধা বলছি', 'নানা রঙ্গের দিনগুলি', 'জনতার রঙ্গশালা', 'নীল পানিয়া', 'আরেক ফাল্কগ্দুন', 'ওমা কী তামাশা' ইত্যাদি। বাংলাদেশ টেলিভিশনের জনপ্রিয় নাটক 'তথাপি', 'সময়-অসময়' ও 'সংশপ্তক'-এ অভিনয়ের মধ্য দিয়ে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেন।
মুজিবুর রহমান দিলু। দিলু ভাই বলেই আমরা তাকে ডাকতাম। তিনি আমাদের আপন মানুষ ছিলেন, কাছের মানুষ ছিলেন। তিনি ছিলেন নাট্য পরিচালক। ছিলেন একজন মুক্তিযোদ্ধা। ১৯ জানুয়ারি সকাল ৬টা ৪০ মিনিটে রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। আজ তার শারীরিক উপস্থিতি আমাদের মধ্যে নেই। কিন্তু তিনি মানুষের মনের ভেতর জায়গা করে নিয়েছেন। সাধারণ মানুষের মনে যার স্থান, তার কখনও মৃত্যু হয় না।
সম্পাদক, প্রকৃতিবার্তা
পড়াশোনার পাশাপাশি আমি তখন নাগরিক নাট্যাঙ্গনে যাতায়াত শুরু করেছি। মুজিবুর রহমান দিলুর সঙ্গে আমার তখন থেকে পরিচয়। দিলু ভাইকে প্রথম দিন দেখেই আমার 'সংশপ্তক'-এর মালুর কথা মনে পড়ে। কী শক্তিশালী অভিনেতা! অভিনয়ের কী দম! কয়েক বাড়ি পেরিয়ে রাতের অন্ধকারে ছোটবেলা 'সংশপ্তক' দেখতে যেতাম। পরিবারের বাধা ছিল তুচ্ছ। সেখান থেকেই দিলু ভাই আমার মনের ভেতরে গেঁথে গেছেন। শুধু আমার কেন, দেশের অনেক মানুষের মনে স্থান করে নিয়েছিলেন দিলু ভাই মালুর চরিত্রে অভিনয় করে। আমি তখন মতিঝিলের আরামবাগে থাকি। চঞ্চল সৈকত ও হাসান ভাই দিলকুশায় সরকারি ব্যাংকে চাকরি করেন। তাদের সঙ্গে প্রায়ই দেখা করতে যেতাম। পাশেই একটি বেসরকারি ব্যাংকে চাকরি করতেন কাজী প্যারিস। ব্যাংকের ছুটি শেষে সবাই মিলে হানা দিতাম বিমান অফিসের পাশে অবস্থিত মুজিবুর রহমান দিলুর অফিসে। তখন তিনি নামকরা পূর্বাণী হোটেলের বড় কর্মকর্তা। আমরা নানা ধরনের খাবারে আপ্যায়িত হতাম সেখানে। চলত প্রাণখোলা বাঁধভাঙা আড্ডা। উঠে আসত ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার নানা চিত্র।
সৃষ্টিশীল এই মানুষটি হোটেল পূর্বাণীতে থাকা অবস্থায় শিশুদের জন্য 'টোনাটুনি' নামে একটি সংগঠন গড়ে তোলেন। সংগঠনটির সমন্বয়ক ছিলেন তিনি। শিশুদের নিয়ে আরও নানা রকম কাজ করেছেন। আশির দশকে ছোটদের জনপ্রিয় গল্প ও সংগীতের সমন্বয়ে শ্রুতি নাটক 'টোনাটুনি' প্রকল্পের নির্দেশক ছিলেন। শিশুদের জন্য টোনাটুনির প্রায় সব প্রযোজনা বলা যায় তার হাতেই হয়েছিল। ২০০৫ সালে নাটক নিয়ে ভারতে গিয়ে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। বন্ধুদের সহযোগিতা ও সরকারি অনুদানে ব্যয়বহুল চিকিৎসা শেষে আবার নাট্যাঙ্গনে ফিরে আসেন।
মুজিবুর রহমান দিলু ভাইকে আমরা দিলু ভাই বলে ডাকতাম। রিহার্সালে প্রায়ই তিনি রানী ভাবিকে সঙ্গে নিয়ে আসতেন। হাসিখুশি আর প্রাণবন্ত মানুষ ছিলেন। অহংকারবোধ ছিল না মোটেও। বিনয়ের সঙ্গে কথা বলতেন। সবার সঙ্গে বন্ধুর মতো ব্যবহার করতেন। মুখে হাসি লেগেই থাকত। ভুল করলে ঠান্ডা মাথায় শুধরে দিতেন। নাটকের চরিত্রগুলো কীভাবে আরও ভালো করা যায়, তা নিয়ে আলোচনা করতেন। আমার চোখে তার রাগান্বিত মুখের অভিব্যক্তি কোনোদিন ধরা পড়েনি। ১৯৭২ সালে তিনি বাংলাদেশ টেলিভিশনের তালিকাভুক্ত শিল্পী হন। ১৯৭৬ সাল থেকে টেলিভিশনে নিয়মিত অভিনয় শুরু করেন। অভিমান করে দীর্ঘ সময় অভিনয় থেকে নিজেকে দূরে রাখেন। মুজিবুর রহমান দিলুর উল্লেখযোগ্য মঞ্চনাটক হলো- 'আমি গাধা বলছি', 'নানা রঙ্গের দিনগুলি', 'জনতার রঙ্গশালা', 'নীল পানিয়া', 'আরেক ফাল্কগ্দুন', 'ওমা কী তামাশা' ইত্যাদি। বাংলাদেশ টেলিভিশনের জনপ্রিয় নাটক 'তথাপি', 'সময়-অসময়' ও 'সংশপ্তক'-এ অভিনয়ের মধ্য দিয়ে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেন।
মুজিবুর রহমান দিলু। দিলু ভাই বলেই আমরা তাকে ডাকতাম। তিনি আমাদের আপন মানুষ ছিলেন, কাছের মানুষ ছিলেন। তিনি ছিলেন নাট্য পরিচালক। ছিলেন একজন মুক্তিযোদ্ধা। ১৯ জানুয়ারি সকাল ৬টা ৪০ মিনিটে রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। আজ তার শারীরিক উপস্থিতি আমাদের মধ্যে নেই। কিন্তু তিনি মানুষের মনের ভেতর জায়গা করে নিয়েছেন। সাধারণ মানুষের মনে যার স্থান, তার কখনও মৃত্যু হয় না।
সম্পাদক, প্রকৃতিবার্তা
- বিষয় :
- মানুষের মনের ভেতরের মানুষ