প্রান্তিক নারীদেরও এগিয়ে নিতে হবে

শাহীন আনাম
প্রকাশ: ০৭ মার্চ ২০২১ | ১২:০০ | আপডেট: ০৭ মার্চ ২০২১ | ১৪:৪৯
সারাবিশ্বের মতো করোনার ভয়াল থাবায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বাংলাদেশ। অনেক মানুষের মৃত্যু হয়েছে, জীবিকা হারিয়েছে অসংখ্য মানুষ। আর এই দুর্যোগে সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী হয়েছেন নারীরা। শুধু করোনা দুর্যোগেই নয়, যে কোনো দুর্যোগেই (প্রাকৃতিক বা মানবসৃষ্ট) নারীরা বেশি আক্রান্ত হন। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে করোনা দুর্যোগের মধ্যেও নারীরা হাল ছাড়েননি। সংসার দেখাশোনা, পরিবারের সদস্যদের যত্ন নেওয়াসহ সংসারে ও সমাজে নারীরা তাদের নেতৃত্ব বলবৎ রেখেছেন। কিন্তু তাদের সেই সক্রিয়তার কোনো মূল্যায়ন আমরা দেখি না। বরং করোনাকালে নারীর প্রতি বিভিন্ন ধরনের সহিংসতা-নির্যাতন বেড়েছে স্বাভাবিক সময়ের তুলনায়। আমাদের দেশে পারিবারিক নির্যাতনের হার এমনিতেই অনেক বেশি। এর মূল কারণ সমাজ ও সংসারে নারীর অবদানকে স্বীকৃতি না দেওয়া, পরিবারে নারীকে যথাযথ সম্মানের চোখে না দেখা।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার করোনা পরিস্থিতি অনেকাংশ নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়েছে, যা সারাবিশ্বেই প্রশংসিত হচ্ছে। আজ আন্তর্জাতিক নারী দিবস। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য 'নেতৃত্বে নারী :কভিড-পরবর্তী বিশ্বে সমতা অর্জিত হোক'। নারী দিবসের আগে আমরা একটি বড় সুসংবাদ পেয়েছি। কমনওয়েলথভুক্ত ৫৪টি দেশের সরকারপ্রধানদের মধ্যে কভিড-১৯ মহামারি মোকাবিলায় নেতৃত্ব দেওয়া শীর্ষ তিন অনুপ্রেরণীয় নারী নেতার তালিকায় রয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। নারী দিবসের আগে কমনওয়েলথের এ স্বীকৃতি আমাদের বেশ উচ্ছ্বসিত করেছে।
করোনাকালে নারী নির্যাতন বেড়ে যাওয়া ও ক্রমবর্ধমান বাল্যবিবাহ এবং অসংখ্য শিশু-কিশোরীর শিক্ষা লাভের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হওয়ার যে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে, তা বাংলাদেশের নারী শিক্ষা ও নারীর ক্ষমতায়নের ওপর দীর্ঘমেয়াদে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। বিগত সময়ে বিভিন্ন জরিপে উঠে এসেছে, মেয়েদের শিক্ষার ব্যাপ্তি দীর্ঘ হলে তাদের বিয়ের সময়টাও বেড়ে যায়। কিন্তু করোনাকালে এক বছর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার কারণে অনেক পরিবার তাদের কন্যাশিশু-কিশোরীদের আর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠাতে আগ্রহী হবে না। এই কিশোরীদের ঝরে পড়া ঠেকাতে সরকারকে পদক্ষেপ নিতে হবে। পরিবারগুলোকে সচেতন করতে হবে, প্রয়োজনে বড় আকারে প্রচারাভিযান চালাতে হবে।
করোনাকালে পরিবারে ও বাইরে নারী নির্যাতন বেড়েছে। শিশু থেকে শুরু করে সব বয়সের নারীরা সহিংসতার শিকার হচ্ছেন। নিয়মিতভাবেই ঘটে চলছে এ ধরনের নির্যাতন-সহিংসতার ঘটনা। আমরা তাদের নিরাপত্তা দিতে পারছি না। নারীর সুরক্ষায় আমাদের পদক্ষেপ নিতেই হবে। আমরা দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছি বিচারব্যবস্থা শক্তিশালী করার কথা। দ্রুত সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত করা জরুরি। কিন্তু আমরা দেখছি, এসব মামলায় সাজাপ্রাপ্ত আসামির সংখ্যা ৫ শতাংশেরও কম। বাকি ৯৫ শতাংশ আসামি কোনো না কোনোভাবে পার পেয়ে যাচ্ছে। বিচারব্যবস্থার এমন দুর্বলতার কারণে অপরাধ করার আগে অনেকেই মনে করে তারা পার পেয়ে যাবে। কারণ অপরাধ করে সাজা পাওয়ার চেয়ে খালাস পাওয়ার দৃষ্টান্তগুলো তারা বেশি প্রত্যক্ষ করে থাকে।
৩ মার্চ পুলিশপ্রধানের পক্ষে হাইকোর্টে দাখিল করা এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত ৫ বছরে দেশের বিভিন্ন থানায় ২৬ হাজার ৬৯৫টি ধর্ষণের মামলা হয়েছে। এ হিসাব ২০১৬ থেকে ২০২০ সালের অক্টোবর পর্যন্ত সময়ের। প্রতিবেদনের তথ্য অনুসারে, থানায় ধর্ষণের মামলা দায়েরের সংখ্যা বাড়ছে। যার মধ্যে গত দুই বছরে বেশি মামলা হয়েছে। এত মামলার তুলনায় রায়ের সংখ্যা খুবই নগণ্য। 'মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন' সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে ২৫টি ধর্ষণ মামলার বর্তমান অবস্থা তুলে ধরে। তাতে বলা হয়, ২৫টি মামলার আসামিদের মধ্যে ২০ জন জামিনে মুক্ত হয়েছে। দুর্বল তদন্ত প্রতিবেদন, আইন অনুযায়ী নির্ধারিত সময়ে প্রতিবেদন দাখিল না করা, সাক্ষীর অভাব, বাদীপক্ষকে ভয়ভীতি প্রদর্শন, আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে সমঝোতা, প্রভাবশালীদের ক্ষমতা প্রয়োগসহ নানা কারণে তারা জামিন পেয়ে যায়। অথচ ধর্ষণ অপরাধ জামিন অযোগ্য। সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে জবাবদিহির অভাব থাকায় কঠোর আইন থাকা সত্ত্বেও এরকম অপরাধকর্ম বাড়ছে। কাজেই এসব প্রতিষ্ঠানে জবাবদিহি নিশ্চিত করার পাশাপাশি কঠোর নজরদারি রাখা হলে বিচারের ক্ষেত্রে এই দূরত্ব কমে আসবে।
নারী নির্যাতন কিংবা ধর্ষণের মতো অপরাধের ক্ষেত্রে ঘটনার দায় চাপানো হয় ভুক্তভোগীর ওপর। কিছুদিন আগে রাজধানীর কলাবাগানে ধর্ষণের শিকার হয়ে মৃত্যুবরণ করা তরুণীর ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম দেখিনি। সমাজের অনেকেই প্রশ্ন তুলেছে, মেয়েটি সেখানে কেন গেল? হয়তো বন্ধুত্ব বা অন্য কোনো কাজে মেয়েটি সেখানে গিয়েছিল। তাই বলে ছেলেটি তাকে ধর্ষণ করবে? ছেলেটি কেন ধর্ষণ করল- সেই প্রশ্ন তারা এড়িয়ে যেতে চান।
নারীর প্রতি যাতে কোনো সহিংসতা বা নির্যাতনের ঘটনা না ঘটে সে জন্য আমাদের কিছু আগাম পদক্ষেপ বা কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা উচিত। আমরা জানি, নারী নির্যাতন একক কোনো কারণে ঘটে না। সমাজে নারীকে সম্মানের চোখে দেখা হয় না, দেখা হয় নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিতে। সামাজিক মাধ্যমে পর্নোগ্রাফির ছড়াছড়ি। ছেলেমেয়েদের জন্য সুস্থ যৌন শিক্ষার ব্যবস্থা এখনও করা যায়নি। বয়স বুঝে স্তরে স্তরে তাদের কম্প্রিহেনসিভ সেক্স এডুকেশন না দেওয়ায় তারা সেগুলো গ্রহণ করছে বিভিন্ন পর্নোসাইট থেকে। এ ছাড়া মাদকের বিস্তারও বেড়েছে আশঙ্কাজনক হারে। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যায়, ধর্ষণের অন্যতম প্রধান দুই কারণ হলো বিকৃত যৌন শিক্ষা ও মাদক সেবন। আমাদের দেশে অনেক শিশু বেড়ে ওঠে মা বা পরিবারের অন্য নারী সদস্যের ওপর নির্যাতন প্রত্যক্ষ করে। ফলে নারীর প্রতি সহিংসতা ও অসম্মান করার মানসিকতা তাদের শিশুকালেই তৈরি হয়। আমাদের সামাজিক বন্ধন আরও সুদৃঢ় করা দরকার। শুধু পুলিশ ও বিচারব্যবস্থা দিয়ে নারীর প্রতি সহিংসতা কমানো যাবে না। এর সঙ্গে দরকার সামাজিক আন্দোলন, যথাযথ শিক্ষা ও মূল্যবোধের চর্চা।
এতসব কিছুর মধ্যেও বলতে হয় বাংলাদেশের সেরা অর্জনগুলোর একটি হলো নারীর ক্ষমতায়ন। আমাদের নারীশিক্ষা বেড়েছে। প্রায় প্রত্যেকটি পেশায় নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হয়েছে। তবে সেটি হয়েছে কেবল একশ্রেণির নারীর মাধ্যমে। আমাদের দেশে নারীদের মধ্যে ধনী-গরিব-মধ্যবিত্ত, শহুরে-গ্রাম্য-উপজাতি-আদিবাসী, উচ্চশিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত-অশিক্ষিত, সুস্থ-প্রতিবন্ধীসহ নানা ধরনের বিভাজন দেখা যায়। তাদের মধ্যে শিক্ষিত নারীরা ক্ষমতায়নের একটি পর্যায়ে চলে গেছেন। কিন্তু প্রান্তিক ও অল্প শিক্ষিত নারীরা এখনও পিছিয়ে আছেন। পরিবারে তাদের অবদানের স্বীকৃতি যেমন নেই, তেমনি বাইরে কর্মসংস্থানেরও সুযোগ সীমিত। এই বৈষম্য যদি দূর করা না যায় তাহলে কিছু নারী হয়তো তাদের পেশা বা ক্ষমতায়নের জায়গায় চূড়ান্ত সাফল্য লাভ করবেন কিংবা সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করতে পারবেন। তবে নারীদের বিরাট একটি অংশ তথা প্রান্তিক নারী, দরিদ্র নারী, আদিবাসী নারী, প্রতিবন্ধী নারী পিছিয়ে পড়বেন। সবাইকে কীভাবে মূল স্রোতে শামিল করা যায় সেদিকে দৃষ্টি রাখা উচিত। এ ক্ষেত্রে সবার আগে বাল্যবিবাহ শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে হবে। পিছিয়ে পড়া নারীদের এগিয়ে নিতে সরকারকে বিশেষ ব্যবস্থা নিতে হবে। শিক্ষার পাশাপাশি দক্ষতা বৃদ্ধির ব্যবস্থা করে তাদের উপার্জনক্ষম করে তুলতে হবে। চাকরির পাশাপাশি তাদের উদ্যোক্তা হতে আগ্রহী করে তোলা এবং সে ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় ঋণ সুবিধা নিশ্চিত করা জরুরি। এর সঙ্গে নারীর কর্মস্থল নিরাপদ করতে হবে এবং সন্তানদের দেখাশোনার জন্য কর্মস্থলে ডে কেয়ার চালু করতে হবে।
নির্বাহী পরিচালক, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন
- বিষয় :
- শাহীন আনাম
- প্রান্তিক নারী