জন্মশতবর্ষ
সত্যজিতের সৃষ্টি: যে ঐশ্বর্য আলোকময়

ড. নাদির জুনাইদ
প্রকাশ: ২৯ এপ্রিল ২০২১ | ১২:০০
সত্যজিৎ রায় প্রথম বিদেশ গিয়েছিলেন তার প্রথম ছবি 'পথের পাঁচালী' (১৯৫৫) তৈরির কয়েক বছর আগে। লন্ডনসহ ইউরোপের আরও কয়েকটি স্থানে তিনি কাটিয়েছিলেন ছয় মাস। এই সময়ে সত্যজিৎ দেখেছিলেন মোট ৯৯টি চলচ্চিত্র। একদিন লন্ডনে মেফেয়ারের কার্জন সিনেমায় তিনি দেখেন ইতালির বিখ্যাত পরিচালক ভিত্তোরিও ডি সিকার অবিস্মরণীয় ছবি 'দ্য বাইসাইকেল থিফ' (১৯৪৮)। পরে সত্যিকারের অভিঘাত সত্যজিৎ অনুভব করেছিলেন নয়া-বাস্তববাদী ধারায় ডি সিকা নির্মিত এ ছবিটি দেখে। ভারতীয় ছবিতে তখনও অপেশাদার অভিনেতার ব্যবহার, লোকেশনে শুটিং, মেকআপ ব্যবহার না করা প্রভৃতি নয়া-বাস্তববাদী পদ্ধতি প্রয়োগের কথা পরিচালকরা চিন্তা করেননি। তা না করার কারণে ভারতীয় ছবির যে কৃত্রিম রূপ তৈরি হয়েছিল; প্রখর শিল্পবোধসম্পন্ন সত্যজিতের তা পছন্দ ছিল না। কিন্তু প্রথাবিরোধী ছবি নির্মাণ করা কখনোই সহজ নয়। নাচ-গান নেই, মারপিটের দৃশ্য নেই। নেই জনপ্রিয় কোনো ফিল্মস্টার। আছে ৮০ বছরের এক নারী; প্রেমের গল্পের পরিবর্তে দেখানো হয়েছে গ্রামের এক দরিদ্র পরিবারের বেদনার কাহিনি- 'পথের পাঁচালী'র এমন চিত্রনাট্য দেখে প্রযোজকরা টাকা দিতে চাননি। কিন্তু বাজারের চাহিদার কাছে নতি স্বীকার করে বিনোদনধর্মী উপাদান নিজের ছবিতে যুক্ত করেননি সত্যজিৎ।
'পথের পাঁচালী' নির্মাণকালে এমন সময়ও এসেছে, এক দিনের শুটিং করতে যে আড়াইশ টাকা দরকার, তাও সত্যজিতের ছিল না। তখন তার স্ত্রী বিজয়া রায়ের গহনা বন্ধক দিয়ে ১২শ টাকা জোগাড় করে তিন-চার দিন শুটিং করা সম্ভব হয়েছিল। তারপরই টাকার অভাবে আবার কাজ থেমে যায়। স্কুলে পড়ার সময় থেকেই সত্যজিৎ পাশ্চাত্যের ধ্রুপদি সংগীতের রেকর্ড সংগ্রহ করতেন। এমন কিছু রেকর্ড আর দুষ্প্রাপ্য বই বিক্রি করেও তিনি শুটিংয়ের টাকা সংগ্রহ করেছিলেন। নিজের সংগ্রহের প্রিয় সেই রেকর্ড আর বই পরবর্তী সময়ে তিনি আর উদ্ধার করতে পারেননি। ভারতীয় চলচ্চিত্রে যে গতানুগতিক পদ্ধতি তখন ব্যবহূত হতো, তা অন্তর্ভুক্ত করলে নিশ্চয়ই প্রযোজক পাওয়া সত্যজিতের জন্য কঠিন হতো না। কিন্তু ভারতীয় চলচ্চিত্রে কাহিনির উপস্থাপন এবং নির্মাণশৈলীতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে চেয়েছিলেন সত্যজিৎ। বিনোদননির্ভর উপাদানকে প্রাধান্য দেওয়ার মাধ্যমে দর্শককে আকৃষ্ট করে মুনাফা অর্জন করার মানসিকতা প্রকৃত শিল্পীর থাকে না। সত্যজিতেরও ছিল না। পরবর্তী সময়ে, পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী ডাক্তার বিধানচন্দ্র রায় কমিউনিটি ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্টের খাতে 'পথের পাঁচালী' নির্মাণের জন্য অর্থের ব্যবস্থা করে দিলে সত্যজিৎ রায় তৈরি করেন সম্পূর্ণ প্রথাবিরোধী এক চলচ্চিত্র। এই ছবির সঙ্গে ভারতে তখন পর্যন্ত তৈরি অন্য কোনো ছবির মিল ছিল না।
গ্রামীণ প্রকৃতির বিভিন্ন দৃশ্যের ব্যবহার; গ্রামবাংলার পরিবেশের সঙ্গে মানানসই আবহ সংগীত; ৮০ বছরের চুনিবালা দেবীর অভিনয়; অপেশাদার কিন্তু চরিত্রের জন্য খুবই উপযুক্ত অভিনেতা-অভিনেত্রী; নাটকীয়তার পরিবর্তে বাস্তবধর্মী অভিনয় ও সংলাপ; ক্যামেরা-ভাষার নান্দনিক প্রয়োগ প্রভৃতি কারণে সত্যজিতের প্রথম ছবির প্রতিটি দৃশ্যই হয়ে উঠেছিল শৈল্পিক। ডি সিকার ছবি যেমন সত্যজিতের মনে অভিঘাত তৈরি করেছিল; সত্যজিতের প্রথম ছবিও দেশ-বিদেশের দর্শকদের জন্য সম্পূর্ণ নতুন এক চলচ্চিত্র দেখার বিস্ময় সৃষ্টি করেছিল। গৎবাঁধা বিনোদনমূলক উপাদান নেই বলে যে ছবির প্রতি ভারতীয় প্রযোজকরা আগ্রহ দেখাননি; সেই ছবি যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত মিউজিয়াম অব মডার্ন আর্টে উদ্বোধনের পর আমেরিকার দর্শক ও সমালোচকদের প্রশংসা পায়। কলকাতায় বক্স অফিস হিট হয়। নিউইয়র্কের 'ফিফ্থ অ্যাভিনিউ প্লেহাউস'-এ টানা ৩৬ সপ্তাহ ধরে চলে, যা ছিল একটি রেকর্ড। বিখ্যাত কান ফিল্ম ফেস্টিভালে ছবিটি পায় 'বেস্ট হিউম্যান ডকুমেন্ট' হিসেবে স্পেশাল জুরি পুরস্কার। 'পথের পাঁচালী' নির্মাণের আগ পর্যন্ত ভারতীয় ছবিতে চলচ্চিত্র-ভাষার সৃজনশীল প্রয়োগ না থাকার কারণে বিশ্বের বিখ্যাত চলচ্চিত্রবোদ্ধারা ভারতীয় ছবিকে গুরুত্ব দেননি। সত্যজিৎ রায়ের চিন্তাঋদ্ধ এবং নান্দনিকভাবে নিরুপম চলচ্চিত্রের কারণে বাংলা ছবির মাধ্যমেই ভারতীয় ছবি চলচ্চিত্রের আন্তর্জাতিক পরিসরে সমালোচক ও দর্শকদের ভূয়সী প্রশংসা অর্জন করে।
১৯২১ সালের ২ মে কলকাতায় জন্মগ্রহণ করা মহান এই শিল্পীর জন্মশতবর্ষে তার কাজ এখনও প্রাসঙ্গিক। এখনও তার সৃষ্টির প্রতি দর্শক-পাঠকের মুগ্ধতা গভীর। আমার মনে পড়ে, ১৫-১৬ বছর আগে আমি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার ক্লাসে চলচ্চিত্রের মাধ্যমে কীভাবে অর্থ তৈরি হয়, তা বোঝানোর জন্য সত্যজিতের 'প্রতিদ্বন্দ্বী' (১৯৭০) ছবিটি দেখানোর পর আলোচনা করছিলাম, তখন একজন ছাত্র উঠে দাঁড়িয়ে আমাকে বলেছিল, 'স্যার, ছবিটি এতদিন আগে তৈরি- আমার তা মনে হচ্ছে না। বর্তমান সময়ে এই শহরে একজন চাকরিপ্রার্থী তরুণ যে হতাশার মুখোমুখি হয়; মনে হচ্ছে ছবিটি যেন সেই পরিস্থিতির বর্ণনাই তুলে ধরেছে।' সমাজে প্রকট হয়ে ওঠা নৈতিক অবক্ষয়ের বিবরণ তুলে ধরা সেই ছবিটি কি এখনও, নির্মাণের ৫১ বছর পরও প্রাসঙ্গিক নয়? একইভাবে 'দেবী' (১৯৬০) আর 'গণশত্রু' (১৯৮৯) ছবিতে ধর্মীয় অন্ধচিন্তা; 'সীমাবদ্ধ' (১৯৭১) আর 'শাখা-প্রশাখা'য় (১৯৯০) সমাজের বিত্তশালী মানুষদের দুর্নীতি; 'অরণ্যের দিনরাত্রি'তে (১৯৬৯) শহুরে তরুণদের অগভীর চিন্তা আর অনুভূতিহীনতা; 'হীরক রাজার দেশে' (১৯৮০) ছবিতে রাজনৈতিক অন্যায় আর অত্যাচার; 'শতরঞ্জ কি খিলাড়ী'তে (১৯৭৭) রাজনৈতিক সচেতনতার অভাব; 'জনঅরণ্য' (১৯৭৫) ছবিতে সমাজে নীতিহীনতার বিস্তার প্রভৃতি দিকের যে বিবরণ সত্যজিৎ তুলে ধরেছেন; সেই অনাকাঙ্ক্ষিত এবং অশুভ দিকগুলো কি বর্তমান সময়ে নেই? সত্যজিতের চলচ্চিত্রে কেবল কাব্যময়তাই ছিল না। একজন সমাজ-সচেতন শিল্পী হিসেবে বারবার তিনি সমাজের গুরুতর সমস্যাগুলোর মুখোমুখি হয়েছেন। সমসাময়িক চলচ্চিত্রকার মৃণাল সেনের মতো জটিল চলচ্চিত্র-কৌশল সত্যজিৎ বেশি ব্যবহার না করলেও তার চলচ্চিত্রে সুসংযত এবং শান্তভাবে তিনি বিভিন্ন সমস্যার যে তীব্র সমালোচনা তুলে ধরেছেন দর্শক-মনে, তার অভিঘাত ও প্রভাব গভীর।
কেবল গাম্ভীর্য সৃষ্টিতে পারদর্শিতা নয়; সত্যজিতের কৌতুকবোধও ছিল অসাধারণ। 'পরশ পাথর' (১৯৫৮), 'মহাপুরুষ' (১৯৬৫), 'গুপী গাইন বাঘা বাইন' (১৯৬৮), 'হীরক রাজার দেশে' প্রভৃতি ছবিতে তিনি হাস্যরস ব্যবহার করেছেন অনবদ্যভাবে। মনে পড়ে, 'মহাপুরুষ' ছবিতে সুবেশধারী শিক্ষিত মানুষরা মেঝেতে বসে মন্ত্রমুগ্ধের মতো প্রতিবাদহীনভাবে শুনছে বিরিঞ্চি বাবার করা মিথ্যাচার- তিনি নাকি কথা বলেছেন গ্রিক দার্শনিক প্লেটোর সঙ্গে; চোখের সামনে দেখেছেন যিশুকে ক্রুশবিদ্ধ করা হচ্ছে। 'শতরঞ্জ কি খিলাড়ী' ছবিতে দাবা খেলার নেশায় বুঁদ দুই ধনাঢ্য জমিদার মীর রোশন আলি আর মির্জা সাজ্জাদ আলি নিজেদের বাড়িতে দাবা খেলতে না পেরে তাদের পরিচিত এক উকিলের বাড়িতে গিয়েছেন সেই বাড়ির বৈঠকখানায় সাজানো দাবা সেট দিয়ে খেলার জন্য। উকিল সাহেব তার শয়নকক্ষে বেহুঁশ হয়ে পড়ে আছেন। তাকে দেখার জন্য চিকিৎসককে খবর দেওয়া হয়েছে; এসব কথা জানার পরও দুই জমিদার উকিল সাহেবের বৈঠকখানায় দাবা খেলা চালিয়ে যান। এই দৃশ্যগুলোতে কৌতুক আছে। কিন্তু দৃশ্যগুলোর মাধ্যমে পরিচালক প্রকাশ করেছেন মানুষের নির্বুদ্ধিতা আর বোধহীনতার তীক্ষষ্ট সমালোচনা।
রাশভারী সত্যজিৎ রায়ের কৌতুকের প্রতি আকর্ষণের ব্যাপারটি স্পষ্ট হয় তার সৃষ্ট দুই চরিত্র লালমোহন বাবু আর অবিনাশ বাবুর মাধ্যমে। তীক্ষষ্টধী গোয়েন্দা প্রদোষ চন্দ্র মিত্র (ফেলুদা) আর ধীদীপ্ত বৈজ্ঞানিক প্রফেসর ত্রিলোকেশ্বর শঙ্কুর ঘনিষ্ঠ বন্ধু লালমোহন বাবু আর অবিনাশ বাবু বিভিন্ন সময় বিপদ থেকে ফেলুদা আর প্রফেসর শঙ্কুকে রক্ষা করলেও তাদের অনেক মন্তব্য পড়েই পাঠক হেসে ওঠেন। পরিস্কার হয়ে ওঠে সত্যজিতের প্রখর রসবোধ। চলচ্চিত্র এবং সাহিত্যকর্মের মতো সত্যজিৎ-সৃষ্ট সম্পূর্ণ ভিন্ন মেজাজের সুরও দর্শককে বিমোহিত করে। রবিশংকর, ওস্তাদ বিলায়েৎ খান, ওস্তাদ আলি আকবর খানের মতো বরেণ্য সংগীতশিল্পীরা সত্যজিতের প্রথম কয়েকটি ছবির আবহ সংগীত রচনা করলেও 'তিন কন্যা' (১৯৬১) থেকে তার শেষ ছবি পর্যন্ত সত্যজিৎ নিজেই তার চলচ্চিত্রের আবহ সংগীত তৈরি করেছেন।
বিশ্ব-চলচ্চিত্রের একজন প্রথিতযশা চলচ্চিত্রকার হয়ে ওঠার পাশাপাশি সত্যজিৎ সৃষ্টি করেছেন বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন চিত্তাকর্ষক চরিত্র। রচনা করেছেন সংগীত, তার আঁকা ছবি তৈরি করেছে মুগ্ধতা। বহুমুখী প্রতিভাসম্পন্ন সত্যজিৎ রায় প্রকৃত অর্থেই একজন 'রেনেসাঁস ম্যান।' নিজের ছবিতে নান্দনিকভাবে নতুন চলচ্চিত্র-ভাষা এবং সামাজিক সচেতনতা অন্তর্ভুক্ত করার মাধ্যমে যিনি বাংলা চলচ্চিত্রকে যথাযথ একটি শিল্পমাধ্যমে পরিণত করেছিলেন, সেই গুণী শিল্পীর জন্মশতবর্ষে এই আশাই করি- তার দীপ্তোজ্জ্বল সৃষ্টি এবং দর্শনের মাধ্যমে সামনের দিনগুলোতেও জনমানস অনুপ্রাণিত ও সমৃদ্ধ হোক।
অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
- বিষয় :
- জন্মশতবর্ষ