ঢাকা শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫

একুশে গ্রন্থমেলা

বইয়ের সংখ্যা বেড়েছে, পাঠক বাড়ছে কি?

বইয়ের সংখ্যা বেড়েছে, পাঠক বাড়ছে কি?

রাজীব সরকার

প্রকাশ: ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২২ | ১২:০০ | আপডেট: ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২২ | ১৪:৩২

নানা অনিশ্চয়তার পর অমর একুশে গ্রন্থমেলা ১৫ ফেব্রুয়ারি শুরু হয়েছে। মহামারি করোনার থাবায় বিশ্বব্যাপী জীবনযাত্রা নানাভাবে বিঘ্নিত হয়েছে। বাংলাদেশেও এর ঢেউ এসে লেগেছে। ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প খাতসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ বিপুল অর্থনৈতিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন। এ নিয়ে গণমাধ্যমে বিস্তর আলোচনা হয়েছে। কিন্তু তুলনামূলক অনালোচিত রয়ে গেছে প্রকাশনা শিল্পের ক্ষতি। ২০২১ সালের বইমেলায় প্রকাশকরা বিপুল আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছিলেন। ২০২২ সালে এর পুনরাবৃত্তি ঘটবে না- এটিই কাম্য।

সুরসিক সাহিত্যিক প্রমথ চৌধুরী 'বই পড়া' প্রবন্ধে লিখেছিলেন, 'বই পড়া শখটা মানুষের সর্বশ্রেষ্ঠ শখ হলেও আমি কাউকে শখ হিসেবে বই পড়তে পরামর্শ দিতে চাই নে। প্রথমত, সে পরামর্শ কেউ গ্রাহ্য করবেন না। কেননা, আমরা জাত হিসেবে শৌখিন নই; দ্বিতীয়ত, অনেকে তা কুপরামর্শ মনে করবেন। কেননা, আমাদের এখন ঠিক শখ করার সময় নয়। আমাদের এই রোগ-শোক, দুঃখ-দারিদ্র্যের দেশে সুন্দর জীবন ধারণ করাই যখন হয়েছে প্রধান সমস্যা, তখন সে জীবনকেই সুন্দর করা, মহৎ করার প্রস্তাব অনেকের কাছে নিরর্থক এবং নির্মমও ঠেকবে।' অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, শখ হিসেবে বই পড়ার পরামর্শ দেওয়ার সময় এসেছে। আমাদের দেশে রোগশোক ও দুঃখ-দারিদ্র্য সম্পূর্ণভাবে দূর করতে না পারলেও অনেকাংশে তা সম্ভব হয়েছে। বই প্রকাশের সংখ্যা বেড়েছে; বিপণন বেড়েছে। কিন্তু সে অনুপাতে পাঠক বাড়েনি।

কোনো কোনো ব্যক্তি শখের বশে বই কেনেন, কিন্তু পড়েন না। পাঠক সবাই হতে পারে না। ক্রীড়া, চলচ্চিত্রের দর্শক বা সংগীতপিপাসু শ্রোতার চেয়ে একজন পাঠক অগ্রসর চিন্তার ব্যক্তি। ড্রয়িং রুম বা বাড়ির সৌন্দর্য বর্ধনের জন্য যারা বই সংগ্রহ করেন তাদের কাছে বইয়ের মূল্য আসবাবপত্রের চেয়ে বেশি নয়। একটি গল্প মনে পড়ছে। এক ভদ্রলোক নতুন বাড়ি নির্মাণ করে বন্ধুদের নিমন্ত্রণ করেছেন। খুব আগ্রহ নিয়ে তিনি বাড়ির ডিজাইন, উপকরণ, বিদেশ থেকে আনা টাইলস, ফিটিংস প্রভৃতি সম্পর্কে অতিথিদের ধারণা দিলেন। একজন বললেন, 'সবই ভালো হয়েছে, তবে ড্রয়িং রুমে যদি কিছু বই রাখার ব্যবস্থা করা যায় তাহলে আরও ভালো হবে।' শুনে সেই ভদ্রলোকের ত্বরিত জবাব, 'ঠিক আছে, আজই এক টন বইয়ের অর্ডার দিচ্ছি।' ইট, সিমেন্ট, রড, বালু নিয়ে ব্যতিব্যস্ত ব্যক্তির কাছে বইয়ের পরিমাপকও টন। এমন পাঠকরূপী অপাঠকের সংখ্যা কম নয়।

মানসম্পন্ন বই থাকলেও পাঠক পড়ছেন না- এমন দৃশ্য বিরল নয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরি বাংলাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ লাইব্রেরি। দিনের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে লাইব্রেরির সামনে অগণিত ছাত্রছাত্রীর ব্যাগ রাখা থাকে সারি ধরে। লাইব্রেরি খোলার আগমুহূর্তে ছাত্রছাত্রীরা নিজের ব্যাগ সরিয়ে সেখানে দাঁড়ান। লাইব্রেরির সামনে এমন দৃশ্য দেখে অভিভূত হওয়া অস্বাভাবিক নয়। ভেতরে ঢুকলে দেখা যাবে উল্টো চিত্র। লাইব্রেরির শ্রেষ্ঠ কোনো বই নিয়ে নয়; ছাত্রছাত্রীরা ডুবে আছে চাকরির পরীক্ষার গাইড নিয়ে। সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতেই কমবেশি এ চিত্র দেখা যাবে। একই চিত্র শাহবাগের কেন্দ্রীয় গণগ্রন্থাগারেও। কয়েক দিন আগে একটি বিভাগীয় শহরের গণগ্রন্থাগারেও ভিন্ন কিছু দেখিনি। বিসিএস, ব্যাংক, বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষার গাইড টেবিলে টেবিলে। এই 'পাঠকদের' প্রতিপত্তির কারণে প্রকৃত পাঠক বসারই চেয়ার পাচ্ছেন না। বুক শেলফের তাকের পর তাক অবহেলায় পড়ে আছে চিরায়ত সাহিত্যসহ নানা মূল্যবান বই নিয়ে। গণগ্রন্থাগারে বসে চাকরির প্রস্তুতি নেওয়ার এই দৃশ্য সম্ভবত প্রতিটি জেলা শহরেই বিদ্যমান। এই সংস্কৃতি বই পড়ার প্রকৃত উদ্দেশ্য সাধনে প্রতিবন্ধক

রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় অসংখ্য লাইব্রেরি স্থাপিত হয়েছে। সরকারি উদ্যোগ ছাড়া ব্যক্তি ও সাংগঠনিক উদ্যোগেও এসব লাইব্রেরি তৈরি হচ্ছে। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও লাইব্রেরি রয়েছে। এসব লাইব্রেরির আলমারিতে বহু মূল্যবান বই রয়েছে। লক্ষণীয়, আলমারির অধিকাংশ বই পাঠকের স্পর্শ থেকে বঞ্চিত। শিক্ষার্থী দূরের কথা, বহু প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকরাও বই ছুঁয়ে দেখেন না। একটি অভিজ্ঞতার কথা বলি। বছর ছয়েক আগে একটি উপজেলার স্বনামধন্য বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের কক্ষের আলমারিতে স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র দেখে খুশি হয়েছিলাম। কিন্তু হাতে নিয়ে বুঝলাম, এই বইগুলো কেউ পড়েননি। একজন শিক্ষককে এ বিষয়ে প্রশ্ন করলে তিনি সংকুচিত হয়ে জানালেন, 'আমি তো রসায়ন পড়াই; এসব ইতিহাসের বই ...।' আমি দুঃখ পেলেও অবাক হইনি। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা এমন শিক্ষা দিচ্ছে; বিজ্ঞানের শিক্ষক মনে করছেন, তার সাহিত্য ও ইতিহাস না পড়লেও চলবে। বলা বাহুল্য, এ চিত্র প্রায় প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাওয়া যাবে।

মুজিববর্ষ উপলক্ষে সারাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক অসংখ্য বই কিনেছে। এসব বই পড়ে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস সম্পর্কে শিক্ষার্থীরা স্পষ্ট ধারণা অর্জন করবে- এটিই প্রত্যাশিত। অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কিন্তু বই কিনেই দায়িত্ব শেষ করেছে। এগুলো পঠন-পাঠনের কোনো উদ্যোগ নেয়নি। বই কেনার পাশাপাশি বই পড়ানো জরুরি। না হলে শুধু বইয়ের স্তূপ তৈরি হবে। জ্ঞানের কোনো বিকাশ ঘটবে না। বই পড়া এবং মূল্যায়নের ক্ষেত্রে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র চার দশক ধরে প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। সরকারি-বেসরকারি লাইব্রেরি ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোরও এমন উদ্যোগ নেওয়া জরুরি। পঠিত বই সম্পর্কে আলোচনা ও কুইজ প্রতিযোগিতার আয়োজন করে কৃতী পাঠকদের পুরস্কৃত করতে হবে। এতে বই পড়ার আগ্রহ বৃদ্ধি এবং ক্রয়কৃত বইগুলো অপচয়ের হাত থেকে রক্ষা পাবে।

দেশের প্রকাশনা শিল্প বিকশিত হচ্ছে; প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে; বইমেলায় আশানুরূপ বই বিক্রি হচ্ছে- এগুলো নিঃসন্দেহে সুসংবাদ। কিন্তু এর সুফল পাওয়া যাবে না, যদি ক্রয়কৃত বই পঠিত না হয়। একালের শিশু-কিশোর, তরুণ প্রজন্ম ডিজিটাল ডিভাইসে যেভাবে আসক্ত হচ্ছে, তা মাদকাসক্তির চেয়ে কম দুশ্চিন্তার নয়। এ আসক্তি থেকে তাদের মুক্ত করার ক্ষেত্রে প্রধান হাতিয়ার হতে পারে বই। এ ক্ষেত্রে অভিভাবক ও শিক্ষকদের দায়িত্ব অপরিসীম। কৈশোরেই যদি তাদের পাঠানুরাগী করে তোলা যায়, তবে এরা যথার্থ পাঠক হিসেবে ভবিষ্যতে আত্মপ্রকাশ করবে।

মানুষ তৈরির আগে ঘর তৈরি করলে সেই ঘরে সরীসৃপ বসবাস করে। আমাদের লাইব্রেরিগুলোর এমন অবস্থা যেন না হয়। যথার্থ পাঠক তৈরি না হলে লাইব্রেরিগুলো অন্তঃসারশূন্য হয়ে পড়বে। তাই বই ও লাইব্রেরির সংখ্যা বৃদ্ধির পাশাপাশি পাঠকসংখ্যা বৃদ্ধির উদ্যোগ নেওয়া জরুরি।

রাজীব সরকার: প্রাবন্ধিক ও গবেষক

আরও পড়ুন

×