প্লাস্টিক দূষণবিরোধী অভিনব উদ্যোগ

আসাদুজ্জামান
প্রকাশ: ০৩ জুন ২০২২ | ১২:০০ | আপডেট: ০৪ জুন ২০২২ | ০৪:৫৫
পরিবেশ আমাদের অকৃত্রিম বন্ধু। পরিবেশকে সুস্থ রাখার দায়িত্ব আমাদের সবার। কিন্তু প্রতিনিয়ত দূষিত হয়ে উঠছে প্রাণিকুলের আশ্রয়স্থল এই সুন্দর পৃথিবী। পরিবেশ দূষণ এ শতাব্দীর অন্যতম সমস্যায় পরিণত হয়েছে। অন্যসব দূষণের পাশাপাশি প্লাস্টিক ও পলিথিন দূষণ সারা পৃথিবীতেই ভয়াবহ সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্লাস্টিক যেখানে থাকে সেখানকার মাটিকেই দূষিত করে। ওই স্থানে কোনো গাছ জন্মাতে পারে না। ফলে সেসব স্থানের পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হয়, জীবজগতের ক্ষতিসাধন হয়।
প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা প্রকল্প
নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনকে (এনসিসি) প্লাস্টিক বর্জ্যের ব্যবস্থাপনায় সহায়তা এবং প্লাস্টিক সংগ্রহ নিয়ে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) বাংলাদেশের সঙ্গে অংশীদারিত্বের মাধ্যমে ৩ বছরব্যাপী সার্কুলার ইকোনমি মডেলে 'প্লাস্টিক ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট: বিল্ডিং সার্কুলার সিটিজ' বর্জ্য সংগ্রহ প্রকল্প চালু করেছে ইউনিলিভার বাংলাদেশ লিমিটেড। এই মডেলের মাধ্যমে প্লাস্টিক বর্জ্য, বিশেষ করে একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক (এসইউপি) এবং ফ্ল্যাক্সিবল প্যাকেজিংয়ের ব্যবস্থাপনা করা হবে। এনসিসিতে ব্যবহূত প্লাস্টিকের ৪০ থেকে ৫০ শতাংশই এসইউপি এবং এটাই এনসিসিতে বর্জ্য সমস্যার মূল কারণ। তবে এখন খুবই অল্প পরিমাণ এসইউপি পুনরায় সংগ্রহ ও পুনঃচক্রায়ণ করা যাচ্ছে।
প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের কোনো পৌরসভার সঙ্গে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে ৪টি সংগ্রহ চ্যানেলের মাধ্যমে এই প্রকল্পের আওতায় ৪ লাখ ৪৪ হাজার বাসা থেকে প্লাস্টিক সংগ্রহ করা হচ্ছে। প্রকল্পটি ২১ অক্টোবর থেকে ৫টি সংগ্রহ কেন্দ্রের মাধ্যমে ১০০ টনের বেশি নমনীয় এবং একক ব্যবহূত প্লাস্টিক সংগ্রহ করেছে।
অনুমান করা হয়, প্রতি মাসে গড়ে প্রায় ৯০০ টন প্লাস্টিক বর্জ্য তৈরি হয়। এর মধ্যে ৩১৫ টন বর্জ্য অনানুষ্ঠানিক মাধ্যম দ্বারা পরিচালিত হয়, যার প্রায় ১০০ টন সংগ্রহকারীরা সরাসরি ঘর থেকে সংগ্রহ করেন। ফেরিওয়ালা বা পুনরায় ব্যবহারযোগ্য ক্রেতারাও প্রতি পরিবারের কাছ থেকে প্রায় ১০০ টন একই পরিমাণ বর্জ্য সংগ্রহ করেন। বাকি ১১৫ টন পরিচ্ছন্নকর্মী, বর্জ্য বাছাইকারী এবং বর্জ্য ট্রাক শ্রমিকদের মাধ্যমে সংগ্রহ করা হয়।
ইউনিলিভার বাংলাদেশ লিমিটেডের পার্টনারশিপ অ্যান্ড কমিউনিকেশন ম্যানেজার গাজী তাওহীদ আহমেদ বলেন, 'বিপুল পরিমাণ প্লাস্টিক বর্জ্য গত বছর থেকে এনসিসির বিভিন্ন এলাকা থেকে সংগ্রহের জন্য প্রকল্পে ৪টি ভিন্ন মডেল প্রয়োগ করছি। ৫টি সংগ্রহ কেন্দ্রের মাধ্যমে মডেলগুলো পরিচালিত হচ্ছে। আরও একটি মডেল পরীক্ষামূলকভাবে চালু হচ্ছে। এনসিসি, বর্জ্য সংগ্রহকারী সম্প্রদায়ের সদস্য, সিএসও এবং ২২৮ জন বাছাইকৃত বর্জ্য সংগ্রহকারী শ্রেণিবিভাজিত বর্জ্য সংগ্রহের পরিমাণ বাড়াতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছে আমাদের এ প্রকল্পে।
বর্জ্য সংগ্রহকারী মডেল
আবর্জনা পরিস্কার সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের (সিএসও) পক্ষে কাজ করেন এমন কর্মীরা পৃথকভাবে এনসিসির আওতাধীন এলাকার বাসাবাড়ি থেকে প্লাস্টিক বর্জ্য সংগ্রহ করে। সিএসওদের সঙ্গে অংশীদারির ভিত্তিতে প্লাস্টিক সংগ্রহ করে সেগুলোর শ্রেণিবিভাজন করে পুনঃচক্রায়ণ করা হয়। ফ্ল্যাক্সিবল প্যাকেজিংয়ের কোনো আর্থিক মূল্য না থাকলেও এর জন্য বর্জ্য সংগ্রহকারীদের আর্থিক প্রণোদনা দেওয়া হয়।
পরিচ্ছন্নকর্মী মডেল
এনসিসির রাস্তাঘাট পরিস্কার রাখার কাজে নিয়োজিত পরিচ্ছন্নকর্মীরা সড়ক ও নর্দমাগুলো থেকে পলিথিনের ব্যাগ ও এসইউপি সংগ্রহ করে প্লাস্টিক বর্জ্য সুনির্দিষ্ট জায়গায় জড়ো করেন। যেখানে বিভিন্ন ধরনের প্লাস্টিককে আলাদা করে পুনঃচক্রায়ণ করার জন্য অংশীদার বা ক্রেতাদের কাছে পাঠানোর জন্য প্রস্তুত করা হয়।
ফেরিওয়ালা মডেল
ফেরিওয়ালারা বাসা, ময়লার ভাগাড় ও অন্যান্য উৎস থেকে বিভিন্ন ধরনের প্লাস্টিক বর্জ্য সংগ্রহ করেন। তাঁদের এসইউপি ও মাল্টিলেয়ার প্লাস্টিক (এমএলপি) সংগ্রহ ও পৃথক করতে উদ্বুদ্ধ করা হয়। তাঁদের কাছ থেকে এসব বর্জ্য কিনে নিয়ে পুনঃচক্রায়ণের জন্য পাঠানো হয়। বর্জ্যের পরিমাণ অনুযায়ী তাঁদেরও আর্থিক প্রণোদনা দেওয়া হয়।
টি স্টল মডেল
একটি চায়ের দোকান থাকবে, যেখানে আপনি প্লাস্টিক পণ্য জমা দিয়ে চা খেতে পারবেন। অভিনব এই মডেলটি সাজানো হয়েছে মানুষের আগ্রহ বৃদ্ধি এবং সামাজিক সতর্কতার জন্য- এমনটাই জানিয়েছেন প্রকল্পের স্থানীয় পরিচালক।
পরিবেশ ও স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর এই প্লাস্টিক ও পলিথিনের বিকল্প ব্যবহারের দিকে নজর দেওয়ার এখনই সময়। বিশেষজ্ঞদের মতে রিসাইক্লিং, পুনর্ব্যবহার, ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ এবং সচেতনতার মাধ্যমে কিছু ক্ষতি কমানো সম্ভব। প্লাস্টিক ও পলিথিন দ্রব্যের ব্যবহার কমাতে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ এখন এসব পণ্যের ওপর কর বাড়িয়ে দিচ্ছে। পাশাপাশি কাগজের ব্যাগ অথবা বারবার ব্যবহার করা যায় এমন ব্যাগের ওপর গুরুত্ব আরোপ করছে। এ ছাড়া প্লাস্টিকের রিসাইক্লিংয়ের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। প্লাস্টিক দূষণ ঠেকাতে এবং জনগণকে উৎসাহিত করতে বিভিন্ন প্লাস্টিক বোতল জমা দেওয়ার বদলে পণ্য ও নানা সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। এ প্রকল্পটিও পরিবেশ রক্ষায় ভূমিকা রাখার পাশাপাশি নানা সুযোগ তৈরির আশা জাগাচ্ছে।