ঢাকা রবিবার, ০৬ জুলাই ২০২৫

ব্র্যাক ব্যাংক-সমকাল সাহিত্য পুরস্কার ২০২২

সৃজন আলোয় উদ্ভাসিত

সৃজন আলোয় উদ্ভাসিত

ব্র্যাক ব্যাংক–সমকাল সাহিত্য পুরস্কার ২০২২–এর মূলপর্বের আয়োজনে [বাঁ থেকে] এ. কে. আজাদ এমপি, ফয়জুল লতিফ চৌধুরী, আবু সাঈদ খান, মাহরীন ফেরদৌস, ময়ুখ চৌধুরী, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, বেগম আকতার কামাল ও সেলিম আর. এফ. হোসেন। প্রচ্ছদসহ অ্যালবামের ছবি :: মাহবুব হোসেন

হামিম কামাল

প্রকাশ: ১২ জুলাই ২০২৪ | ০৯:০১

ছুটির দিন পথেঘাটে ভিড় একটু বেশিই থাকে। মানুষের বিনোদনের ক্ষেত্র যেমন নেই, শ্বাস ফেলার দিনেরও যেন অভাব! একেকটা শুক্রবার তাই পারিবারিক সময় কাটানোর দিন, পথে বেরুবার দিন। ওটাই ছিল ভয়, শুক্রবার বিকেলের ভিড় ঠেলে সময়মতো সবাই আসতে পারবেন কিনা। উপরন্তু বর্ষাকাল। ইংরেজি ৫ জুলাই মানে, আষাঢ়স্য একুশতম দিবস। হঠাৎ জলসাঁতার অনিবার্য করে তুলবে না– আকাশ এমন কোনো কথা দেয়নি।
তবে প্রকৃতিকে যথেষ্ট প্রসন্নই মনে হলো ‘ব্র্যাক ব্যাংক-সমকাল সাহিত্য পুরস্কার ২০২২’ অনুষ্ঠানের প্রতি। না নামল বৃষ্টি, না বিশেষ কোনো জটিলতা তৈরি করল যানজট; অন্তত তাদের জন্য, যারা অনুষ্ঠানের সময়ে অর্থাৎ সন্ধ্যা ৬টা বা তার আশপাশে চলে আসতে সক্ষম হয়েছিলেন। প্রধান অতিথি, বরেণ্য শিক্ষাবিদ সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী যথারীতি সময়মতো অনুষ্ঠানে উপস্থিত। তখনও অনুষ্ঠানকক্ষ ততটা জমাট নয়। মঞ্চে সংগীতশিল্পীরা বীণাঅর্চনা করে নিচ্ছেন, গান পরিবেশনের সময় সুর যেন অসুর হয়ে না ওঠে। 
অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি চলে আসার পর দ্রুত বলরুম পূর্ণ হতে থাকল। এলেন জুরি বোর্ডের তিন সদস্য সেলিনা হোসেন, খালিকুজ্জামান ইলিয়াস ও ফয়জুল লতিফ চৌধুরী। অন্যতম সদস্য কবি আবিদ আনোয়ার শারীরিক অসুস্থতার কারণে অনুপস্থিত। আজীবন সম্মাননা পদক যিনি পাচ্ছেন– ভাষাসংগ্রামী, কবি ও প্রাবন্ধিক আহমদ রফিক অনুষ্ঠানস্থল হোটেল সোনারগাঁওয়ে এলেও তাঁকে বলরুমে আনা হয়নি। বার্ধক্যজনিত কারণে শারীরিকভাবে নাজুক অবস্থায় তিনি। হোটেলের একটি কক্ষে বিশ্রামে রাখা হয় তাঁকে। 
তরুণ থেকে জ্যেষ্ঠ– নিজ নিজ ক্ষেত্রে উজ্জ্বল শিল্পীবৃন্দ, রাজনীতিক, সমাজকর্মীদের ব্যক্তিত্বের উপস্থিতিতে বলরুম যখন ক্রমেই মুখর, অনুষ্ঠানের বৈদ্যুতিন পর্দায় ছড়ানো নীল আলো সবার চোখেমুখে, রাজসিক ঝাড়বাতিগুলো মার্জিত আলো ছড়াচ্ছিল, তখন সমকালের উপসম্পাদক মাহবুব আজীজ সঞ্চালনার দায়িত্ব নিয়ে মঞ্চে আবির্ভূত হলেন।
তাঁর স্বতঃস্ফূর্ত কথামালায় সবার মনোযোগ ক্রমে অনুষ্ঠানে নিবদ্ধ হলো। বলরুমের করিডোরে যারা কফি পান করছিলেন, সাজানো কিছু প্রেক্ষাপটের সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তুলছিলেন, তাঁর আহ্বানে তারাও চলে এলেন অনুষ্ঠানকক্ষে। ব্র্যাক ব্যাংক কর্তৃপক্ষকে সহযাত্রী হওয়ার জন্য ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে তিনি বললেন, “২০১১ সালে সমকালের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক গোলাম সারওয়ারের উদ্যোগে স্পেকট্রা মিলনায়তনে ছোট্ট পরিসরে এই আসরের হাঁটি হাঁটি পায়ের যাত্রা শুরু হয়েছিল।” 
অনুষ্ঠান সূচিত হলো শিল্পী পূজা সেনগুপ্ত ও তাঁর দল তুরঙ্গমীর নৃত্য পরিবেশনার মাধ্যমে। তাদের অঙ্গসজ্জা ছিল অপূর্ব। মাথায় মৃগশৃঙ্গ, অথবা তরুণ বৃক্ষশাখা, পরনে ঝলমলে পোশাক। উৎসবের অপূর্ব প্রতিনিধিত্ব তারা করলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রেমপর্বের গানকে আশ্রয় করে।
“নীলাঞ্জনছায়া,   প্রফুল্ল কদম্ববন,/জম্বুপুঞ্জে শ্যাম বনান্ত, বনবীথিকা ঘনসুগন্ধ
মন্থর নব নীলনীরদ–পরিকীর্ণ দিগন্ত/চিত্ত মোর পন্থহারা/কান্তবিরহকান্তারে ...” গানের সমান্তরালে নৃত্যের লহরি মুগ্ধ মুহূর্তের সৃষ্টি করে।
রবি তো সর্বসময় আকাশজোড়া থাকেন, এটিই প্রমাণিত হলো। এর পরই এলেন বায়ুর মতোন আমাদের প্রাণপ্রদায়ী কাজী নজরুল ইসলাম। তাঁকে নিয়ে এলেন জনপ্রিয় নজরুলসংগীত শিল্পী ফেরদৌস আরা। 

‘মিনতি-ভরা আঁখি/কে তুমি ঝড়ের পাখি/কী দিয়ে জুড়াই ব্যথা/কেমনে কোথায় রাখি’... ফেরদৌস আরার কণ্ঠে অনুষ্ঠান তার ছন্দ পেয়ে গেছে। সেই সরল ছন্দিত স্পন্দনে স্পন্দিত হতে শুরু করেছেন অভ্যাগতবৃন্দ। পরবর্তী দীর্ঘক্ষণ তাদের ধ্যানভঙ্গ ঘটল না। ব্র্যাক ব্যাংকের হেড অব কমিউনিকেশন, লেখক ইকরাম কবীরের ভিডিওবার্তায় উঠে এলো স্বল্প পরিসরে এই পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানের সার্বিক প্রক্রিয়া ও ইতিহাস। এরপর আজীবন সম্মাননার জন্য নির্বাচিত ব্যক্তিত্ব আহমদ রফিকের নাম ঘোষণা করেন সমকালের উপদেষ্টা সম্পাদক আবু সাঈদ খান। 
তথ্যচিত্র এ অনুষ্ঠানের অন্যতম আকর্ষণ। নাম ঘোষণার পর প্রদর্শিত হয় ভাষাসংগ্রামী, সাহিত্যিক আহমদ রফিককে নিয়ে নির্মিত তথ্যচিত্র। তথ্যের অবসরে তাঁর অমূল্য উপলব্ধির বর্ণনা আমরা শুনতে পাই। এরই মাঝে হোটেলের ‍স্যুট থেকে আহমদ রফিককে সহকর্মীরা অনুষ্ঠানস্থলে নিয়ে আসেন। তথ্যচিত্র সমাপ্ত হলে, আহমদ রফিকের আসন গ্রহণের পর তাঁকে উত্তরীয় পরিয়ে দেন টাইমস মিডিয়া লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সংসদ সদস্য এ. কে. আজাদ। তাঁর হাতে পুরস্কার-স্মারকস্বরূপ পদক তুলে দেন জুরি বোর্ডের সভাপতি সেলিনা হোসেন, পুরস্কারমূল্য পাঁচ লাখ টাকার চেক তুলে দেন ব্র্যাক ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সেলিম আর. এফ. হোসেন।  
এরপর একে একে পুরস্কার বিজয়ী–কবিতা ও কথাসাহিত্য শাখায় কবি ময়ুখ চৌধুরী, প্রবন্ধ-আত্মজীবনী-অনুবাদ-ভ্রমণ শাখায় বেগম আকতার কামাল ও তরুণ সাহিত্যিক শাখায় কথাশিল্পী মাহরীন ফেরদৌসকে নিয়ে নির্মিত তথ্যচিত্র প্রদর্শন ও পুরস্কার-স্মারক উত্তরীয় ও পদক প্রদানের পর তাদের হাতে পুরস্কার মূল্যের চেক তুলে দেওয়া হয়। জ্যেষ্ঠ সাহিত্যিক ময়ুখ চৌধুরী ও বেগম আকতার কামাল পান ২ লাখ টাকার সম্মাননা চেক; কনিষ্ঠ সাহিত্যিক মাহরীন ফেরদৌস পান ১ লাখ টাকার সম্মাননা চেক। মঞ্চে তাঁরা নিজ নিজ অনুভূতি ব্যক্ত করেন। অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন জুরি বোর্ডের পক্ষে সেলিনা হোসেন ও ফয়জুল লতিফ চৌধুরী, ব্র্যাক ব্যাংকের এমডি ও সিইও সেলিম আর. এফ. হোসেন, টাইমস মিডিয়া লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সংসদ সদস্য এ. কে. আজাদ। এরপর প্রধান অতিথি সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর কথা শোনার পালা। তিনি পুরস্কার, চলতি সমাজ-সংস্কৃতির বন্ধুর পথ ও দেশজ শিল্পসাহিত্য বিষয়ে স্বপ্ন ও অনুভূতিমালা ব্যক্ত করেন। সমকালের উপদেষ্টা সম্পাদক আবু সাঈদ খানের সমকালের আদর্শিক অবস্থান তুলে ধরা বক্তব্যের পর এলো আপ্যায়নপর্ব। 
যার আনন্দঘন সূচনা আছে, তার বিষণ্ন সমাপ্তিও আছে। ২০২৪-এর ৫ জুলাই, ৬টায় এক উজ্জ্বল অপরাহ্ণে উৎসবের পর্দা উঠেছিল। 
তবে জগতে সবকিছু পর্যায়ক্রমিক ও গতিশীল। এখানে প্রীতি দিলে প্রীতি ফিরে আসে, ফিরে আসে নেতিবাচক শক্তিগুলোও। যতদিন প্রগতি বজায় থাকবে, ততদিন প্রীতির শক্তিই শেষে বড় হয়ে উঠবে। বিজয়ী ও অভ্যাগতদের বিদায়পর্বে সেই প্রীতি ফিরে আসার অপেক্ষাই অভিব্যক্ত হলো। পরবর্তী অনুষ্ঠানে আবারও সৃজনের আলোর উজ্জ্বল উদ্ভাসন দেখবে দেশ, এই আশা বিনিময়ের পর রাত্রি দ্বিতীয় প্রহরের প্রথম লগ্নে নিভে এলো উৎসবের আলো। v 
 

আরও পড়ুন

×