বিশ্ব সমুদ্র দিবস ২০২৪
মহাপ্রাণ

শাহেরীন আরাফাত
প্রকাশ: ০৮ জুন ২০২৪ | ০০:৪৬
পৃথিবী নামক গ্রহটির ৭০ শতাংশেরও বেশি এলাকা জুড়ে রয়েছে সাগর-মহাসাগর। এটি আমাদের জীবনের উৎস। প্রায় ৩৯ হাজার কোটি বৃক্ষের আমাজন রেইনফরেস্ট বিশ্বের ২০ শতাংশ অক্সিজেন উৎপাদন করে। বাকি ৮০ শতাংশ অক্সিজেন কোথা থেকে আসে? অনেকের ধারণা, বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে থাকা গাছপালা থেকেই সম্ভবত এই অক্সিজেন আসে। যুক্তরাষ্ট্রের ‘ন্যাশনাল ওশানিক সার্ভিস’ জানায়, সামুদ্রিক প্ল্যাঙ্কটন, শৈবাল এবং সমুদ্রের তলদেশে থাকা অন্যান্য উদ্ভিদ পৃথিবীর অর্ধেকেরও বেশি অক্সিজেনের জোগান দেয়। সালোকসংশ্লেষণ হলো একটি জৈব রাসায়নিক প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে উদ্ভিদ কার্বন ডাইঅক্সাইড, পানি ও সূর্যের আলোর সাহায্যে খাদ্য তৈরি করে। সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় উদ্ভিদের খাদ্য তৈরির সময় উপজাত হিসেবে তৈরি হয় অক্সিজেন। জলবায়ু পরিবর্তনসংক্রান্ত আন্তঃসরকার প্যানেলের (আইপিসিসি) হিসাবে সমুদ্র পৃথিবীর প্রায় ২৫ শতাংশ কার্বন ডাইঅক্সাইড শোষণ করে। সমুদ্র পৃথিবীর বেশির ভাগ জীববৈচিত্র্যের আবাসস্থল এবং ১০০ কোটিরও বেশি মানুষের আমিষের প্রধান উৎস। সমুদ্র বিশ্ব অর্থনীতির অন্যতম চাবিকাঠি। ২০৩০ সাল নাগাদ সমুদ্রভিত্তিক বিভিন্ন শিল্পে প্রায় চার কোটি মানুষ যুক্ত থাকবে। সামুদ্রিক দূষণ রোধ ও সেখানকার জীববৈচিত্র্যের সঙ্গে মানবজাতির ভবিষ্যৎ ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
জাতিসংঘের তথ্যমতে, সমুদ্রে ৯০ শতাংশ বড় মাছের সংখ্যা হ্রাস পেয়েছে এবং ৫০ শতাংশ প্রবাল প্রাচীর ধ্বংস হয়ে গেছে। সমুদ্র নিজ থেকে যে ক্ষয় পূরণ করতে পারে, আমরা তার চেয়ে অনেক বেশি নিচ্ছি। সমুদ্রের সঙ্গে একটি নতুন ভারসাম্য তৈরি করতে এ বিষয়ে বৈশ্বিক উদ্যোগ জরুরি। এ বিষয়টিকে সামনে রেখেই এ বছর বিশ্ব সমুদ্র দিবসের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে– ‘নতুন গভীরতা জাগ্রত করুন’। সব পক্ষ, বর্গ ও সম্প্রদায়ের গভীর সমন্বয় দরকার বলে এ প্রতিপাদ্য গ্রহণ করেছে জাতিসংঘ।
যেভাবে এলো বিশ্ব সমুদ্র দিবস
সমুদ্রের অবদান, আবেদন, প্রয়োজনীয়তা ও উপকারিতাকে স্বতন্ত্রভাবে বিশ্বের সবার সামনে তুলে ধরতে প্রতি বছর ৮ জুন পালন করা হয় বিশ্ব সমুদ্র দিবস। বিশেষ এ দিবসটি পালনের প্রস্তাব প্রথমবার নিয়ে আসে কানাডা। ১৯৯২ সালে ব্রাজিলের রিও ডি জেনিরো শহরে অনুষ্ঠিত হয় ধরিত্রী সম্মেলন। সেই সম্মেলনে কানাডা সমুদ্র নিয়ে একটি বিশেষ দিবস পালনের প্রস্তাব দেয়। সমুদ্রের বিশ্বব্যাপী ভূমিকা ও প্রয়োজনীয়তা নিয়ে তারপর থেকে নানা রকম চিন্তা-ভাবনা চলে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক পর্যায়ে। শেষ পর্যন্ত ২০০৮ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে বিশ্ব সমুদ্র দিবস পালনের প্রস্তাবটি গৃহীত হয়। অধিবেশনে জাতিসংঘ এই বিশেষ দিবসটি পালন করার জন্য সব সদস্য রাষ্ট্রকে আহ্বান জানায়। ২০০৯ সাল থেকে প্রতি বছরের ৮ জুন বৈশ্বিকভাবে পালিত হয়ে আসছে বিশ্ব সমুদ্র দিবস। দিবসটি পালনের মূল উদ্দেশ্য হলো– সাগর-মহাসাগর সম্পর্কে মানুষের সচেতনতা বাড়িয়ে তোলা। সেই সঙ্গে সমুদ্র ব্যবহার ও পরিবেশ ভালো রাখা এবং সমুদ্র দূষণ রোধ করার ক্ষেত্রে বিভিন্ন আইনের বিন্যাস, বাস্তবায়ন ও প্রয়োগের দরজা খুলে দেয় এই বিশেষ দিবস।
গভীর সমুদ্রে খনন
লাখ লাখ বছর ধরে সমুদ্রের তলদেশে পড়ে থাকা ‘ম্যাঙ্গানিজ নাজুল’ অনেক সামুদ্রিক জীবের আবাস। আবার এই পাথরে ম্যাঙ্গানিজ, কোবাল্টের মতো মূল্যবান ধাতুও রয়েছে। জার্মানির ‘জিওমার হেলমহোলৎজ সেন্টার ফর ওশান রিসার্চ’-এর মেরিন বায়োকেমিস্ট মাটিয়াস হ্যাকেল বলেন, ‘কোরাল ও স্পঞ্জের মতো প্রাণীর বসবাসের জন্য ম্যাঙ্গানিজ নাজুল পাথর প্রয়োজন। এ প্রাণীগুলো ব্রিটল স্টার ও কোপোপডের মতো সামুদ্রিক প্রাণীর থাকার ব্যবস্থা করে। সমুদ্রতল থেকে ৫ থেকে ১০ সেন্টিমিটার ওপরের সক্রিয় প্রাণী ও উদ্ভিদ জগৎ সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যাবে। সেখানে যে কোনো ধরনের পুনর্গঠন হতে হাজার হাজার বছর সময় লাগবে। মাইনিং অপারেশনগুলো অনেক বড় আকারে হয়ে থাকে। বছরে কয়েকশ বর্গকিলোমিটার এলাকা খনন করা হয়। সে কারণে অনেক প্রজন্মের জন্য এ প্রাণীগুলো ধ্বংস হয়ে যেতে পারে।’
আইইউসিএনের তথ্যমতে, এই খননের দ্বারা নির্গত পলির বরফ শত শত কিলোমিটার পর্যন্ত প্রসারিত হতে পারে এবং প্রাণীদের শ্বাস-প্রশ্বাসে বিঘ্ন হতে পারে। বিলুপ্তির আশঙ্কা রয়েছে হাজারো প্রজাতির। পরিবেশবাদী সংগঠন গ্রিনপিসের কর্মকর্তা ফ্রান্সিসকা সালমান বলেন, ‘গভীর সমুদ্রে খননের ফলে পরিবেশের পাশাপাশি আমরা সাগরও ধ্বংস করা শুরু করছি।’
মেরিটাইম আইন অনুযায়ী, গভীর সমুদ্রে খনন করা যায়। সে ক্ষেত্রে সমুদ্রের পরিবেশের ভয়ানক কোনো ক্ষতি হবে না– এমন শর্ত মানতে হয়। কিন্তু গভীর সমুদ্রে খনন মানেই সেখানকার বাস্তুতন্ত্র ধ্বংস করা। এরই মধ্যে প্রশান্ত মহাসাগরের ‘ক্ল্যারিয়ন ক্লিপার্টন জোন’ এলাকায় অনেক দেশ খনন প্রতিযোগিতায় নেমেছে। সমুদ্রের গভীরে খননের জন্য ৪ হাজার ৭৭ কোটি রুপি অনুমোদন দিয়েছে ভারত। দক্ষিণ ভারত মহাসাগরে ৭৫ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকায় এই বিশেষ অভিযান চালানো হবে।
সমুদ্রে প্লাস্টিকের পাহাড়
পরিবেশ দূষণে সবচেয়ে ভয়াবহ প্রভাব ফেলে প্লাস্টিক। এটি এমন একটি বস্তু, যা কখনও বিনষ্ট হয় না। বছরের পর বছর এটি থেকে যায়। সামুদ্রিক বর্জ্যের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ এটি। জাতিসংঘের পরিবেশ সমীক্ষার তথ্যমতে, সমুদ্রের প্রতি বর্গমাইলে ৫০ হাজার পর্যন্ত প্লাস্টিকের বোতল ভাসতে দেখা যায়। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে তেল, কেমিক্যালসহ আরও নানারকম বর্জ্য। সমুদ্র যেন বিশ্বের সবচেয়ে বড় ডাস্টবিনে পরিণত হয়েছে। প্লাস্টিক, কাচ, কাঠ ও রাবারকে প্রধান সামুদ্রিক বর্জ্য হিসেবে ধরা হয়। মোট সামুদ্রিক বর্জ্যের ৬১ থেকে ৮১ শতাংশই হলো এগুলো। প্রতি বছর এক কোটি টনের বেশি প্লাস্টিকে দূষিত হচ্ছে সমুদ্র। তাতেই জমছে সমুদ্রে প্লাস্টিকের পাহাড়।
এসব বর্জ্য সব সামুদ্রিক প্রাণীর জন্য চরম উদ্বেগের। পর্যায়ক্রমে এসব আবর্জনা প্রাণীর খাদ্যশৃঙ্খলে ঢুকে যাচ্ছে। এতে ক্ষুদ্র প্লাঙ্কটোনিক জীব থেকে শুরু করে তিমিদের মতো বড় স্তন্যপায়ী প্রাণী পর্যন্ত দুর্ভোগে পড়ছে। প্লাস্টিক দূষণের ফলে প্রতি বছর ১০ লাখ সামুদ্রিক পাখি এবং ১ লাখ সামুদ্রিক প্রাণীর মৃত্যু হয়। ২০২২ সালে গ্রিসের উপকূলে আটকে পড়া একটি তিমির পেটে প্রায় ১৫ কিলোগ্রাম প্লাস্টিক পাওয়া যায়।
জাতিসংঘের ওই প্রতিবেদন অনুসারে, সামুদ্রিক আবর্জনার আনুমানিক ৮০ শতাংশই ভূমিভিত্তিক উৎস থেকে আসে। অবশিষ্ট ২০ শতাংশ বর্জ্য আসে সমুদ্রভিত্তিক উৎস থেকে।
এনভায়রনমেন্টাল প্রোটেকশন এজেন্সির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রতি বছর ৮ থেকে ১২ টন প্লাস্টিক সমুদ্রে নিক্ষেপ করা হয়। যেখানে বর্তমানে বিশ্বজুড়ে সমুদ্রের পৃষ্ঠে ১৫ থেকে ৫১ ট্রিলিয়ন প্লাস্টিকের টুকরো ভাসছে। এক জরিপে দেখা গেছে, এ সমস্যার কারণে প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ২১টি দেশের মৎস্যজীবীরা প্রতি বছর প্রায় ১২৬ কোটি ডলারের ক্ষতির মুখোমুখি হচ্ছেন। সমুদ্রের এসব আবর্জনা মানবস্বাস্থ্যের জন্যও অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। সাম্প্রতিক গবেষণাগুলোয় বিজ্ঞানীরা মানুষের ফুসফুস, মল, রক্ত, এমনকি মায়ের বুকের দুধেও মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতি খুঁজে পেয়েছেন। ২০১৮ সালে গবেষকরা বিভিন্ন দেশের ২৫৯টি পানির বোতলের ৯৩ শতাংশে মাইক্রোপ্লাস্টিক পেয়েছেন। ক্যান্সার, হরমোনের তারতম্য, প্রজনন প্রক্রিয়ায় বাধা ছাড়াও গুরুতর সব ক্ষতির কারণ এই মাইক্রোপ্লাস্টিক।
ইতিবাচক উদ্যোগ
প্রায় এক দশক ধরে প্রশান্ত মহাসাগর থেকে প্লাস্টিক বর্জ্য সরানোর উপায় নিয়ে কাজ করছেন বোয়ান স্ল্যাট নামের এক ডাচ উদ্যোক্তা। তার পরিবেশবাদী প্রতিষ্ঠান ‘ওশান ক্লিনআপ’ বিশ্বের বিভিন্ন নদী ও সমুদ্র থেকে বর্জ্য অপসারণের কাজ করছে। বোয়ান স্ল্যাট ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসিকে বলেন, ‘এ কাজটি ধারণার চেয়ে অনেক কঠিন। পরিধিও বিস্তৃত। বিশ্বের প্রায় এক হাজার নদী ও পাঁচ মহাসাগরের বর্জ্যের স্তূপ ঠেকাতে হবে– সমস্যার বিশালতা বুঝতেই আমার প্রথম কয়েক বছর লেগে গেছে।’
উত্তর প্রশান্ত মহাসাগরে জমে থাকা প্লাস্টিকের পাহাড় ‘দ্য গ্রেট প্যাসিফিক গারবেজ প্যাচ’ নামে পরিচিত। এ জঞ্জালের মধ্যে রয়েছে বড় মাছ ধরার জাল থেকে শুরু করে মাইক্রোপ্লাস্টিকও। এটিকেই মূল টার্গেট বানিয়েছে ‘ওশান ক্লিনআপ’ দল। বর্জ্য সরাতে তারা দীর্ঘ ইউ-আকৃতির এক কাঠামো ব্যবহার করে, যা দেখতে অনেকটা মাছ ধরার জালের মতো। দু’পাশে দুটি নৌকার মাধ্যমে বিভিন্ন বর্জ্যের স্তূপ টানা হয়। জলজ প্রাণীদের যাতে কোনো সমস্যা না হয়, তা নিশ্চিত করার জন্য ধীরে ধীরে ওই জাল টানা হয়।
এ প্রসঙ্গে বোয়ান স্ল্যাট বলেন, ‘গ্রেট প্যাসিফিক গারবেজ প্যাচের দিকে তাকালে দেখা যাবে, এতে এমন কিছু জায়গা রয়েছে, যেখানে প্লাস্টিকের ঘনত্ব অনেক বেশি। আবার কিছু জায়গা একেবারেই খালি।’ ৮০০ মিটার এলাকাজুড়ে প্লাস্টিক আটকানোর ব্যবস্থা উদ্ভাবন করেছেন তারা। এর মাধ্যমে সমুদ্র থেকে পর্যায়ক্রমে প্লাস্টিক তুলে এনে রিসাইকেল করা হয়।
বিশ্বে আজ সমুদ্র ও উপকূলবর্তী উদ্ভিদ ও প্রাণী জগৎ বিপর্যয়ের মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তন, নানা রকম দূষণ ও সামুদ্রিক সম্পদের মাত্রাহীন ব্যবহারের ফলে আজ এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এর ভয়াবহ পরিণাম ভোগ করতে হচ্ছে গোটা মানবজাতিকে। তবে সাগর-মহাসাগর বাঁচানোর এখনও সুযোগ আছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। টেকসই উন্নয়ন পদ্ধতি প্রয়োগের মাধ্যমে প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে চলতে হবে। প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণের সময় পরিবেশের ক্ষতি হয় এমন কাজ করা যাবে না। নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎপাদন থেকে শুরু করে ইকো-ট্যুরিজমকে আরও উৎসাহ দেওয়ার মাধ্যমে উপকূলবর্তী এলাকার পরিস্থিতি উন্নত হতে পারে। বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক সমন্বিত পরিবেশবান্ধব প্রকল্প গ্রহণের মাধ্যমে এ পরিস্থিতির ইতিবাচক বাস্তব পরিবর্তন সম্ভব। v
- বিষয় :
- সমুদ্রপথ