দৃক গ্যালারিতে ওয়ার্ল্ড প্রেস ফটো প্রদর্শনী
আলোকচিত্রে পৃথিবীর মুখ

গত বছরের ১৯ অক্টোবর গাজার আল-জাহরা এলাকায় ইসরায়েলি বিমান হামলার পর ছবিটি তুলেছিলেন মুস্তাফা হাসোনা
দ্রোহী তারা
প্রকাশ: ০১ নভেম্বর ২০২৪ | ২৩:১১ | আপডেট: ০৩ নভেম্বর ২০২৪ | ১৭:৩২
রক্তলাল ফুলে চেহারা ঢেকে রাখা এক নারী। পুরো আলোকচিত্রে চোখ সেই রক্তলাল ফুলেই আটকে যায়। বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলে দেখার তীব্র ইচ্ছে জাগে যে নারীর চেহারা কেমন? এমনই প্রশ্ন জাগিয়ে তোলা আলোকচিত্রটি আরলেত বেশাইজির তোলা।
কঙ্গোর আরলেত তাঁর ‘বেঁচে যাওয়া বাকিরা’ নামে আলোকচিত্রে ২০২০ সালে ইথিওপিয়ার টিগ্রেতে সংঘটিত দুই বছর স্থায়ী সংঘর্ষটির নির্মম বাস্তবতা উঠে আসে। এতে প্রায় ছয় লাখ মানুষ মৃত্যুবরণ করে। লাখ লাখ মানুষ ভয়াবহ দুর্ভিক্ষে পতিত হয়। যদিও সঠিক সংখ্যা নিশ্চিত করা কঠিন। তবুও একটি গবেষণায় ধারণা করা হয়, যুদ্ধের সময় এক লাখেরও বেশি নারী যৌন সহিংসতার শিকার হয়েছেন। ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়নের প্রতি সামাজিক পক্ষপাত ও অসম্মানের কারণে বহু নারী নিজ পরিবার ও সমাজ থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন। তারা একা একা টিকে থাকার লড়াই করছেন। যৌন সহিংসতার শিকার হওয়া নারীদের ব্যক্তিগত গল্প ও পুনরায় তাদের জীবনে ফেরার অসাধারণ অভিযোজন ক্ষমতাই এ আলোকচিত্রে উঠে এসেছে। আরলেত ছবিটি দ্য ওয়াশিংটন পোস্টের জন্য কাজ করার সময় তোলেন।
আলোকচিত্রের মাধ্যমে সব সময় গল্পের পেছনের গল্পটি উঠে আসে। ক্যামেরার লেন্সের একটি ক্লিকের ছবি যেমন বুকের ভেতর হাকাকার জাগিয়ে তুলতে পারে, ঠিক তেমনি সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণাও জোগায়। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত এমন সব অসাধারণ আলোকচিত্র তুলে ধরা হয় দৃকের পাঠ ভবনে গত ২৫ অক্টোবর থেকে ওয়ার্ল্ড প্রেস ফটো প্রদর্শনী ২০২৪-এর বিশ্বব্যাপী সফরের ঢাকা সংস্করণে।
মোহাম্মাদ সালেমের তোলা এক ছবিতে একজন নারী তাঁর ভাগনের মরদেহ শেষবারের মতো আলিঙ্গন করছেন। ছবিটি দেখছিলেন অবসরপ্রাপ্ত সরকারি চাকরিজীবী রুকসানা। তিনি বলেন, ‘ছবিটি দেখেই বুকটা মোচড় দিয়ে উঠেছে আমার। ঘুরেফিরে কয়েকবার এ ছবিই দেখছি। বারবার মনে হচ্ছে, কেন এই হত্যা? এতে কি-ই বা লাভ?’ সালেমের এই ছবি বর্ষসেরার কৃতিত্ব অর্জন করেছে। এতে তিনি যুদ্ধের নৃশংসতা তুলে ধরতে পেরেছেন। গার্ডিয়ান ও আলজাজিরার প্রতিবেদনমতে, গত বছরের অক্টোবরের মাঝামাঝি ইসরায়েলি বিমানবাহিনী দক্ষিণ গাজার খান ইউনিসে ব্যাপক বোমা বর্ষণ করে। ছবিটি তখন তোলা হয়।
ছবিতে যে নারীকে দেখা যায়, তিনি ৩৬ বছর বয়সী ইনাস আবু মামার। তাঁর পাঁচ বছর বয়সী ভাগনে স্যালির মরদেহ কোলে নিয়ে আছেন। একটি ইসরায়েলি হামলায় তাদের পরিবারের চার সদস্যের সঙ্গে স্যালিও নিহত হয়। গাজায় ইসরায়েলি হামলায় নিহতদের মধ্যে ফিলিস্তিনি নারী ও শিশুর সংখ্যা দুই-তৃতীয়াংশেরও বেশি।
মূলত একটি ছবি মানবমস্তিষ্কে অবচেতনভাবে প্রভাব ফেলে। বিশেষত সেটি যদি প্রেস ফটোগ্রাফি হয়, তাহলে জীবন বাজি রেখে তোলা ফটো সাংবাদিকদের এসব ছবি থেকে জানা-অজানা বহু কিছুর সাক্ষী হওয়া যায়।
বিশ্বব্যাপী সফররত এ প্রদর্শনীতে ওয়ার্ল্ড প্রেস ফটো ফাউন্ডেশনের বার্ষিক আলোকচিত্র প্রতিযোগিতার ফলাফলের ভিত্তিতে একটি স্বাধীন বিচারকমণ্ডলীর মাধ্যমে নির্বাচিত বিগত বছরে তোলা পৃথিবীর সেরা আলোকচিত্র সাংবাদিকতা ও ডকুমেন্টারি আলোকচিত্র প্রদর্শিত হচ্ছে। এর আগে এশিয়া অঞ্চলের সহযোগী হিসেবে দৃক ২০২২ সালের ওয়ার্ল্ড প্রেস ফটো প্রদর্শনীর আয়োজন করে সে বছরের নভেম্বরে। এ ছাড়াও দৃক এশিয়া অঞ্চলের ২০২৩ সালের ওয়ার্ল্ড প্রেস ফটো প্রতিযোগিতার বিচার প্রক্রিয়ার আয়োজন করে ঢাকায় এবং ২০২৪ সালে ওয়ার্ল্ড প্রেস ফটো প্রতিযোগিতার বিচার প্রক্রিয়া আয়োজন করে অনলাইনে। এ বছর ওয়ার্ল্ড প্রেস ফটো প্রতিযোগিতাটি আফ্রিকা, এশিয়া, ইউরোপ, উত্তর ও মধ্য আমেরিকা, দক্ষিণ আমেরিকা, দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া এবং ওশেনিয়া অঞ্চলে অনুষ্ঠিত হয়েছে।
প্রতিযোগিতার এবারের ৬৭তম আসরে ১৩০টি দেশের ৩ হাজার ৮৫১ জন আলোকচিত্রীর কাছ থেকে ৬১ হাজার ৬২টি আলোকচিত্র ও ওপেন ফরম্যাট এন্ট্রি পাওয়া যায়। ৬১ হাজারেরও বেশি এন্ট্রি থেকে নির্বাচিত বিজয়ী কাজগুলোর মধ্য দিয়ে ধ্বংসাত্মক সংঘাত, রাজনৈতিক উত্থান, জলবায়ু সংকট, অভিবাসীদের নিরাপদ উত্তরণ, বিভিন্ন জটিল রোগব্যাধিসহ বিশ্বে সাম্প্রতিককালের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয় তুলে ধরা হয়েছে। বর্তমানে প্রদর্শনীটি ৬০টির বেশি দেশে সফর করছে।
মূলত নির্ভরযোগ্য গল্প বলার মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী আলোকচিত্র সাংবাদিক, প্রামাণ্য আলোকচিত্রী এবং দর্শকের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনকারী একটি বৈশ্বিক প্ল্যাটফর্ম ‘ওয়ার্ল্ড প্রেস ফটো’। ১৯৫৫ সালে প্রতিষ্ঠা লাভের পর থেকে নিজেদের কাজ আন্তর্জাতিক দর্শকদের কাছে তুলে ধরার জন্য ডাচ্ আলোকচিত্রীদের একটি দল তখন একটি প্রতিযোগিতার আয়োজন করে, যা ‘ওয়ার্ল্ড প্রেস ফটো’ নামে পরিচিতি লাভ করে। তারপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। ধীরে ধীরে এর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য প্রসারিত হতে হতে বর্তমান বিশ্বে মর্যাদাপূর্ণ প্রতিযোগিতায় পরিণত হয়েছে। প্রতিযোগিতায় বিশ্বব্যাপী আলোকচিত্র সাংবাদিকতা এবং প্রামাণ্য আলোকচিত্রে সেরা অবদানকারীকে পুরস্কৃত করা হয়। ওয়ার্ল্ড প্রেস ফটো লাখো মানুষের কাছে গুরুত্বপূর্ণ গল্পগুলো উপস্থাপন করে।
ওয়ার্ল্ড প্রেস ফটো প্রতিযোগিতার এশিয়া অঞ্চলের কো-অর্ডিনেটর এএসএম রেজাউর রহমান বলেন, ‘ওয়ার্ল্ড প্রেস ফটো সাংবাদিকদের কাছে ভীষণ আগ্রহের একটি জায়গা। আলোকচিত্রপ্রেমীরা এ প্রদর্শনীর জন্য অপেক্ষা করেন। কেননা এ প্রদর্শনীতে গত বছরের ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো যেমন দেখা হয়ে যায়। অনেক অদেখা ছবিও দেখার সুযোগ হয়।’
সংগ্রামী জীবনের এক ভিন্নধর্মী আলোকচিত্রী চার্লস ফ্রেডেরিক উয়েলে ‘কুইবেকের দমকল কর্মীর জীবনের একদিন’ নামে একটি ছবি তুলেছেন। যেখানে বিশালাকৃতির এক পাথর বা উঁচু স্থান থেকে দূরে দেখছেন। নিঃসঙ্গতা ও দায়িত্বের মেলবন্ধনের প্রতিরূপ যেন এটি।
এ ছাড়া দীর্ঘমেয়াদি কিছু কাজের অংশবিশেষও রয়েছে প্রদর্শনীতে। ওয়াইং নাইগং-এর তোলা ‘তবু আমি আছি তোমাদের সঙ্গে’ শীর্ষক ছবিতে উত্তর চীনে বসবাসকারী জিউয়ার নামে ক্যান্সারে আক্রান্ত এক নারীর জীবন, পরিবারের সঙ্গে মেলবন্ধন তুলে ধরেছেন আলোকচিত্রী। ২০২২ সালে জিউয়ার মারা যান।
একজন আলোকচিত্রী সাংবাদিক জীবনের চরমতম ধৈর্য, আবেগ সংবরণ এবং অনেক ক্ষেত্রে বিপদের মাঝে পড়ে গেলেও সেখান থেকে খুঁজে আনেন চরম বাস্তবতার চিত্র, যা দেখে মানুষ নিজের বাস্তবতা ও প্রয়োজনীয়তার জায়গা উপলব্ধি করতে পারে সহজেই।
একজন বাবা সন্তানকে নিজ জীবনের থেকেও বেশি ভালোবাসেন ও আগলে রাখতে চান। কিন্তু মৃত্যুর পরও প্রিয় সন্তানের স্পর্শটুকু ছেড়ে আসতে চান না– এ বিষয় চিন্তা করলে যেমন বেদনাদায়ক মনে হয়, সেটাই আদোম আলতানের তোলা ‘বাবা হাহাকার’ ছবিটির দিকে তাকালে মনে হয়। তুরস্কে ২০২৩ সালের ভয়াবহ ভূমিকম্পের ফলে ৫৫ হাজারেরও বেশি মানুষ মারা যায়। সেই মৃত্যুর ভিড়ে মেসুত হাঞ্চের তাঁর ১৫ বছর বয়সী মেয়ে ইরমাকের হাত ধরে আছেন। ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়া মরদেহ থেকে শুধু হাতের অংশটুকু বেরিয়ে আছে। তা ধরে বাবা বসে আছেন। এএফপির জন্য তোলা আলতানের এ ছবি বিশ্বব্যাপী প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও ভবন নির্মাণের অসচেতনতার দিকে আঙুল তোলে। এ রকম বহু একক ও গুচ্ছ আলোকচিত্র নিয়ে চলা ওয়ার্ল্ড প্রেস ফটো প্রদর্শনীর ঢাকা সংস্করণ চলবে আগামী ১৪ নভেম্বর পর্যন্ত; প্রতিদিন বিকেল ৩টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত।
ছবি:: দৃক গ্যালারি ও ফয়সাল সিদ্দিক কাব্য
- বিষয় :
- আলোকচিত্র প্রদর্শনী