ঢাকা রবিবার, ০৬ জুলাই ২০২৫

সালতামামি

দেয়ালে প্রতিবাদের ভাষা

দেয়ালে প্রতিবাদের ভাষা

শিক্ষার্থীসহ দেশের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশা, ধর্ম-বর্ণের মানুষ দেয়ালে প্রতিবাদ ও নতুন অভ্যুদয়ের বার্তা লিখেছেন

সমকাল ডেস্ক

প্রকাশ: ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪ | ২৩:২৮ | আপডেট: ২৮ ডিসেম্বর ২০২৪ | ১৬:৫২

২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থান চলাকালে এক পর্যায়ে চারদিকে মরদেহের স্তূপের মাঝে একদল তরুণ রং-তুলি, পেইন্ট স্প্রে নিয়ে ঢাকাসহ সারাদেশের বিভিন্ন দেয়াল গ্রাফিতি এঁকে রাঙিয়ে তুলে প্রাণ সংশয়ের ভয় নিয়ে। সেই গ্রাফিতিগুলোতে উঠে আসে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগ থেকে শুরু করে গণহত্যার বিচারের দাবি।

ঢাকার ব্যস্ততম সড়ক বা এলাকার ছোট গলিতে মুখ ফেরালেই দেখা যেত স্প্রে, পেইন্টের রঙে রঙিন কাঁচাপাকা হাতের গ্রাফিতি। আবু সাঈদের মায়ের আহাজারি ‘হামার বেটাক মারলি কেনে?’, মুগ্ধর ‘এই পানি লাগবে পানি’, ‘রক্তাক্ত জুলাই’, ‘দেশটা কারও বাপের না’– এমন হাজারো প্রতিবাদী স্লোগান ও তরুণ প্রজন্মের দাবি উঠে আসে গ্রাফিতি আকারে। যেগুলো সাবেক প্রধানমন্ত্রীর সময়ে ক্ষমতার জোরে মুছে ফেলার ব্যর্থ চেষ্টা করা হয়। গ্রাফিতি আঁকার সময় পুলিশ দিয়ে শিক্ষার্থীদের বাধা দেওয়া হয়।

তবুও শিক্ষার্থীরা দমে যায়নি। তারা চুপিসারে গ্রাফিতি এঁকে প্রতিবাদ করে। ৫ আগস্ট সরকার পতন হয়। এরপর হঠাৎ করেই যেন আন্দোলনের সময়ে আঁকা গ্রাফিতি, পোস্টারে ভরে থাকা দেয়াল, মেট্রোরেলের পিলার, সড়ক বিভাজক, ঢাকার বিভিন্ন স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, প্রধান সড়কের দেয়াল পাল্টে যেতে থাকে। বিভিন্ন রঙে রঙিন হতে থাকে। ছোট্ট শিশু থেকে শুরু করে শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের সহায়তায় প্রতিবাদী তরুণরা যা যা চায় এবং মনের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটায় দেয়ালে দেয়ালে রং-তুলি দিয়ে। শাহবাগ, টিএসসি, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, মোহাম্মদপুর, বেইলি রোড, খিলগাঁও, মালিবাগ, মিন্টো রোড, মিরপুর, সেগুনবাগিচা, রামপুরাসহ পুরো ঢাকায় দেয়ালচিত্র এঁকে শিক্ষার্থীরা আন্দোলনের সময়ের বিভিন্ন স্মৃতি তুলে ধরে। সেই সঙ্গে দেশের প্রায় প্রতিটি শহরে তা ছড়িয়ে যায়।

বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভের আগে থেকেই একটি শব্দের সঙ্গে পরিচিত, সেটি হলো দেয়ালে ‘চিকা মারা’। চিকা মারাকে প্রতিবাদী দেয়াল লিখন বোঝাতো। বিভিন্ন প্রতিবাদী ভাষা চুপিসারে দেয়ালে লুকিয়ে লেখা হতো তখন। দেয়ালে চিকা মারার মধ্যে ‘আইজুদ্দিন’ ও ‘সুবোধ’ অনেক বেশি জনপ্রিয়। এই দুটো চরিত্র এক বা দুই শব্দে অনেক অধিকার ও দাবির কথাই বলে দিত আমাদের। সেই চিকা মারা থেকে প্রথানুযায়ী শিল্পমাধ্যম না হওয়া সত্ত্বেও গ্রাফিতি বর্তমানে প্রতিবাদের একটি অন্যতম ভাষা হিসেবে রূপান্তরিত হয়েছে। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে রং-তুলিকে প্রতিবাদী ভাষার মাধ্যম হিসেবে নিয়েছে শিক্ষার্থীরা। যেখানে স্পষ্টভাবে মনের ক্ষোভ তুলে ধরা হয়েছে। যেখানে কোনো রাখঢাক নেই। প্রথানুযায়ী শিল্পমাধ্যম না হওয়া সত্ত্বেও গ্রাফিতি সারাবিশ্বে প্রতিবাদের অন্যতম ভাষা হিসেবে রূপান্তরিত হয়েছে।

ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলের একদল শিক্ষার্থী দেয়ালে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের চিত্র আঁকছিল। আসফাক নামে একজন শিক্ষার্থী জানায়, ‘আমরা চাই বৈষম্যবিহীন একটা দেশ, যেখানে সবাই মিলেমিশে থাকব।’ অন্যদিকে ঢাকা আর্ট কলেজের ড্রইং অ্যান্ড পেইন্টিংয়ের শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী ফাতিমা এ লাবনী বলেন, ‘সবকিছুর পরে মনে হচ্ছে, এখন মন খুলে কথা বলতে পারছি, আঁকতে পারছি যা খুশি। নিজের ভাবনা তুলিতে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছি।’

তবে বিশ্লেষকদের মতে, গ্রাফিতি মূলত করা হয় কোনো আন্দোলন, দাবি তুলে ধরার জন্য চট জলদি করে চুপি চুপি। কারা করছে, তা জানা যায় না। আন্দোলনের সময় যেগুলো আঁকা হয়েছিল, সেগুলো ছিল আসল গ্রাফিতি। এখন যা আঁকা হচ্ছে তা দেয়ালচিত্র।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাস্কর্য বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মোহাম্মদ জাহিদুল হক বলেন, ‘যেসব গ্রাফিতি শিক্ষার্থীরা আন্দোলনের সময় এঁকেছিল স্প্রে পেইন্ট দিয়ে, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে, সেটাই হলো এই গণঅভ্যুত্থানের প্রেরণার উৎস। তবে এখন যা আঁকা হচ্ছে দেয়ালগুলোতে, তা খুবই চমৎকার। তবে আন্দোলনের সময় যে গ্রাফিতি আঁকা হয়েছিল সেগুলোকে আমি বলব– পিওর এক্সপ্রেশন। এ আন্দোলনের পর গ্রাফিতিও একটা মুভমেন্টের মতো হয়ে গেছে। তবে শিক্ষার্থীরা এতে যুক্ত হয়েছে, এটি খুবই ইতিবাচক। তবে আগের গ্রাফিতিগুলো মুছে ফেলা ইতিহাস মুছে ফেলার মতো একটা বিষয়। সেটি সমর্থনযোগ্য নয়।’ 

২৮ বছর আগে নিখোঁজ কল্পনা চাকমাকে যখন জেন-জেড প্রজন্ম দেয়ালচিত্রে তুলে ধরতে পারে, তখন নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন তাদের সঙ্গে আমরাও দেখতে পারি। চিকা মারা থেকে গ্রাফিতি নামে পরিবর্তিত হলেও প্রতিনিয়ত রাজনৈতিক বাস্তবতাকে আঙুল তুলে দেখানোতে কোনো পরিবর্তন হয়নি, সেটিই আবার প্রমাণিত হলো এই বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন ও গণঅভ্যুত্থানে।

আরও পড়ুন

×