বয়ঃসন্ধিকাল
ভালো থেকো ফুল, মিষ্টি বকুল

--
প্রকাশ: ২৯ জানুয়ারি ২০২২ | ১২:০০ | আপডেট: ৩০ জানুয়ারি ২০২২ | ০৩:২৭
বয়ঃসন্ধিকাল, জীবনের একটা বিশেষ সময়ের নাম। এই সময়ের মধ্য দিয়ে যেতে হয় প্রত্যেক মানুষকেই। শৈশবকাল শেষে কৈশোরে পা দেওয়ার মুহূর্তে শরীর ও মনে যে পরিবর্তনের দোলা লাগে, এ সময় যে কিশোর-কিশোরীদের প্রয়োজন বাড়তি মনোযোগ, তা নিয়ে আমাদের সমাজ ও পরিবারের মধ্যে রয়েছে সচেতনতার অভাব। ইউনিসেফের সবশেষ তথ্যমতে, বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ৩ কোটি ৬০ লাখ ১০ থেকে ১৯ বছর বয়সী কিশোর-কিশোরী। যারা এ দেশের মোট জনসংখ্যার ২২ শতাংশ। এই সময়ের নানা পরিবর্তন ও প্রয়োজনীয় কর্মকাণ্ড কী হতে পারে, তা নিয়ে লিখেছেন ডা. নাফিসা আবেদীন
বয়ঃসন্ধিকালে ছেলে ও মেয়ে উভয়ের শরীর ও মনে নানা ধরনের পরিবর্তন ঘটে। এ সময়ে ছেলেমেয়েরা যেমন দ্রুত বেড়ে উঠতে থাকে, তেমনি তাদের চিন্তা-চেতনায় দেখা দেয় ব্যাপক পরিবর্তন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ১০ ও ১৯ বছর বয়সের মাঝামাঝি সময়টাকে কৈশোর বলে। এর যে কোনো সময়ে বয়ঃসন্ধিকাল আসতে পারে। এটা মূলত কৈশোর ও যৌবনের মধ্যবর্তী পর্যায়।
চিকিৎসকদের মতে, মেয়েদের বয়ঃসন্ধিকাল ছেলেদের চেয়ে কিছুটা আগে শুরু হয়। মূলত ১০ থেকে ১৩ বছরের মধ্যে যে কোনো সময় তা হতে পারে। অন্যদিকে ছেলেদের ক্ষেত্রে বয়ঃসন্ধিকাল আসে ১১ থেকে ১৫ বছর বয়সের মধ্যে। এ বয়সে মেয়েদের উচ্চতা বাড়ে। শরীরের বিভিন্ন অংশ স্ম্ফীত হয়। মাসিক শুরু হয়। তেমনি ছেলেদের ক্ষেত্রে, এ সময় তাদের দেহের উচ্চতা দ্রুতগতিতে বাড়তে থাকে, গলার স্বর ভারী হয়ে আসে, কাঁধ চওড়া হয়, পেশি সুগঠিত হয়। মুখে দাড়ি-গোঁফ ওঠে, এই সময়ে ছেলেরা একটু বেশি ঘামে।
বয়ঃসন্ধির এই সময়টা ছেলেমেয়ে উভয়ের প্রজনন ক্ষমতায় বিকাশ হতে থাকে বলে বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ বোধ হয়। অনেক সময় ঘুমের মধ্যে ছেলেদের বীর্যস্খলন হয়ে থাকে; যা অস্বাভাবিক কিছু নয়। এটি বয়ঃসন্ধির একটি লক্ষণ। দেহের আকস্মিক পরিবর্তন তার মনোজগতের ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলে। এ সময় কিশোর-কিশোরীরা আত্মনির্ভর হতে চেষ্টা করে। এ সময়ের মানসিক পরিবর্তনগুলো হলো- অজানাকে জানার আগ্রহ তৈরি হয়। আকস্মিক শারীরিক পরিবর্তনের কারণে দ্বিধাদ্বন্দ্ব ও লজ্জা কাজ করে। স্বাধীনভাবে চলাফেরার আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়। অনেক নতুন বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে মেলামেশা হয়। আপনজনদের কাছে স্নেহ-ভালোবাসা ও গুরুত্ব পাওয়ার তীব্র ইচ্ছা জন্মে। সহজেই আবেগতাড়িত হয়। মানসিক পরিপকস্ফতা হতে শুরু করে। আচরণিক পরিবর্তন বয়ঃসন্ধিকালে আশপাশের পরিচিত বা অপরিচিত মানুষ হঠাৎ করেই কিশোর-কিশোরীদের নিয়ে ভাবতে শুরু করে। খাবারদাবারের প্রতি অনীহা দেখায় এবং কিশোরীরা কম খেয়ে ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে চায়।
বয়ঃসন্ধিকালে পদার্পণ করা একেকটি ছেলেমেয়ে এবং এদের ঘিরে থাকা পরিবার ও সমাজের অন্য সদস্যরা খুব সহজেই তাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব অনুভব করতে পারেন। যে ছেলেমেয়ে কেবল বয়ঃসন্ধিকালে পা রেখেছে তারা দেখতে পায়, যে মানুষগুলো তাদের সঙ্গে কিছুদিন আগেও ভালো করে কথা বলেছে, তাদের আদর করেছে, তাদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করেছে তারা কেমন যেন বিপরীত আচরণ করছে। অন্য পক্ষে পরিবার ও পরিবারের বাইরের যে মানুষগুলো দেখে এসেছে যে ছেলে কিংবা মেয়েটা তাদের সঙ্গে খুবই সুন্দর আচরণ করেছে ও নমনীয় ছিল, সে হঠাৎ করে কেমন যেন খিটখিটে হয়ে গেছে। বয়ঃসন্ধিকালে বিভিন্ন কারণে দ্বন্দ্ব বা সংঘাত হতে পারে। যে কারণগুলো এই দ্বন্দ্বের জন্য দায়ী, সেগুলোর মধ্যে উলেল্গখযোগ্য কয়েকটি হলো- মূল্যবোধ ও এর গুরুত্বের পার্থক্য দেখা দিলে দ্বন্দ্ব হতে পারে, কিশোর-কিশোরী বয়ঃসন্ধিকালে নিজেদের মতামত ও সিদ্ধান্তের প্রতি অটল থাকতে চায়; এটিও দ্বন্দ্বের কারণ।
কিন্তু এই সময় গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় হচ্ছে, বাড়ন্ত বাচ্চাদের খাওয়াদাওয়া। শৈশব থেকে বার্ধক্য পর্যন্ত জীবনের নানা সময়ে নানা কারণে প্রোটিনের প্রয়োজন হলেও, বয়ঃসন্ধিকালে অর্থাৎ অ্যাডোলেসেন্স পিরিয়ডে প্রোটিনের প্রয়োজন অনেকটাই বেশি। বৈজ্ঞানিক যুক্তিতে, মানবশরীরে এমন কিছু সময় আসে, যখন খুব দ্রুত শারীরিক বৃদ্ধি ঘটে। একে বৈজ্ঞানিক ভাষায় 'গ্রোথ স্পার্ট' বলা হয়। অনেকেই হয়তো এই গ্রোথ স্পার্টের গুরুত্ব জানেন না। মানবজীবনে দু'বার গ্রোথ স্পার্ট দেখা যায়। প্রথম গ্রোথ স্পার্ট ঘটে জন্মের ১২ মাসের মধ্যে এবং দ্বিতীয় গ্রোথ স্পার্ট দেখা যায় বয়ঃসন্ধিকালে। এই সময় উচ্চতা, ওজন ইত্যাদির পাশাপাশি মানসিক ও শারীরিক পূর্ণতা আসে। পুষ্টি এবং সার্বিক বৃদ্ধির জন্য এই দ্বিতীয় গ্রোথ স্পার্ট খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ছেলেদের ক্ষেত্রে এটি শুরু হয় মোটামুটি ১২ বছর থেকে এবং মেয়েদের ক্ষেত্রে ১০ বছর বয়স থেকে। এই সময় বাচ্চাদের পুষ্টির দিকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। কারণ এই দ্বিতীয় গ্রোথ স্পার্টকেই শারীরিক বৃদ্ধির শেষ সুযোগ বলে ধরা হয়। অর্থাৎ এই বয়সে সঠিক পুষ্টি না পেলে, সার্বিক বৃদ্ধিতে ব্যাঘাত ঘটতে পারে এবং পরবর্তীকালে সেই ঘাটতি পূরণ করারও সম্ভাবনা কম। তাই দ্বিতীয় গ্রোথ স্পার্টে সঠিক মাত্রায় প্রোটিন, ক্যালসিয়াম, ভিটামিন ডি এবং আয়রন খাওয়ানো এ কান্তই জরুরি।
রোজকার খাবারে আমরা প্রোটিন গ্রহণ করি ঠিকই, কিন্তু তার পরিমাণ সম্পর্কে আমরা বিশেষ গুরুত্ব দিই না। শরীরে কতটা প্রোটিনের প্রয়োজন তা মূলত নির্ভর করে দুটি বিষয়ের ওপর- তৎকালীন লিন বডি মাস এবং গ্রোথ স্পার্টের ফলে বডি মাসের যা বৃদ্ধি হয়েছে, তার ওপর। মেয়েদের ক্ষেত্রে শারীরিক প্রোটিনের চাহিদা সব থেকে বেশি থাকে ১১-১৪ বছর পর্যন্ত এবং ছেলেদের ক্ষেত্রে ১৫-১৮ বছর পর্যন্ত। কারণ সাধারণত এই বয়সেই শরীরের সর্বাধিক বৃদ্ধি দেখা যায় এবং যেসব ফ্যাক্টর শারীরিক বৃদ্ধিতে সহায়তা করে, প্রত্যেকটির উৎপাদনের জন্যই প্রোটিনের প্রয়োজন হয়। এই ফ্যাক্টরগুলোকে মূলত গ্রোথ ফ্যাক্টর বলা হয়।
বয়ঃসন্ধিতে থাকা ছেলেমেয়েরা ভীষণ কৌতূহলপ্রবণ হওয়ায় অনেক সময় তাদের বিপথগামী হওয়ার, মাদকের নেশায় জড়িয়ে পড়া, অযাচিত ঝুঁকি নেওয়া বা অপসংস্কৃতিতে জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকে।
সে ক্ষেত্রে পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনকে সচেতন ভূমিকা রাখতে হবে।
এ ক্ষেত্রে সন্তানের সঙ্গে তর্কযুদ্ধে লিপ্ত হওয়া বা কোনোভাবেই সেসব গায়ে তোলা যাবে না। যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য সম্পর্কে কিশোর-কিশোরীদের সচেতন করতে পরিবার বড় ধরনের ভূমিকা রাখতে পারে। মা-বাবা, বড় ভাই বা বোন এ ক্ষেত্রে মূল ভূমিকা পালন করতে পারেন। অভিভাবকসুলভ আচরণ নয়, তাদের সঙ্গে বন্ধুর মতো আচরণ করতে হবে।
- বিষয় :
- বয়ঃসন্ধিকাল
- বয়ঃসন্ধি
- মেয়েদের বয়ঃসন্ধিকাল