ঢাকা সোমবার, ০৭ জুলাই ২০২৫

এ কোন পথে হাঁটছে বাংলাদেশ

এ কোন পথে হাঁটছে বাংলাদেশ

রণেশ মৈত্র

প্রকাশ: ১৯ অক্টোবর ২০১৯ | ১৪:৫২

যে মাসটি আমরা অতিক্রম করে এলাম অর্থাৎ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ এবং যে মাসটি অতিক্রম করছি- অক্টোবর, তা ভয়ংকর। এই সময়ে যা আমরা প্রত্যক্ষ করছি, তা কল্পনাতীত সব কল্পনাকে হার মানানো। এক কথায়, মারাত্মক ও বীভৎস। দেখলাম প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে (তাঁর নির্দেশ কেন প্রয়োজন তা দুর্বোধ্য) বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক, এ দুই শীর্ষ নেতাকে হঠাৎ ওই সংগঠনের নিজ নিজ পদ থেকে পদচ্যুত করা হলো বিশাল অংকের চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি চালানোর অভিযোগে। আবার এটাও দুর্বোধ্য, অমন মারাত্মক ফৌজদারি অপরাধ করা সত্ত্বেও তাদের বিরুদ্ধে আজও কোনো থানায় সুনির্দিষ্ট মামলা দায়ের হলো না বা তারা কেউ গ্রেফতারও হলো না! শুধু জানা যায়, তাদের সয়-সম্পত্তি কী আছে-না আছে তার খোঁজখবর করা হচ্ছে।

এর পর দিন দুয়েক যেতে না যেতেই প্রধানমন্ত্রী বলে বসলেন, 'ছাত্রলীগের পর এবার যুবলীগকে ধরা হবে।' আর যায় কোথা? আমাদের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তৎপর হলো, র‌্যাব অভিযান শুরু করল; কয়েকজন যুবলীগ নেতা গ্রেফতার হলো। সন্ধান মিলল তাদের আস্তানায় শতাধিক কোটি টাকার বাংলাদেশি মুদ্রা, হাজার হাজার মার্কিন ডলার, আইনি-বেআইনি অস্ত্র, অসংখ্য মদের বোতল ইত্যাদি। আর আবিস্কার হলো ক্যাসিনোর, যার নাম আমি জীবনে এই প্রথম শুনলাম। ক্যাসিনোতে জুয়া খেলে তারা নাকি দিনে-রাতে কোটি কোটি টাকা আয় করত, যার সবটাই বেআইনি। মানুষ এসব দেখে বিস্মিত ও স্তম্ভিত। কীভাবে বিগত ১০টি বছর ধরে প্রকাশ্যে দিবাভাগে ও রাত্রিকালে, রীতিমতো সব মহলের জ্ঞাতসারে, এমন অবৈধ কারবারে বছরের পর বছর ধরে দলে দলে লিপ্ত থাকতে পারল! বিন্দুমাত্র গোপনীয়তা রক্ষা না করলেও তাদের বিরুদ্ধে সামান্যতম আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হলো না! কারণ যদি এটা হয়ে থাকে, এর সঙ্গে বহু সংখ্যক রুই-কাতলা এবং অপরাপর প্রভাবশালী মহল জড়িত, তাহলে তো বলতেই হয়, দুর্বলেরা অপরাধ করলে শাস্তি পাবে; সবলেরা নয়। দেশবাসী নিশ্চিতভাবে দেখতে চান, আমাদের পেনাল কোডের কত নম্বর ধারায় এমন বৈষম্যমূলক আইনের ব্যবহারের নির্দেশনা দেওয়া আছে। নতুবা ওইসব প্রভাবশালীর বিরুদ্ধে অবিলম্বে ব্যবস্থা নেওয়া হোক। আর যদি তেমন কোনো বৈষম্যমূলক আইন ব্যবহার করার কোনো বিধান পেনাল কোডে না থেকে থাকে এবং পেনাল কোডের অবশ্য পালনীয়।

অবাক বিস্ময়ে দেখা গেল, বিপথগামী যুবলীগ নেতা ইসমাইল হোসেন সম্রাটের বিস্তর অপরাধের খবর নানা সূত্র থেকে সংগ্রহ করে সংবাদপত্রগুলোতে প্রকাশিত হওয়া সত্ত্বেও তাকে গ্রেফতার করা হচ্ছিলই না। তার হদিস সম্পর্কে কোনো তথ্যও জানা যাচ্ছিল না। সবাই ভাবছিলেন, সম্রাট হয়তো কোন ফাঁকে দেশ থেকে অন্য কোথাও পালিয়ে গেছে সবার চোখকে ফাঁকি দিয়ে। এমন সময় হঠাৎ পাওয়া গেল তার গ্রেফতারের খবর, তাও প্রধানমন্ত্রী বিদেশ সফর শেষে দেশে ফেরার দিন কয়েক পর। অনুমান করতে আদৌ কোনো কষ্ট হয় না, প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে কড়া নির্দেশ না পাওয়া পর্যন্ত তাকে গ্রেফতার করার উদ্যোগ কেউ নেননি; যদিও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী স্বয়ং বলেছিলেন, 'সম্রাট গোয়েন্দা নজরদারিতে আছে।' যদি তাই হয়, তবে দীর্ঘ তিন সপ্তাহ গ্রেফতার করা হলো না কেন? স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এই সঙ্গত প্রশ্নটির জবাব না দিয়ে নিশ্চুপ থাকতে পারে না। সম্রাটকে ধরা হলো কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে জামায়াতে ইসলামীর এক নেতার বাড়ি থেকে, মস্ত বড় অভিযান চালিয়ে, সম্রাটের সব অপকর্মের এক সহযোগী আরমানসহ। যুবলীগ নেতা আশ্রয় নেন জামায়াতে ইসলামীর এক নেতার বাড়িতে। সেখানে নিরাপত্তা নিশ্চিত ভেবে জামায়াত নেতাও যুবলীগ নেতাদের আশ্রয় দেন, নিরাপত্তা দেন; নিশ্চিতই বিপুল পরিমাণ প্রাপ্তিযোগের কল্যাণে। এতে বুঝি ওই জামায়াত নেতার যথেষ্ট 'সওয়াব'ও হয়। আবার যুবলীগ নেতারা, যারা দিবারাত্র 'বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিক' বলে গলা ফাটাতে কসুর করেন না তারা দিব্যি জামায়াত নেতার বাড়িতে এভাবে বঙ্গবন্ধুর সুমহান আদর্শের প্রতি ইচ্ছাকৃত অবমাননা এবং তার দ্বারা মানুষকে বিভ্রান্ত করার অপচেষ্টা আর কত? তথ্য হলো, এই সম্রাটই  আওয়ামী লীগ, যুবলীগের বড় বড় সমাবেশে বঙ্গবন্ধুর নামে ও জয় বাংলা বলে স্লোগান দিয়ে লাখো লোক সরবরাহ করে নেতাদের নজর কাড়তে সক্ষম হয়েছিল এবং সেভাবেই যুবলীগ নেতৃত্ব্বের পদে অধিষ্ঠিত হতে পেরেছিল। কী কলঙ্কজনক ঘটনাবলিই না ঘটছে এবং প্রত্যক্ষ করতে হচ্ছে মানুষকে! সর্বশেষ ঘটনাটি ঘটল বুয়েটে। ভয়াবহ, নৃশংস ঘটনাই বটে এবং তা ঘটাল ছাত্রলীগ নেতারা। এ ব্যাপারে একটি বহুল প্রচারিত সংবাদপত্র তাদের ৮ অক্টোবর তারিখে প্রকাশিত সংখ্যায় লিখেছে :কোনো কিছুতেই থামছে না ছাত্রলীগ, চাঁদাবাজি আর নির্মাণকাজ থেকে কমিশন। বেআইনিভাবে চাঁদার দাবিসহ নানা অভিযোগের প্রমাণ পেয়ে সংগঠনের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদককে বাদ দেওয়া হয়েছে। ক্যাসিনো, জুয়া আর অবৈধ সম্পদ অর্জনের দায়ে যুবলীগ, কৃষক লীগসহ  অন্য সহযোগী সংগঠনের নেতাদের বিরুদ্ধে অভিযান চলছে। এরই মধ্যে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যা করল ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা।

প্রায় ১১ বছর ধরে ছাত্রলীগ মূলত আলোচনায় এসেছে হত্যা, চাঁদাবাজি, ছিনতাই কিংবা টেন্ডারবাজির কারণে। সম্প্রতি একইভাবে মেধাবী শিক্ষার্থী আবরারকে হত্যা করে আবারও শিরোনামে এলো ছাত্রলীগ। ভালো কাজের জন্য ছাত্রলীগ গণমাধ্যমের শিরোনাম হয়েছে- এমন নজির নিকট অতীতে  খুঁজে পাওয়া ভার। অথচ ঐতিহ্যবাহী সংগঠনটির অতীতকালের সংগ্রামের বিষয়টি মুক্তিযুদ্ধের আগে ও যুদ্ধ চলাকালে ইতিহাসে স্থান পেয়েছে প্রবীণ শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী পত্রিকায় সাক্ষাৎকারে বলেন, ফেসবুকে কোনো একটা মত প্রকাশের কারণে বুয়েটের একজন শিক্ষার্থীকে মেরে ফেলা হয়ে থাকলে তা খুবই হতাশাজনক। বিশ্ববিদ্যালয়ে যদি মত প্রকাশের স্বাধীনতা না থাকে, তা হলে আর কী বাকি থাকল? তাঁর মতে, ছাত্রলীগ এখন যা করছে এটা কোনো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নয়। তাদের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, ঠিকাদারি কাজ থেকে কমিশন নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। তিনি বলেন, একদিকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে উপাচার্যদের দুর্নীতির খবর প্রকাশিত হচ্ছে, অন্যদিকে ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে জড়িতরা নৃশংসতা করছে। আমরা তো অন্ধকারেই আচ্ছন্ন হয়ে পড়ছি। এভাবে তো চলতে পারে না। আওয়ামী লীগের নেতাদের একটি অংশ ছাত্রলীগ ও যুবলীগের কর্মকাণ্ড নিয়ে ক্ষুুব্ধ। প্রকাশ্যেই তারা তাদের ক্ষোভ প্রকাশ করছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও সাম্প্রতিক সময়ে একাধিক অনুষ্ঠানে তাদেরকে সতর্ক করেছেন। কিন্তু ছাত্রলীগ ও যুবলীগের এই জাতীয় কর্মকাণ্ড বন্ধ হয়নি। ২০০৯ সালে এই সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে কয়েকটি নিষ্ঠুর ও নৃশংস ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে  পড়ে ছাত্রলীগের নাম। এক হিসাবে  ২০০৯ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ছাত্রলীগের নিজেদের কোন্দলে নিহত হয় ৩৯ জন। আর এই সময়ে ছাত্রলীগের হাতে প্রাণ হারায় অন্য সংগঠনের ১৫ জন।

সাধারণ শিক্ষার্থীদের স্বার্থসংশ্নিষ্ট কোনো কাজে ছাত্রলীগকে খুঁজে পাওয়া না গেলেও বারবার তাদের ন্যায্য আন্দোলনে হামলা চালিয়েছে সংগঠনটির কর্মীরা। কোটা সংস্কার ও নিরাপদ সড়কের দাবিতে পরিচালিত জনপ্রিয় আন্দোলনে সাধারণ শিক্ষার্থীদের মারধর করার অসংখ্য অভিযোগ তাদের বিরুদ্ধে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের ভিপি নুরুল হকের ওপর ঢাকা ও ঢাকার বাইরে অন্তত সাতবার হামলা চালিয়েছে ছাত্রলীগ। আরও অসংখ্য অভিযোগ তথ্য-প্রমাণসহ হাজির করা যায় ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে। মূল দল আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকার সুযোগের অপব্যবহার করে তার মূলে 'জয় বাংলা' স্লোগান দিয়ে। তাই ভেবে দেখা প্রয়োজন, কেমন ধরনের ছাত্র-যুব-কৃষক সংগঠন কেমন ধরনের সহযোগী বা অঙ্গ সংগঠনের প্রয়োজন দেশের রাজনীতির স্বার্থে। এ ভাবনাকে উপেক্ষা করার আর সময় নেই। ইতিমধ্যে অনেক বিলম্ব ঘটে গেছে। বিভাগউত্তর এদেশের রাজনীতি, আন্দোলন-সংগ্রাম, সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ, বিজয়, স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ যাদের অকুতোভয় সংগ্রাম ও অবদানে সমৃদ্ধ; ছাত্রলীগ-যুবলীগ তাদের মধ্যে এক বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে থাকলেও স্বৈরাচার পতনের পরবর্তীকাল থেকে তাদের যে অবক্ষয় ঘটেছে, তা দেশে সমগ্র রাজনীতিকে কলুষিত করে ফেলেছে। ছাত্রলীগ, যুবলীগ, কৃষক লীগ বা তাদের মতো সংগঠনের অস্তিত্বের প্রয়োজনে  কতটা কী করা প্রয়োজন, তাও ভাবা দরকার। জরুরি ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেওয়াও অপরিহার্য। যে উল্টো পথে হাঁটছে বাংলাদেশ, সেটি বড্ড ক্ষতিকর।

রাজনীতিক ও প্রবীণ সাংবাদিক
[email protected]


আরও পড়ুন

×