আন্তর্জাতিক
ভেনেজুয়েলার অগ্নিপরীক্ষার দিন

নিকোলাস মাদুরো
বিজয় প্রসাদ
প্রকাশ: ২৭ জুলাই ২০২৪ | ২৩:১৫ | আপডেট: ২৮ জুলাই ২০২৪ | ১২:৪০
আজ ভেনেজুয়েলার জনগণ ১৯৯৯ সালে গৃহীত বলিভারিয়ান সংবিধানের অধীনে ষষ্ঠ প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভোট দিচ্ছে। আগের দুটি নির্বাচনে (২০১৩ ও ২০১৮) বর্তমান প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরো মোরোস জিতেছিলেন। মাদুরো তৃতীয় মেয়াদের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন, যা ২০২৫ সালে শুরু হয়ে ছয় বছর চলবে। তিনি বাম ও গণতান্ত্রিক দলগুলোর একটি বিশাল জোটের নেতৃত্ব দিচ্ছেন, যারা ২৫ বছর আগে সংঘটিত বলিভারিয়ান বিপ্লবকে রক্ষা করতে একত্র হয়েছে।
মাদুরোকে ভেনেজুয়েলা ও বলিভারিয়ান বিপ্লবী প্রক্রিয়া– উভয়েরই নেতৃত্ব দিতে হচ্ছে হুগো শ্যাভেজের মৃত্যুর পর থেকে, যিনি ভেনেজুয়েলার রাজনীতিতে অলিগার্কি বা কতিপয়তন্ত্রের মৌরসিপাট্টা ভেঙে দিয়েছিলেন। ২০১৫ সালে তেলের দামের পতনের পাশাপাশি বলিভারিয়ান বিপ্লব ধ্বংসে যুক্তরাষ্ট্রের স্যাংশন বা অবরোধরূপী ক্রমবর্ধমান শ্বাসরোধের কর্মসূচি শুরু হয়। তখন থেকেই মাদুরো এ উভয় সংকট মোকাবিলা করে চলেছেন। নিঃসন্দেহে একদিকে জনমোহিনী হুগো শ্যাভেজের যথার্থ উত্তরাধিকার হওয়া এবং অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি উত্তাল ঢেউয়ের বিপরীতে জাহাজ পরিচালনা করতে গিয়ে মাদুরো এ গ্রহের সবচেয়ে কঠিন কাজগুলোর মধ্যে একটি করছেন। তবে সব হিসাব বলছে, মূলত বিরোধীদের জঘন্য চরিত্রের কারণে আজ মাদুরোই জয়ী হবেন।
বিরোধী শিবিরের চরম ডানপন্থি প্রার্থী
মাদুরোর মুখোমুখি হচ্ছেন এডমুন্ডো গনজালেজ উরুতিয়া, চরম ডানপন্থি এক প্রার্থী। গনজালেজকে তাঁর শিবির দাদা হিসেবে চিত্রিত করছে, যদিও তিনি মাদুরোর চেয়ে মাত্র ১৩ বছরের বড় (মাদুরোর জন্ম ১৯৬২ সালে আর গনজালেজের ১৯৪৯ সালে)। তাঁকে আবুয়েলো (দাদা) হিসেবে তুলে ধরার উদ্দেশ্য তাঁর আরও উগ্র রাজনৈতিক প্রকল্প ও পটভূমিকে আড়াল করা। গনজালেজ ইউনিটারি প্ল্যাটফর্মের নেতৃত্বে আছেন, যা জুয়ান গুয়াইদো ২০২১ সালে তৈরি করেন। গুয়াইদো ছিলেন সেই অজ্ঞাতকুলশীল নেতা, যাকে ২০১৯ সালে যুক্তরাষ্ট্র প্রেসিডেন্ট বানানোর চক্রান্ত করেছিল (একই মার্কিন নীলনকশা অবশ্য ইউক্রেনে সফল হয়েছিল, যখন মার্কিন সরকার আর্সেনি পেট্রোভিচ ইয়াতসেনিউককে ইউক্রেনের প্রধানমন্ত্রী পদে বসিয়েছিল)।
দি ইউনিটারি প্ল্যাটফর্ম বা এর স্প্যানিশ নামের সংক্ষিপ্ত রূপ–পিইউ, অতি ডানপন্থি রাজনীতিবিদদের একত্র করে, যারা মার্কিন সরকারের কাছ থেকে (যেমন– মারিয়া কোরিনা মাচাডো ও লিওপোল্ডো এডুয়ার্ডো লোপেজ মেন্ডোজা) অর্থ ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। ব্যক্তিগত আলাপে পিইউ সদস্যরা বলে যে তারা ভেনেজুয়েলায় কোনো নির্বাচনে জিততে পারবে না; মার্কিন অবরোধের কারণে দুর্ভোগ সত্ত্বেও জনসাধারণের ওপর মাদুরোর প্রভাব অমলিন। এ কারণে কোরিনা মাচাদো ও লোপেজের মতো লোকেরা ভেনেজুয়েলার ওপর মার্কিন বলপ্রয়োগের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন এবং এ দেশবিরোধী অবস্থানের কারণে তারা নির্বাচনে অংশ নিতে পারছেন না।
এ কারণেই পিইউ গনজালেজকে প্রার্থী হিসেবে বেছে নিয়েছে। যদিও গনজালেজ বা তাঁর অনুসারীরা নির্বাচনী প্রচারে কোনো বাস্তব বিকল্প প্রকল্প উপস্থাপন করতে পারছে না। তাদের একমাত্র বক্তব্য, তারা মাদুরো নয় এবং তারা মার্কিন দাবির কাছে নতিস্বীকার করে অর্থনীতির উন্নতি করতে পারবে। গনজালেজ নিজের অতীতকে অনেকাংশে আড়াল করে রেখেছেন। ১৯৮১ সালের জুলাই মাসে গনজালেজকে এল সালভাদরের ভেনেজুয়েলা দূতাবাসে পাঠানো হয়েছিল। তখন সেখানকার কলম্বিয়ান কূটনীতিক মারিয়া কাতালিনা রেস্ট্রেপো পিনজোন ডি লন্ডোনো রিপোর্ট করেছিলেন, গনজালেজ বামপন্থি গেরিলাদের বিরুদ্ধে ডেথ স্কোয়াডের হয়ে কাজ করেছিলেন। ওই গেরিলা নেতাদের একজন, নাদিয়া দিয়াজ, তাঁর আত্মজীবনীতে (নুনকা এস্টুভ সোলা) লিখেছেন, তিনি যখন কারাগারে ছিলেন, তখন তাঁকে নির্যাতনকারীদের মধ্যে ভেনেজুয়েলার পুরুষও ছিল। দিয়াজ বলেননি যে গনজালেজ সরাসরি তাঁকে নির্যাতন করেছিলেন। তবে অবশ্যই তিনি ওই অভিযানে অংশগ্রহণকারীর মধ্যে ছিলেন। এই হলো মাদুরোর বিরুদ্ধে অতি ডানপন্থিদের প্রার্থী ‘দাদা’র চরিত্র।
নিষেধাজ্ঞার ভার
ওয়াশিংটন পোস্টের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, বর্তমানে বিশ্বের এক-তৃতীয়াংশ দেশের বিরুদ্ধে অবৈধ ও একতরফা মার্কিন অবরোধ বা নিষেধাজ্ঞা বলবৎ আছে, যাদের ৬০ শতাংশ দরিদ্র দেশ। এই মার্কিন অবরোধ হুগো শ্যাভেজের সরকারকে উৎখাত করার জন্য ২০০৫ সালে প্রথম প্রয়োগ করা হয়, ভেনেজুয়েলার অর্থনীতিতে যার ছাপ স্পষ্ট। একসময়ে ভেনেজুয়েলার আয়ের ৯০ শতাংশ তেল থেকে আসত। ২০১৪ সালের মাঝামাঝি সময়ে তেলের দর পতনের সঙ্গে সেই আয়ের পথ বন্ধ হয়। মার্কিন বর্ধিত নিষেধাজ্ঞা এবং ভেনেজুয়েলার বিরুদ্ধে সশস্ত্র হামলার হুমকির কারণে সে সংকট আরও গভীর হয়। দেশটির সঙ্গে সম্পর্কিত বিদেশি আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও শিপিং কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞার প্রভাবে ভেনেজুয়েলার রাজস্ব আরও শুকিয়ে যায়। এ পরিস্থিতিতে বলিভারিয়ান প্রকল্পগুলোর মৌলিক প্রয়োজন পূরণে রাষ্ট্রকে কিছু জরুরি পদক্ষেপ নিতে হয়েছে।
২০১৪ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে বেশ কয়েকবার সফরের সময় আমি বিশেষত, ভেনেজুয়েলায় অবরোধের ক্ষতিকারক প্রভাব এবং মাদুরোর রাজনৈতিক সংহতি রক্ষার প্রয়াস দেখেছি। আমি ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাজধানী কারাকাসে ছিলাম, তখন জাতিসংঘের বিশেষ রেপোর্টিয়ার আলেনা ডোহান মার্কিন অবরোধের প্রভাব সম্পর্কে একটি সংবাদ সম্মেলন করেছিলেন। ওই সংবাদ সম্মেলনে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছিল, ‘প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি, খুচরা যন্ত্রাংশ, বিদ্যুৎ, পানি, জ্বালানি, গ্যাস, খাদ্য ও ওষুধের অভাব; চিকিৎসাকর্মী, প্রকৌশলী, শিক্ষক, অধ্যাপক, বিচারক ও পুলিশের মতো যোগ্য কর্মীদের ক্রমবর্ধমান অপ্রতুলতা–যাদের অনেকেই, বিশেষ করে উন্নত অর্থনৈতিক সুযোগের জন্য দেশ ছেড়েছেন; জীবনের অধিকার, খাদ্য, স্বাস্থ্য, উন্নয়নসহ মানবাধিকারের সমস্ত বিভাগের ওপর বিশাল প্রভাব ফেলেছে।’ অবশ্য ২০২১ সাল থেকে বর্তমানে পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। মূলত ভেনেজুয়েলার সরকার এবং বিরোধীদের মধ্যে ২০২৩ সালের অক্টোবরে স্বাক্ষরিত বার্বাডোজ চুক্তি এবং ভেনেজুয়েলার সঙ্গে অন্যান্য দেশ (যেমন– চীন, ইরান, রাশিয়া ও তুরস্ক) বাণিজ্য শুরু করার কারণে। কিন্তু সামনের পথ কঠিন ও দীর্ঘ।
অবরোধ এই নির্বাচনের প্রধান ইস্যু। যদি তারা নির্বাচনকে সুষ্ঠু বলে মনে করে, তাহলে বার্বাডোজ চুক্তির আওতায় মার্কিন নিষেধাজ্ঞাগুলো শিথিল হতে পারে। তবে যুক্তরাষ্ট্র এটা করবে ভেনেজুয়েলার জনগণকে সাহায্য করার জন্য নয়, বরং ইউরোপকে জ্বালানি সরবরাহ করতে আরও ভেনেজুয়েলার তেল বাজারে আনার চেষ্টা হিসেবে। বিশেষত, রাশিয়ার ওপর দেওয়া অবরোধের কারণে বিষয়টি ওদের জন্য জরুরি। কিন্তু এখানে অনেক দ্বন্দ্ব রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র অবশ্যই নির্বাচনের বৈধতা অস্বীকার করবে, যদি মাদুরো জয়ী হয় এবং তখন ভেনেজুয়েলার তেল ইউরোপীয়দের জন্য সরবরাহ করা অসম্ভব হবে। ২০২০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অবরোধই ছিল মূল ইস্যু।
মাদুরোর প্রচার সমাবেশগুলো ছিল লোকে ভরপুর। শ্যাভেজপন্থিরা সেখানে উল্লাসে ফেটে পড়েছে, তাদের লাল শার্টগুলো ভেনেজুয়েলার উষ্ণ আকাশের নিচে ঘামে ঝলমল করেছে। ‘আমরা জয়ী হব’– বলছিলেন সাবেক এক বাসচালক, যার হাস্যরসপূর্ণ বক্তৃতাগুলো ছিল প্রতিবাদী। এখানে কোনো ফাঁকি নেই। মাদুরোর বক্তব্য পরিষ্কার, ভেনেজুয়েলাকে পরীক্ষায় ফেলা হয়েছে। ভেনেজুয়েলার জনগণ কি বলিভারিয়ান প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখবে, নাকি কতিপয়তন্ত্রের ভয়ানক অতীতে ফিরে যাবে?
বিজয় প্রসাদ: ভারতীয় সাংবাদিক ও ইতিহাসবিদ; শ্রীলঙ্কা গার্ডিয়ান থেকে ভাষান্তর সাইফুর রহমান তপন
- বিষয় :
- আন্তর্জাতিক
- নির্বাচন
- ভেনিজুয়েলা