শিক্ষাঙ্গন
ছাত্র রাজনীতির বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের ক্ষোভ যে কারণে

ড. আজিজুর রহমান
আজিজুর রহমান
প্রকাশ: ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ১০:১৬
ইদানীং পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ছাত্র রাজনীতি নিয়ে বেশ কথাবার্তা হচ্ছে। একটি অনলাইন জরিপের সূত্রে দাবি করা হয়েছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ৮৩ দশমিক ৮ শতাংশ শিক্ষার্থী ক্যাম্পাসে দলীয় রাজনীতি ‘একেবারেই নিষিদ্ধ’ চান এবং ৮১ দশমিক ৯ শতাংশ শিক্ষার্থী নিয়মিত ‘কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচন’ দেখতে চান (সমকাল, ১৮/০৯/২০২৪)। এ তথ্য থেকে এটা বলা যায়, ঢাবি শিক্ষার্থীদের চার-পঞ্চমাংশের বেশি শিক্ষার্থী জাতীয় রাজনীতির লেজুড়বৃত্তিকারী ছাত্র রাজনীতি পছন্দ করেন না, তবে শিক্ষার্থীদের পক্ষে কথাবার্তা বলার জন্য ক্যাম্পাসকেন্দ্রিক ছাত্র রাজনীতির পক্ষে।
নিয়মিত ছাত্র সংসদ নির্বাচন হলে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সামনে তাদের অভাব-অভিযোগ তুলে ধরার পাশাপাশি প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণও নিশ্চিত করা যেত। স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সিনেটে শিক্ষার্থী প্রতিনিধি যুক্ত করার ধারণাটি এই গণতান্ত্রিক পরিচালনা পদ্ধতিরই অংশ। কিন্তু আমাদের দেশের অসুস্থ রাজনীতির ফলে দীর্ঘদিন ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো ছাত্র সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে না। ফলে ছাত্র রাজনীতির নামে দখলবাজি আর নিপীড়ন-নির্যাতনই এখানকার নির্মম বাস্তবতা।
বলা যায়, এই অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতিই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জাতীয় রাজনীতির অনুসারীদের অপছন্দ করার মূল কারণ। তবে বিদগ্ধজন মনে করেন, ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের একটা অংশের এই বেপরোয়া আচরণের জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়ম-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা বা অপারগতাই বহুলাংশে দায়ী। যেমন– বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের অবস্থান মূলত আবাসিক হলকেন্দ্রিক এবং হলই হচ্ছে শিক্ষার্থীদের মধ্যে নতুন ও উন্নত সাংস্কৃতিক মানস তৈরির কেন্দ্র। প্রতিটি হলেই একজন প্রাধ্যক্ষের (প্রভোস্ট) নেতৃত্বে একদল আবাসিক ও সহকারী আবাসিক শিক্ষকের সমন্বয়ে একটি হল কর্তৃপক্ষ থাকে। এ কর্তৃপক্ষ যাতে যে কোনো পরিস্থিতিতে অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারে, সে জন্য হল প্রাঙ্গণ বা হলের খুব কাছাকাছি তাদের জন্য স্বতন্ত্র আবাসনের ব্যবস্থা থাকে। হলে বাড়তি দায়িত্ব পালনের জন্য সংশ্লিষ্ট সব শিক্ষককে মাসিক সম্মানীও দেওয়া হয়। কিন্তু ঢাবির বিভিন্ন হল প্রশাসন কি এতদিন নির্ধারিত দায়িত্ব ঠিকভাবে পালন করেছে? নিঃসন্দেহে না।
কোনো হল কর্তৃপক্ষ কতটা সফলভাবে তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করতে পারবে, তা অনেকাংশেই নির্ভর করে প্রাধ্যক্ষের নেতৃত্বগুণ ও কর্মদক্ষতার ওপর। কিন্তু এতদিন ওই দুটি গুণের প্রতি বিশেষ দৃষ্টি দেওয়ার পরিবর্তে ঢাবি কর্তৃপক্ষ হল প্রাধ্যক্ষ নিয়োগ দেওয়ার সময় দলীয় বা ব্যক্তিগত আনুগত্যকেই প্রায় সর্বাংশে গুরুত্ব দিয়েছে। ফলে একদিকে তারা ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রনেতাদের মন জোগাতে ব্যস্ত ছিল, অন্যদিকে হলে শিক্ষার্থীদের জন্য একটি সুন্দর সহাবস্থানের পরিবেশ নিশ্চিত করা যায়নি এবং এমনকি শান্তি-শৃঙ্খলাও রক্ষা হয়নি। হল প্রশাসনের কাজকর্ম নিয়মিত তদারকি বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ প্রশাসনের অন্যতম দায়িত্ব হলেও তারা দলবাজিতে ব্যস্ত থাকায় সেটাও পালিত হয়নি।
আমি মনে করি, হল কর্তৃপক্ষের নিম্নোক্ত দায়িত্ব-কর্তব্য ঠিকভাবে পালিত হলে পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে–
১. যেহেতু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ শতভাগ শিক্ষার্থীকে হলগুলোতে জায়গা দিতে পারে না, সে জন্য হলে শিক্ষার্থীদের ওঠানোর ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা অনুসরণ করা দরকার। এ জন্য হল কর্তৃপক্ষের প্রতিবছরই নতুন সেশন চালু হওয়ার আগে নিম্নোক্ত কাজগুলো সম্পাদন করতে হবে:
ক) বিগত সেশনে ছাত্রত্ব শেষ হয়ে গিয়েছে, এমন ছাত্রদের একটি পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রস্তুত করা (এই দায়িত্ব আবাসিক/সহ-আবাসিক শিক্ষকদের);
খ) এ প্রক্রিয়ায় শূন্য হওয়া আসনগুলোর বিপরীতে নতুন বরাদ্দ দিতে হলের সঙ্গে সংযুক্ত (অ্যাটাচড) শিক্ষার্থীদের মধ্যে যারা হলে উঠতে আগ্রহী, তাদের কাছ থেকে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে আবেদনপত্র আহ্বান করা এবং উপযুক্ত প্রার্থীদের নির্দিষ্ট নিয়ম অনুসারে সিট বরাদ্দ দেওয়া।
২. শিক্ষার্থীদের বরাদ্দকৃত কক্ষ নিয়মিত পরিদর্শনের মাধ্যমে (রোলকল) আবাসিক/সহ-আবাসিক শিক্ষকদের দ্বারা শিক্ষার্থীদের তথ্য হালনাগাদ করা এবং হলে অবস্থানরত শিক্ষাজীবন সমাপ্তকারী শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া।
৩. শিক্ষার্থীদের খাওয়া-দাওয়ার জন্য হলে যে ব্যবস্থা (ক্যান্টিন অথবা মেস) রয়েছে, তা নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করা এবং আবাসিক শিক্ষার্থীদের সহযোগিতায় খাবারের একটি ন্যূনতম মান নিশ্চিতে সক্রিয় পদক্ষেপ নেওয়া।
৪. শিক্ষার্থীদের কক্ষ এবং ওয়াশরুমের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা নিয়মিত পর্যবেক্ষণে রাখা (এবং পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদান করা)।
৫. হল প্রশাসনের উদ্যোগে মাঝেমধ্যে শিক্ষক ও আবাসিক শিক্ষার্থীদের মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে মতবিনিময় সভার আয়োজন করা এবং অনুরূপ সভায় গৃহীত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া।
৬. আবাসিক শিক্ষার্থীদের ব্যাপকভাবে সম্পৃক্ত করে প্রতিবছর সহশিক্ষামূলক কার্যাবলি (খেলাধুলা, নাচ-গান, নাট্যানুষ্ঠান, সাহিত্য ও বিতর্ক প্রতিযোগিতা) আয়োজনের সক্রিয় উদ্যোগ গ্রহণ এবং বাস্তবায়ন করা।
৭. সর্বশেষ বিষয়টি কর্তৃপক্ষের নিয়মিত কার্যক্রমের অংশ না হলেও সমস্যাটির গুরুত্ব বিবেচনায় উল্লেখ করতে হচ্ছে। বিষয়টি হচ্ছে, ‘গণরুম’ নামে অপসংস্কৃতির অবসান ঘটানো। এই চরম অমানবিক গণরুম সংস্কৃতির স্রষ্টা দলীয় নেতা বা হলে অবস্থানকারী অতিরিক্ত বাহুবলসম্পন্ন আদু ভাইয়েরা, যারা সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে অমানবিক আচরণে অভ্যস্ত। এই তথাকথিত ছাত্রনেতারা তাদের ক্যাডার/ লাঠিয়াল বাহিনী রাখার জন্য চারজন শিক্ষার্থীর একটি কক্ষে ৩০-৪০ শিক্ষার্থী রাখেন। এতদিন গণরুমের বিষয়টি হল কর্তৃপক্ষ জানলেও না জানার ভান করেছে।
গণরুম প্রসঙ্গটি উত্থাপনের কারণ হলো, এর অমানবিক দিকটি তুলে ধরা। চারজনের একটি কক্ষে ৩০-৪০ জনের শোয়া-বসার স্থান সংকুলান হওয়ার কথা নয়, পড়াশোনার কথা বাদই দিলাম। এই শিক্ষার্থীরা রাতে ঘুমান কোথায়? খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বাড়তি শিক্ষার্থীরা হলের গেস্টরুম, টিভিরুম, বারান্দা বা হলের ছাদে থাকার চেষ্টা করেন। এভাবে যাযাবরের মতো রাতের পর রাত কাটিয়ে কোনো শিক্ষার্থী কি সুস্থ থাকতে পারেন?
তার ওপর রয়েছে তাদের আশ্রয় দেওয়া ছাত্রনেতার অত্যাচার-নির্যাতন। প্রতিদিন রাত ১০টার পর তাদের হাজিরা নেওয়া হয় এবং কারও কোনো ত্রুটি পেলে তার ওপর অমানুষিক নির্যাতন করা হয়। এভাবে অত্যাচার-নির্যাতনের মধ্যে থেকে লেখাপড়া না করতে পেরে অনেক শিক্ষার্থী মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। তখন হল কর্তৃপক্ষকেই ওই অসুস্থ শিক্ষার্থীকে মানসিক হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করাতে হয়। কাজেই এই চরম অমানবিক ব্যবস্থার উচ্ছেদে হল কর্তৃপক্ষকে অবশ্যই কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিজ্ঞতা বলে, হল কর্তৃপক্ষের উল্লিখিত দায়িত্বগুলো সাধারণত আন্তরিকতার সঙ্গে পালিত হয় না। হল কর্তৃপক্ষ নামে প্রাধ্যক্ষের নেতৃত্বে যে টিম রয়েছে, তারা সপ্তাহে কয় দিন বা কত ঘণ্টা হলে ব্যয় করে– এটি সঠিকভাবে বলা খুবই কঠিন। তাহলে বিষয়টি হচ্ছে, হল ব্যবস্থাপনায় গুরুতর ত্রুটি বা অবহেলার কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাপকসংখ্যক শিক্ষার্থী ছাত্র রাজনীতি অপছন্দ করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ প্রশাসন এবং হল প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা রাজনৈতিক দলের লেজুড়বৃত্তি পরিত্যাগ না করলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কাছে একটি সম্মানের জায়গায় থাকবেন বলে মনে হয় না। দায়িত্বপ্রাপ্তদের এটি মনে রাখতে হবে, একটি চেয়ার কেবল বসার জন্য নয়; নির্দিষ্ট দায়িত্ব পালনের জন্য।
ড. আজিজুর রহমান: শিক্ষাবিদ, প্রাবন্ধিক
- বিষয় :
- শিক্ষাঙ্গন