খাপড়া ওয়ার্ড: বিপ্লবের প্রেরণা
স্মরণ

খাপড়া ওয়ার্ডে শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ
শেখ রফিক
প্রকাশ: ২৩ এপ্রিল ২০২৪ | ২৩:৫৫
১৯৪৮ সালের পর দেশব্যাপী চলছিল পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর সন্ত্রাসের রাজত্ব। এই জুলুম, নির্যাতনে বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিল এ দেশের মানুষ। জনগণের দাবিদাওয়া ও গণতান্ত্রিক অধিকার সংরক্ষণের সংগ্রামকে সার্থক করে তুলতে যেসব দেশপ্রেমিক কমিউনিস্ট নেতাকর্মী এগিয়ে এসেছিলেন, তাদের বিরুদ্ধে গৃহীত হয়েছিল চরম নির্যাতনমূলক ব্যবস্থা। ফলে তাদের ওপর নির্যাতন বাড়তে থাকে। একে একে জেলে ভরা হয় কমিউনিস্ট নেতাকর্মীকে। ব্রিটিশ সরকার রাজবন্দিদের বিশেষ মর্যাদা দিতে বাধ্য হলেও পাকিস্তান সরকার সেই মর্যাদা তুলে নেয় এবং তাদের ‘রাষ্ট্রদ্রোহী’ বলে বিবেচনা করে। অত্যাচার ও জুলুমের বিরুদ্ধে জেলের মধ্যেই আন্দোলন শুরু করেন কমিউনিস্ট বন্দিরা। ঢাকা ও রাজশাহী জেলে আটক রাজবন্দিরা ১৯৪৯ সালে চারবার– প্রথম ৩০ দিন, দ্বিতীয়বার ৪১ দিন, তৃতীয়বার ৪৯ দিন এবং পরিশেষে ৬১ দিন অনশন ধর্মঘট করেছিলেন।
রাজবন্দিরা আমরণ অনশনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। জেল কর্তৃপক্ষ বলপূর্বক রাজবন্দিদের খাওয়ানোর চেষ্টা করত। ১০ ডিসেম্বর ঢাকা জেলে অনশনরত রাজবন্দি শিবেন রায়কে জোর করে দুধ খাওয়ানোর চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু দুধ শিবেন রায়ের পাকস্থলীতে না গিয়ে ফুসফুসে প্রবেশ করে। জেল কর্তৃপক্ষ এদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে তাঁকে ৬ নম্বর সেলে তালাবদ্ধ করে রেখেছিল। রাতে শিবেন রায় মৃত্যুবরণ করেন। শিবেন রায়ের মৃত্যুর পর রাজবন্দিদের আংশিক দাবি পূরণ হয়।
১৯৫০ সালের এপ্রিল মাসে রাজশাহী জেলের সাধারণ কয়েদিরা অনশন শুরু করলে কমিউনিস্ট বন্দিরাও যোগ দেন। ঘানি টানানো হবে না, ভালো খাবার দেওয়া হবে– এই আশ্বাসের ভিত্তিতে ১৪ এপ্রিল অনশন প্রত্যাহার করা হয়। কিন্তু এর পর কমিউনিস্ট বন্দিদের ওপর জুলুম বাড়তে থাকে। ২১ এপ্রিল রাজবন্দিদের প্রতিনিধি কমরেড আব্দুল হক ও কমরেড বিজন সেনকে ধমক দিয়ে জানিয়ে দেওয়া হয়, শাস্তি হিসেবে ১০ জন বন্দিকে কনডেম সেলে স্থানান্তর করা হবে। এই শাস্তিমূলক আদেশ প্রত্যাখ্যান করেন খাপড়া ওয়ার্ডের কমিউনিস্ট বন্দিরা। এর পর ২২ ও ২৩ এপ্রিল রাজবন্দিরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করেন কয়েক দফা। ২৪ এপ্রিল সকালে কমরেড কম্পরাম সিং তেজোদীপ্তভাবে বলেন, ‘শাস্তি আমরা মানবো না, সেলে আমরা যাব না, নিতে এলে বাধা দেব।’ তাঁর এ বক্তব্য সিদ্ধান্ত হিসেবে গৃহীত হয়।
২৪ এপ্রিল রাজশাহী জেল সুপারিনটেনডেন্ট এডওয়ার্ড বিল দলবল নিয়ে হঠাৎ খাপড়া ওয়ার্ডে ঢুকে পড়েন এবং কমরেড আব্দুল হকের সঙ্গে কথা বলতে থাকেন। এক পর্যায়ে ‘কমিউনিস্টরা ক্রিমিনাল’ বলে গালি দিতে দিতে বিল ওয়ার্ড থেকে বের হয়েই দরজা বন্ধ করার নির্দেশ দেন। বিল বাঁশি বাজানোর সঙ্গে সঙ্গেই পাগলা ঘণ্টা বাজতে শুরু করে। বিল এবার গুলি চালাতে নির্দেশ দেন। বাঁশ দিয়ে জানালার কাচ ভেঙে, জানালার ফাঁকের মধ্যে বন্দুকের নল ঢুকিয়ে গুলি করতে থাকে সিপাহিরা। রক্তে ভেসে যায় খাপড়া ওয়ার্ড। রাজবন্দিরা চিৎকার
করে দরজা খুলে দিতে বলেন।
দরজা খুলতেই তারা সবাইকে পেটাতে শুরু করে।
সেদিন ঘটনাস্থলে শহীদ হয়েছিলেন হানিফ শেখ, আনোয়ার হোসেন, সুখেন ভট্টাচার্য, দেলোয়ার হোসেন, সুধীন ধর, কম্পরাম সিং, বিজন সেনসহ মোট ৭ জন; বাকিরা আহত হয়েছিলেন। ২৪ এপ্রিল হোক আমাদের প্রেরণা।
শেখ রফিক: প্রকাশক,
বিপ্লবীদের কথা প্রকাশনা
- বিষয় :
- স্মৃতিফলক