ঢাকা শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫

তিন কোটি শিক্ষার্থীর জন্য শিক্ষা সংস্কার কমিশন কোথায়?

তিন কোটি শিক্ষার্থীর জন্য শিক্ষা সংস্কার কমিশন কোথায়?

অবিলম্বে দেশে শিক্ষা সংস্কার কমিশন গঠন করতে হবে।

রাসেল আহমেদ

প্রকাশ: ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ১৯:৩৪

সম্প্রতি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস দেশের ছয়টি সেক্টরে সংস্কারের উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। অবশ্যই এগুলো সংস্কার করা জরুরি। কিন্তু কিছুটা হতাশার ব্যাপার হলো অন্যান্য সরকারের মতোই এই সরকারও তার ফাস্ট প্রায়োরিটিতে শিক্ষাকে রাখতে পারলেন না। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গঠিত সরকারের কাছে অনেকেরই অনেক কিছু চাওয়া থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। কারণও স্পষ্ট, বিগত সময়গুলোতে বাংলাদেশে ইনসাফের ভিত্তিতে কিছু হয়নি। যা হয়েছে কিছু মানুষের ব্যক্তিস্বার্থের ভিত্তিতে হয়েছে৷ 

বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার ধারা মোটাদাগে দুটি। রাষ্ট্র পরিচালিত সাধারণ শিক্ষা। এ ধারার অধীনে আছে– বাংলা মাধ্যম, ইংরেজি মাধ্যম, বাংলা ভার্সন ও আলিয়া মাদ্রাসা। অপরদিকে সমাজ পরিচালিত স্বতন্ত্র মাদ্রাসা শিক্ষা ধারা। এই ধারার ওপর রাষ্ট্রের তেমন কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। এ ছাড়া শিশুশিক্ষার ক্ষেত্রে ব্যক্তি মালিকানাধীন নানা ধরনের  কিন্ডারগার্টেন স্কুল আছে। এসব স্কুলে রাষ্ট্র নির্দেশিত সিলেবাস নাম মাত্র অনুসরণ করে বাহারি প্রকাশনীর নানা বই পড়ানো হয়। এদিকে, প্রাক-প্রাথমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ৩ কোটি। এই শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ বিনির্মাণে শিক্ষা সংস্কার কমিশন দরকার।


মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী থেকে শুরু করে বাংলাদেশে সবচেয়ে বৈষম্যের শিকার হয়েছে শিক্ষা খাত। সাংবিধানিক অঙ্গীকার ছিল একমুখী শিক্ষাব্যবস্থা যা এখনও বাস্তবায়ন হয়নি। প্রাক-প্রাথমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণি পর্যন্ত একমুখী শিক্ষাব্যবস্থা না থাকার কারণে নানা ধরনের বৈষম্যের মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীরা বড় হচ্ছে। বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা মানভিত্তিক নয় বরং প্রজেক্ট ভিত্তিক। নানামুখী প্রভাবে অসহায় দেশের শিক্ষাঙ্গন। দেশের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা যেন গিনিপিগ! আজ এই বই তো কাল সেই বই। পাঠ্যপুস্তকের বাহারি ধরন শেখাতে ও শিখতে গুরু-শিষ্যের সম্পর্কটা আর গড়ে ওঠে না। অনেকগুলো শিক্ষা কমিশন হয়েছে নামমাত্র। কোনোটিরও সফল বাস্তবায়ন হয়নি। এমনকি, সর্বশেষ কারিকুলামের সঙ্গে কবীর চৌধুরী শিক্ষা কমিশনের প্রস্তাবের মিল নেই! আসল কথা হলো,  এই কারিকুলামও একটি প্রজেক্ট। এরপর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে বিভিন্ন কমিটি, শিক্ষা অফিসের নানা অযাচিত  আদেশ নির্দেশ, জনবল সংকট, শিক্ষকদের পদ-পদোন্নতির ক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা তো আছেই। 


সমস্যার সমাধানে কর্তৃপক্ষকে আন্তরিক হওয়া প্রয়োজন। অতীতে আমরা ফিরে না যাই, আমার প্রস্তাব হলো, ১. অবিলম্বে দেশে শিক্ষা সংস্কার কমিশন গঠন করতে হবে। ২. সাংবিধানিক অধিকার দিয়ে স্থায়ী স্বাধীন ‘শিক্ষা কমিশন সচিবালয়’ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এর প্রধান হবেন পূর্ণ মন্ত্রীর পদমর্যাদার সমান। এই সচিবালয়ের অধীনে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর, মাদ্রাসা শিক্ষা, এনসিটিবি, কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরসহ, শিক্ষাসংক্রান্ত সব কার্যক্রম পরিচালিত হবে। ৩. একমুখী, বিজ্ঞানভিত্তিক ও কর্মোপযোগী শিক্ষানীতি গ্রহণের লক্ষ্যে যুগোপযোগী কারিকুলাম প্রণয়ন করতে হবে। ৪. এই কমিশন শিক্ষকদের জন্য আলাদা বেতন কাঠামো তৈরি করবে, বেসরকারি শিক্ষকদের বেতন ও অন্যান্য সুবিধা সরকারি শিক্ষকদের মতো করার বিষয়টি বিবেচনা করবে। শিক্ষক নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতি, শাস্তি নিয়ন্ত্রণ করবে। ৫. এনসিটিবি যুগোপযোগী পাঠ্য পুস্তক প্রকাশনা করবে হঠাৎ করে নতুন কোনো বই পাঠ্যক্রমে যোগ করা যাবে না। নতুন বই যুক্ত করতে হলে ন্যূনতম তিন বছরের পাইলট প্রকল্প পরিচালনা করতে হবে, এসব প্রকল্পের প্রধানসহ শতকরা ৮০ ভাগ কর্মকর্তা হবেন সংশ্লিষ্ট বিষয় ও শ্রেণির শিক্ষক। পাঠ্য পুস্তকের ১০ ভাগের বেশি একবারে পরিবর্তন করা যাবে না। পাঠ্য পুস্তক প্রণয়ন বা পরিমার্জনের সঙ্গে জড়িতদের ৭০ ভাগ হবেন সংশ্লিষ্ট বিষয় ও শ্রেণির শিক্ষক। ৬.  প্রতিষ্ঠানে সব কমিটি বাতিল করার মাধ্যমে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে এলাকাভিত্তিক রাজনীতির বলয় থেকে মুক্ত করতে হবে। প্রধান শিক্ষকই হবেন প্রতিষ্ঠানের অথরিটি, প্রাথমিকের জন্য উপজেলা শিক্ষা অফিসই যথেষ্ট, আর মাধ্যমিক উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ থাকবে। ৭. কারিকুলাম ও পাঠ্য পুস্তকের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সংস্কার আনার আগে অনলাইনে শিক্ষকদের মতামত ও প্রস্তাবনা পেশের সুযোগ দিতে হবে। সর্বশেষে, চূড়ান্ত সংস্কার প্রস্তাব সরকারি-বেসরকারি শিক্ষকদের অনলাইনে ভোট প্রদানের মাধ্যমে গ্রহণ বা বর্জন করতে হবে।


আশা করি, জন-আকাঙ্ক্ষায় গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এ ব্যাপারে আশু পদক্ষেপ নিয়ে দেশের শিশু-কিশোরদের ভবিষ্যতের উপযোগী করে গড়ে তুলতে সচেষ্ট হবেন। 

রাসেল আহমেদ: শিক্ষক 
 

আরও পড়ুন

×