ঢাকা শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫

রাজনীতি

জাতীয় ঐক্য যে কারণে জরুরি

জাতীয় ঐক্য যে কারণে জরুরি

ড. মুহাম্মদ ইউনূস

কাজী জহিরুল ইসলাম

প্রকাশ: ০২ এপ্রিল ২০২৫ | ১৬:০৬ | আপডেট: ০২ এপ্রিল ২০২৫ | ১৬:৫০

বাংলাদেশবিরোধী অপতৎপরতা, নেতিবাচক প্রচার-প্রপাগান্ডা বিশ্বসভায় বাংলাদেশকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করার প্রবণতা এবং একটি রাজনৈতিক দলের হাজার হাজার কর্মীকে অবৈধভাবে ভারতে আশ্রয়, এসব ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করার সামর্থ্য কোনো একক রাজনৈতিক দলের নেই। কোনো একক রাজনৈতিক দল গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত হয়ে সরকার গঠন করলেও সর্বগ্রাসী এই সুনামি রুখে দেওয়া কঠিন হবে। হয় তারা আগের সরকারের মতো আত্মঘাতী চুক্তি সই করবে, বাংলাদেশকে ভারতের একচেটিয়া বাজারে পরিণত করবে অথবা কঠোর হতে গিয়ে ব্যর্থ সরকারে পর্যবসিত হবে। এমন শক্তি মোকাবিলা করার জন্য দরকার সুদৃঢ় দেশপ্রেম, জাতীয় ঐক্য এবং আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য বিশ্ববরেণ্য কোনো ব্যক্তির নেতৃত্ব।

আজ বাংলাদেশের নির্বাহী প্রধানের দায়িত্বে প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের মতো বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তি না থেকে অন্য যে কেউ থাকলে বাংলাদেশকে উগ্র মৌলবাদী দেশের তালিকায় ফেলে দেওয়া হতো। এই লক্ষ্যে অনেকে প্রচার-প্রপাগান্ডা চালাচ্ছেন, কিন্তু ড. ইউনূসের ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা এবং সততার কাছে সব খড়কুটোর মতো ভেসে যাচ্ছে। বিশ্বনেতারা ড. ইউনূসের কথা কখনোই অবিশ্বাস করেন না। এটি আমাদের বড় সৌভাগ্য।

এবার রমজানে সম্ভবত গত ৫৪ বছরের বাংলাদেশে এই প্রথম নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য কমেছে, মানুষ স্বস্তিতে আছে। এখানেও অনেকে সরকারের সততা ও আন্তরিকতার প্রশংসা না করে সমালোচনা করছেন। বলছেন, এত দাম কমে গেলে কৃষক মারা যাবে। কেউ বলছেন, এ বছর মার্চে রোজা হওয়ায় শীতের সবজি এখনও বাজারে আছে, উৎপাদনের মৌসুমে রোজা হয়েছে বলেই কৃষিপণ্যের দাম কম। কিন্তু মার্চ মাসে তো রোজা আরও হয়েছে, প্রতি ৩৫-৩৬ বছরে একবার রোজা পুরো বছর ঘুরে আবার আগের জায়গায় আসে। কই আর কখনও তো এমন হয়নি।

দাম কমার কারণ দুটি। প্রথমত, কৃত্রিমভাবে দাম বাড়াত যেসব মধ্যস্বত্বভোগী অসাধু ব্যাবসায়ী-সিন্ডিকেট, সেটা ভেঙে পড়েছে। সরকারের সততা এবং সদিচ্ছার কারণেই সিন্ডিকেট ভাঙা সম্ভব হয়েছে। দ্বিতীয় কারণটি খুব ইন্টারেস্টিং, এটা কেউ ভেবে দেখেননি। রাজনৈতিক দলগুলো যখন ক্ষমতায় থাকে, বিশেষ করে শেখ হাসিনার শাসনামলে দুর্নীতি ছিল সর্বোচ্চ পর্যায়ে, মানুষের হাতে ছিল মাত্রাতিরিক্ত অবৈধ অর্থ। এই অবৈধ অর্থের একটা আগ্রাসী ক্রয়ক্ষমতা প্রতিফলিত হতো বাজারে। দুর্নীতি কমে আসায় কৃত্রিম চাহিদা এখন বাজারে অনুপস্থিত। কৃষিপণ্যের দাম কমে গেছে, কৃষক মরে যাচ্ছে– এই হা-হুতাশ যারা করেন, তাদের জন্য বলি, আগেও আমরা দেখেছি কৃষক মাথায় করে বাজারে এক টুকরি টমেটো এনেছে, বিক্রি করতে না পেরে বাজারেই ঢেলে ফেলে দিয়ে গেছে, কারণ দাম এত কম যে বোঝা বয়ে বাড়ি ফিরিয়ে নিতেও চায়নি তারা। তখনও কিন্তু শহরের বাজারগুলোতে টমেটোর দাম কমেনি। কারণ মধ্যস্বত্বভোগী সিন্ডিকেটের দাপট ছিল তীব্র।

এখন আমাদের দুটি কাজ করতে হবে। সব দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক শক্তির একটি ঐক্য গড়ে তুলতে হবে। পাশাপাশি চীন এবং অন্যান্য বৃহৎ শক্তির সঙ্গে কৌশলগত কূটনৈতিক সম্পর্ক তৈরি করতে হবে। পাশাপাশি, জাতীয়ভাবে টেকসই ঐক্য গড়তে হবে। 

আমার প্রস্তাব হলো, সব দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক দল এক হয়ে আগামী পাঁচ বছরের জন্য একটি জাতীয় ঐকমত্যের সরকার গঠন করা হোক। সেই সরকারের রাষ্ট্রপতি থাকবেন প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ৫০ জনের ক্যাবিনেট আগামী পাঁচ বছর রাষ্ট্র পরিচালনা করবে এবং সংস্কার কমিশনগুলোর সুপারিশের ভিত্তিতে রাষ্ট্র ব্যবস্থার পূর্ণাঙ্গ সংস্কার করবে। মন্ত্রিপরিষদের ওপরে একটি সুপ্রিম কাউন্সিল থাকবে। প্রতিটি জেলা থেকে দু’জন প্রতিনিধি, সব রাজনৈতিক দল থেকে মন্ত্রিপরিষদের আনুপাতিক হারে প্রতিনিধি, সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি, তিন বাহিনীর প্রধান, পুলিশপ্রধানকে নিয়ে গঠিত হবে সুপ্রিম কাউন্সিল। এই কাউন্সিল জাতীয় সরকারে পার্লামেন্টের ভূমিকা পালন করবে। তবে শুধু রুটিন কাজের বাইরে রাষ্ট্রীয় বড় ইস্যুগুলোতে সুপ্রিম কাউন্সিল মিটিংয়ে বসবে এবং সিদ্ধান্ত নেবে। 

এই পাঁচ বছরের মধ্যে চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানে হত্যকাণ্ড ঘটানোসহ তিনটি ভোটারবিহীন নির্বাচন করে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করা এবং খুন, গুম, দুর্নীতি, অর্থ পাচারসহ সব অপরাধের বিচার করাও সম্ভব হবে। এরপর একটি দলনিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন করে বাংলাদেশে পুনরায় পার্টি পলিটিকস শুরু করা যাবে। 

এই পাঁচ বছরে দেশকে দুর্নীতিমুক্ত করে একটি নৈতিক কাঠামোর ওপর দাঁড় করানো যাবে, বিদেশ নীতিও একটি সুস্পষ্ট ভিত্তির ওপর দাঁড়াবে। ড. ইউনূসের গ্রহণযোগ্যতাকে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশ বহির্বিশ্বে এক অনন্য উচ্চতায় উঠে যাবে।

কাজী জহিরুল ইসলাম: কবি ও জাতিসংঘ কর্মকর্তা

আরও পড়ুন

×