লোহাগাড়ায় রোহিঙ্গাদের চক্র
নকল মা-বাবা সাজিয়ে ভুয়া এনআইডি তৈরি

কাইছার হামিদ, লোহাগাড়া (চট্টগ্রাম)
প্রকাশ: ৩০ জুন ২০২৪ | ০৯:১৬
লোহাগাড়া উপজেলার বড়হাতিয়া ইউনিয়নের ১নং ওয়ার্ডের স্থায়ী বাসিন্দা মোহাম্মদ ইলিয়াছের মেয়ে বেবি আক্তারকে বিয়ে করেন মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা তরুণ আব্দুল আজিজ। কয়েক বছর ধরে আবদুল আজিজ শ্বশুরবাড়িতে বসবাস করে আসছেন। এর মধ্যে রোহিঙ্গা আব্দুল আজিজ শ্বশুর মোহাম্মদ ইলিয়াছকে বাবা ও শাশুড়ি রশিদা বেগমকে মা সাজিয়ে ভুয়া বাংলাদেশি জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) তৈরি করেন। একসময় তিনি পাসপোর্ট তৈরি করে সৌদি আরব পালিয়ে যান। এখন তিনি বাংলাদেশে থাকা স্ত্রী ও তিন সন্তানের খোঁজ নেন না। পরে এলাকায় বিষয়টি জানাজানি হলে ভুয়া এনআইডির কথা স্বীকার করেছেন রোহিঙ্গা তরুণ আব্দুল আজিজের শ্বশুর মোহাম্মদ ইলিয়াছ।
সম্প্রতি উপজেলার চুনতি ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের রহমানিয়া পাড়ায় ওবাইদুল হক নামে এক রোহিঙ্গা ভুয়া পরিচয়ে এনআইডি তৈরি করে পাসপোর্ট বানাতে গিয়ে পুলিশের হাতে ধরা পড়েন। ওবাইদুল হক নামের ওই রোহিঙ্গা ওই এলাকার আবুল কালামকে বাবা আর কালামের স্ত্রী রাবিয়া খাতুনকে মা সাজিয়ে বাংলাদেশি পাসপোর্ট করতে যান।
আবুল কালাম বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, টাকার লোভে তিনি এ কাজটি করেছেন। সৈয়দা খাতুন নামের আরেক রোহিঙ্গা নারীকে মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে কালাম দম্পত্তি পিতামাতা সেজে একই এলাকা থেকে বানিয়ে দিয়েছেন ভুয়া এনআইডি কার্ড। এ বিষয়টিও প্রতিবেদকের কাছে স্বীকার করেন সাজানো পিতা আবুল কালাম। স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আবুল কালামও রোহিঙ্গা নাগরিক। তিনিও কৌশলে বাংলাদেশে এনআইডি তৈরি করেন।
স্থানীয় ওসমান গণি বলেন, ‘রোহিঙ্গারা নানা কৌশলে ভোটার হচ্ছেন। এ দায় স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও নির্বাচন অফিস এড়াতে পারে না। টাকার বিনিময় ছাড়া এটি কোনোভাবেই সম্ভব নয়। এ ছাড়া স্থানীয় বাসিন্দারা রোহিঙ্গাদের মেয়ে বিয়ে দিয়ে এনআইডি তৈরি করে দিচ্ছেন। আবার অনেকেই পাসপোর্ট করে বিদেশ পালিয়ে যাচ্ছেন।’
অনুসন্ধানে জানা যায়, রোহিঙ্গারা তাদের নাম-পরিচয় গোপন করে স্থানীয় কোনো পরিবারের স্বামী-স্ত্রীকে পিতা-মাতা সাজিয়ে জনপ্রতিনিধি এবং নির্বাচন অফিসের কিছু কর্মচারীকে ম্যানেজ করে ভোটার আইডি কার্ড তৈরি করেন। একটি সংঘবদ্ধ চক্র কিছু অসাধু জনপ্রতিনিধিকে মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে ম্যানেজ করে ভুয়া কাগজপত্র দিয়ে এনআইডি তৈরি করে দেয়। এতে সহজে পাসপোর্ট বানিয়ে বাংলাদেশি সেজে বিভিন্ন দেশে পাড়ি দিচ্ছেন রোহিঙ্গারা। একটি এনআইডি তৈরি করতে এক লাখ থেকে দেড় লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে দালাল চক্র।
আইনজীবী বেলাল উদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) প্রাপ্তির প্রক্রিয়াটি খুব সহজ নয়। পাঁচটি ধাপ অতিক্রম করে এই কার্ড পাওয়া যায়। আবেদনপত্র জমা দেয়ার পর তথ্য সংগ্রহ, পরিচিতি যাচাই, উপজেলা সার্ভারে প্রক্রিয়াজাতকরণ প্রভৃতি প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ার পর আবেদনকারীকে এনআইডি কার্ড দেওয়া হয়। এ জন্য বেশ সময়ও লাগে। উল্লিখিত সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে যদি কার্ড পেয়ে থাকেন, তাহলে বলতে হবে এ ক্ষেত্রে গুরুতর অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়েছে।’
চুনতি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জয়নাল আবদীন জনু বলেন, ‘রোহিঙ্গারা কীভাবে ভোটার হয়েছে জানি না। তবে ওবাইদুল হকের বিরুদ্ধে অভিযোগের প্রেক্ষিতে পুলিশ একটি প্রতিবেদন চেয়েছিল, আমরা সেটা জমা দিয়েছি।’
লোহাগাড়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার মুহাম্মদ ইনামুল হাসান বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে কঠোর নির্দেশনা রয়েছে। ভুয়া এনআইডি ও পাসপোর্ট তৈরির বিষয়টি তদন্ত করে প্রমাণিত হলে জড়িতদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
- বিষয় :
- চক্র