বন্যার পর সাপের দংশনে নীল নোয়াখালীর মানুষ

ফাইল ছবি
আনোয়ারুল হায়দার, নোয়াখালী
প্রকাশ: ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ২৩:২০ | আপডেট: ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ১০:৩৬
ব্যাপক বন্যাকবলিত নোয়াখালী জেলায় সাপের ভয়াবহ উপদ্রব দেখা দিয়েছে। গত এক মাসে জেলায় ৬৯৮ জনকে সাপে কেটেছে। এদের মধ্যে জেলার বিভিন্ন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ২৯০ জন এবং নোয়াখালী জেনারেল হাসপাতালে ৪০৮ জন চিকিৎসা নিয়েছেন। তবে হাসপাতালের চিকিৎসকদের তৎপরতার কারণে কোনো রোগীর মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়নি। সোমবার জেনারেল হাসপাতালের মেডিসিন ওয়ার্ডের রেজিস্ট্রার ডা. মোহাম্মদ এমরান হোসেন সোহেল এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
নোয়াখালী জেনারেল হাসপাতালের মেডিসিন ওয়ার্ড ঘুরে দেখা যায়, বিষাক্ত সাপের দংশনে আহত হয়ে নারী ওয়ার্ডের মেঝেতে চিকিৎসা সেবা নিচ্ছেন এক নারী। তাঁর নাম কোহিনুর বেগম (২৯)। তিনি সেনবাগ উপজেলার নবীপুর ইউনিয়নের নলদিয়া গ্রামের সাইফুল ইসলামের স্ত্রী। কোহিনুর জানান, গত ২৭ আগস্ট দুপুর বেলা ঘরের ভেতর কাজ করছিলেন। মেঝেতে পড়ে থাকা একটি পলিথিন সরাতে গেলে পলিথিনের ভেতরে লুকিয়ে থাকা গোঁখরা সাপ তাঁর হাতে ছোবল মারে। তীব্র যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে অচেতন হয়ে পড়েন তিনি। তাঁর স্বামী সাইফুল ইসলাম ও স্বজনরা তাঁকে দ্রুত নোয়াখালী জেনারেল হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে আসেন। সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসাসেবা দিয়ে মেডিসিন ওয়ার্ডে ভর্তি করা হয়। মেডিসিন ওয়ার্ডের রেজিস্ট্রার ডা. মোহাম্মদ ইমরান হোসেন সোহেল ও সহকারী রেজিস্ট্রার ডা. মো. জাবেদ হোসেন রোগীকে দেখে দ্রুত এন্টিভ্যানম ইনজেকশন দেন। কয়েক ঘণ্টা পর রোগীর চেতনা ফিরে আসে। কিন্তু রোগী পুরো পুরি সুস্থ না হওয়ায় তাঁকে ২৯ আগস্ট ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়।
কোহিনুর বেগম বলেন, ‘সাপে কাটার পর বেঁচে থাকার আশা ছেড়ে দিয়েছিলাম। হাসপাতালে ভর্তির পর ডাক্তার-নার্সদের আন্তরিকতায় আমি প্রাণে বেঁচে গেছি। সরকারি হাসপাতালের সেবা যে এত ভালো হয় তা আগে জানতাম না।’ চিকিৎসকদের সেবা সম্পর্কে একই কথা বলেছেন বিষাক্ত সাপের দংশনে আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসারত রোগী হাতিয়া উপজেলার বাসিন্দা মিনতি রানী দাস (৪৫), লক্ষ্মীপুরের চন্দ্রগঞ্জ থানার বাসিন্দা লাইজু আক্তার (১৬), কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার কুলসুম বেগম (৪০), নোয়াখালী সদর উপজেলার মন্নান নগর এলাকার মো. ইব্রাহিম (৪৩)।
জেনারেল হাসপাতালের মেডিসিন ওয়ার্ডের রেজিস্ট্রার ডা. মোহাম্মদ এমরান হোসেন সোহেল জানান, গত আগস্ট ও চলতি মাসের দুই দিনে অর্থাৎ মোট ৩৩ দিনে বিভিন্ন উপজেলা থেকে ৪০৮ জন সাপে কাটা রোগী ভর্তি হয়েছেন। তাদের মধ্যে ৭ জন বিষাক্ত সাপের কামড়ে আহত। বাকি ৪০৮ জন অবিষাক্ত সাপের কামড়ে আহত হন। মেডিসিন ওয়ার্ডে কর্তব্যরত চিকিৎসক-নার্সদের আন্তরিক প্রচেষ্টায় একজন রোগীও মারা যাননি। ওয়ার্ডে সার্বক্ষণিক একাধিক চিকিৎসক পালাক্রমে ডিউটি করেন।
তিনি বলেন, ‘লোকালয়ে পানি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সাপের উপদ্রবও বাড়ে। বসতঘরে পানির মধ্যে ও চলাচলের পথে সাপের আনাগোনা থাকে।
সাপে কাটা রোগীদের করণীয় সম্পর্কে এই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বলেন, ‘আক্রান্ত ব্যক্তিকে বারবার আশ্বস্ত করতে ও সাহস দিতে হবে যেন আতঙ্কগ্রস্ত না হন। অবিষাক্ত সাপের দংশনে কোনো রোগী মারা যান না। বিষাক্ত সাপে কাটলে অনেক সময় সাপ বিষ নাও ঢেলে দিতে পারে। তবে আক্রান্ত রোগীকে স্থির থাকতে হবে। হাতে কামড়ালে হাত, পায়ে কামড়ালে পা নাড়ানো যাবে না। স্থির অবস্থায় থাকতে হবে। সম্ভব হলে সঙ্গে সঙ্গে আক্রান্ত স্থানের ওপরে রশি কিংবা গামছা বা কাপড় দিয়ে শক্ত করে বেঁধে রাখতে হবে। আক্রান্ত স্থান সাবান দিয়ে ভালোভাবে ধুয়ে দিতে হবে। সাপে কাটার পর কোনো প্রকার ওঝা কিংবা কবিরাজের কাছে ঝাড়ফুকের জন্য যাওয়া যাবে না। আক্রান্ত অঙ্গ সুঁই কিংবা অন্য কোনো কিছু দিয়ে কাটা যাবে না। যদি শ্বাস নিতে না পারে তাহলে রোগীর মুখে মুখ রেখে শ্বাস দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। যদি সাপটিকে মেরে ফেলা হয়, তাহলে সাপটি সঙ্গে নিয়ে যত দ্রুত সম্ভব নিকটস্থ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কিংবা জেলা সদরে সরকারি হাসপাতালে চলে আসতে হবে। আমাদের অধিকাংশ হাসপাতালে সাপে দংশনের প্রতিষেধক ইনজেকশন এন্টিভেনম রয়েছে। বিষধর সাপে আক্রান্ত রোগীকে এন্টিভেনম ইনজেকশন দেওয়া হয়। অবিষাক্ত সাপে কাটা রোগীদের পর্যবেক্ষণে রাখা হয়।’
তিনি আরও বলেন, তবে হাসপাতালে বিষাক্ত সাপে কাটা রোগী আসার সঙ্গে সঙ্গে এন্টিভেনম ইনজেকশন পুশ করা সম্ভব না। কারণ একটি এন্টিভেনম ইনজেকশনের বোতলে ১০ ভায়াল প্রতিষেধক থাকে। এটি তৈরি করতে অর্থাৎ ইনজেকশন পানি মিশ্রিত করতে ৩০ মিনিট সময় লাগে। এরপর ইনজেকশন পুশ করতে আরও এক ঘণ্টা সময় লাগবে। অনেক রোগী হাসপাতালে এসেই বলে রোগীকে এন্টিভেনম ইনজেকশন দিন। বিষয়টি না বুঝে অনেক রোগীর লোক কর্তব্যরত চিকিৎসক ও নার্সদের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণ করেন, যা দুঃখজনক।
তিনি আরও বলেন, ‘বিষাক্ত সাপে কামড়ানো রোগীর কতগুলো লক্ষণ রয়েছে। যা দেখে বুঝতে হবে বিষধর সাপে কাটছে কি না। উপসর্গগুলো হচ্ছে সাপে কাটা রোগীর চোখের পাতা পড়ে যাবে, ডাবল ভিশন অর্থাৎ সবকিছুই চোখে দ্বিগুণ দেখবেন, কথা বলার সময় নাকে কথা লাগবে, ঘাড় সোজা করে রাখতে পারবেন না।’
নোয়াখালীর সিভিল সার্জন ডা. মাসুম ইফতেখার বলেন, ‘বন্যা দেখা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সাপ ভেসে গিয়ে লোকালয়ে, বসতঘরে, গোয়াল ঘরে আশ্রয় নেয়। এসব সাপ কারণে অকারণে লোকজনকে ছোবল দিয়ে আহত করে। নোয়াখালী জেনারেল হাসপাতাল ও ৯টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পর্যান্ত পরিমান এন্টিভেনম ইনজেকশন রয়েছে। সাপে কাটা রোগীদের আতঙ্কিত হওয়ার দরকার নেই।’