নেতারা আত্মগোপনে, কর্মীরা মাঠে

মাহতাব উদ্দিন আহমদ, রেজাউল করিম চৌধুরী, আ জ ম নাছির উদ্দীন
তৌফিকুল ইসলাম বাবর
প্রকাশ: ১৯ অক্টোবর ২০২৪ | ২৩:০২
জনরোষ ও গ্রেপ্তার এড়াতে আত্মগোপনে চলে চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি মাহতাব উদ্দিন চৌধুরী, সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীন ও সাবেক মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরীসহ অঙ্গসংগঠনের শীর্ষ নেতারা। আর্থিকভাবে সামর্থ্যবানদের অনেকেই বিদেশে। যারা বিদেশে যেতে পারেননি তারা দেশের অন্য কোনো স্থানে লুকিয়ে আছেন বলে প্রচার আছে। শীর্ষনেতাদের যখন এমন অবস্থা তখন কর্মীরা থেকে গেলেন মাঠে। সরকার পতনের আড়াই মাসের মধ্যে চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ঝটিকা মিছিল করেছে ছাত্রলীগ। গত শুক্রবার রাতে নগরীর জামালখানে ঝটিকা মিছিল করেছে সংগঠনটি। প্রতিবাদে পাল্টা কর্মসূচি পালন করেছে বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীরা।
আওয়ামী লীগ একসময় ‘গায়েবি মামলা’ দিলেও এখন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আমলে নির্বিচারে দলটির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করছেন বিএনপি নেতাকর্মীরা।
আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীর একচ্ছত্র দাপটে গত ১৫ বছর বিএনপি নেতাকর্মীরা মাঠেই দাঁড়াতে পারেননি। বিচ্ছিন্ন কিছু দলীয় কর্মসূচি ছাড়া ফেসবুকসহ সামাজিক মাধ্যমে সরব ছিল বিএনপি। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের ফলে গত ৫ আগস্টের পর থেকে আওয়ামী লীগের বেশির ভাগ নেতাকর্মী এলাকাছাড়া। রাজনীতির মাঠ দখলে নিয়েছে বিএনপি। প্রথম দিকে গা ঢাকা দেন শীর্ষস্থানী আওয়ামী লীগ নেতারা। পর্যায়ক্রমে তৃণমূলের নেতাকর্মীরাও বাড়ি ছেড়েছেন। মামলায় নাম না থাকলেও যে কোনো সময় ‘অজ্ঞাত আসামি’ হিসেবে গ্রেপ্তার হতে পারেন– মূলত এমন ভয় আর আতঙ্কে দিন কাটছে তাদের।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর কয়েক দিন দেশে আত্মগোপনে থাকলেও পরে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে চলে যান শিক্ষামন্ত্রী ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল। ভারতে চলে গেছে বহুল আলোচিত-সমালোচিত নগর ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক নুরুল আজিম রনিও। ভারত থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ও এই সরকারের প্রধান প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের সমালোচনায় মুখর সাবেক এই ছাত্রলীগ নেতা। এছাড়া আত্মগোপনে চলে গেছেন চট্টগ্রাম সিটি মেয়র এম রেজাউল করিম চৌধুরী, নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি মাহতাব উদ্দিন চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীন। তারা অবশ্য দেশেই আত্মগোপনে রয়েছেন বলে গুঞ্জন রয়েছে। অন্যান্য আওয়ামী লীগ নেতারাও চলে গেছেন আত্মগোপনে। তাদের প্রায় সবারই মোবাইল ফোন বন্ধ। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও সরব নেই তারা।
আওয়ামী লীগের দলীয় সূত্রে জানা যায়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নজর এড়াতে তৃণমূল পর্যায়ের নেতারা ঘরছাড়া। তারা নিজেদের গোপন রাখার চেষ্টা করছেন। তবে পরিবার-পরিজনরা দিনরাত আতঙ্কের মধ্যে থাকছেন। নগরীর ইউনিট থেকে শুরু করে নগর আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ, কৃষক লীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, মহিলা আওয়ামী লীগের লাখো নেতাকর্মী পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। নেতাকর্মীদের বেশির ভাগই এক এলাকা ছেড়ে অন্য এলাকায় আত্মীয়-স্বজন এবং বিশ্বস্ত কাছের মানুষদের বাড়িতে গা ঢাকা দিয়ে থাকছেন।
নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে নগর আওয়ামী লীগের সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্য সমকালকে বলেন, ‘দেশের পরিস্থিতি ভালো নয়। সরকার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে কাজে লাগিয়ে আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করার অপচেষ্টা করছে। এতদিন একের পর এক মামলা দেওয়া হয়েছে। এখন ধরপাকড় শুরু হয়েছে। মামলায় আসামি হিসেবে যাদের নাম রয়েছে তারা তো বটেই, যাদের নাম নেই তারাও ভয়ে রয়েছেন। কারণ কাউকে গ্রেপ্তার করা হলেই কোনো না কোনো মামলায় ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে। তবে এভাবে বেশিদিন চলবে না। এক সময় এই ভয় কেটে যাবে। তখন আবার পরিস্থিতি মোকাবিলায় ঘুরে দাঁড়াবে আওয়ামী লীগ।’
একজন নগর শ্রমিক লীগ নেতা সমকালকে বলেন, ‘একটি দলের সব লোক খারাপ হতে পারেন না। দলে অনেক দুষ্ট লোক ঢুকে পড়েছিলেন, যারা দলকে ব্যবহার করে নিজেরাই লাভবান হয়েছিলেন। কিন্তু যারা নিবেদিতপ্রাণ নেতাকর্মী তারা কোনো অপকর্মে জড়িত ছিলেন না। ফলে এমন নেতাকর্মীকে গণহারে হয়রানি করা সরকারের
উচিত হবে না।’
বিএনপি নেতাকর্মিরা বলছেন, অওয়ামী লীগ সরকার দীর্ঘ সাড়ে ১৫ বছর আইনশ্খৃলা বাহিনীকে তাদের পেটোয়া বাহিনীতে পরিণত করেছিল। আওয়ামী লীগের অবর্ণনীয় নির্যাতন এবং মামলা-মোকদ্দমার কারণে বিএনপি নেতাকর্মিরা বাড়িছাড়া ছিলেন। হাজার হাজার নেতাকর্মিকে কারাবাস করতে হয়েছে। অনেকেই ব্যবসা-বাণিজ্য হারিয়েছেন, চাকরি হারিয়েছেন। এখন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মিরা তারই ফল ভোগ করছেন।
অবশ্য চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক ও আদালতের রায়ে নির্বাচিত সিটি মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন সমকালকে বলেন, ‘বিএনপি প্রতিহিংসার রাজনীতিতে বিশ্বাস করে না। তবে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর আওয়ামী লীগের নেতাকর্মিরা এতদিন যে অপকর্ম করেছিলেন, এখন তারই ফল ভোগ করতে হচ্ছে তাদের।’
জানা গেছে, শুধু নগরীই নয়, ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর থেকে গ্রেপ্তার ও জনরোষ থেকে বাঁচতে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন জেলার বিভিন্ন পর্যায়ের আওয়ামী লীগ নেতাকর্মিরাও। জেলার ১৫ উপজেলা, ১৫ পৌরসভা ও ১৯০টি ইউনিয়নের ১ হাজার ৭১০ ওয়ার্ডের উল্লেখযোগ্য ও চেনামুখ আওয়ামী লীগ নেতাকর্মিরা পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। বন্ধ রয়েছে নেতাদের ফোনও। বিশেষ করে চট্টগ্রাম উত্তর ও দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের বেশিরভাগ নেতাকর্মিই চলে গেছেন আত্মগোপনে।
এদিকে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর আওয়ামী লীগ নেতাকর্মিদের পাশাপাশি তছনছ হয়ে গেছে স্থানীয় সরকারের আওয়ামী লীগের সাজানো সাম্রাজ্যও। গত ১৯ আগস্ট সিটি করপোরেশন ও পৌরসভার মেয়র, উপজেলা চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান ও জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানকে অপসারণ করে স্থানীয় সরকার বিভাগ। সিটি করপোরেশনের মেয়রদের বরখাস্ত করে বসানো হয়েছে প্রশাসক। পৌরসভা, উপজেলা পরিষদে নির্বাহী কর্মকর্তা ও জেলা পরিষদে জেলা প্রশাসককে (ডিসি) দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। ফলে স্থানীয় সরকার পর্যায়ে আওয়ামী লীগের যে শক্ত ভিত্তি ছিলো, সেটাও এক প্রকার ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেছে। এসব জনপ্রতিনিধিরাও গ্রেপ্তার ও জনরোষে পড়ার ভয়ে আত্মগোপনে চলে গেছেন। অনেকেই পাড়ি জমিয়েছেন ভারতসহ বিভিন্ন দেশে।
- বিষয় :
- আত্মগোপন