যুদ্ধদিনের স্মৃতি
পার্বত্য চট্টগ্রাম ও দক্ষিণ চট্টগ্রামমুক্ত অভিযান

ফাইল ছবি
নাসিরুদ্দিন চৌধুরী
প্রকাশ: ২৮ ডিসেম্বর ২০২৪ | ২৩:৩১
পার্বত্য চট্টগ্রাম মুক্ত করে মেজর জেনারেল সুজান সিং-এর নেতৃত্বে মুজিব বাহিনী ও ভারতীয় স্পেশাল ফ্রন্টিয়ার ফোর্সের সমন্বয়ে গড়া বিশেষ বাহিনী। তারা দক্ষিণ চট্টগ্রাম দখল করে মেরিন একাডেমি পর্যন্ত আসে। এ সম্পর্কে লে. জেনারেল জে আর জ্যাকব লিখেছেন, মেজর জেনারেল সুজান সিং উবানের নিয়ন্ত্রণাধীন স্পেশাল ফ্রন্টিয়ার ফোর্সকে প্রয়োজনে ব্যবহার করার ব্যবস্থা করা হয়। আমাদের আক্রমণে তাদের সম্পৃক্ত করার ব্যাপারে মানেকশ’ আমাদের চাপ দিচ্ছিলেন। আমি তাদের আলাদা কোনো অ্যাসাইনমেন্ট দেওয়ার কথা ভাবছিলাম। মিজোরাম থেকে দুটি ইনফ্যান্ট্রি ব্যাটালিয়ন যেহেতু আমরা সরিয়ে এনেছিলাম, আমি পরামর্শ দিই, সুজান সিংয়ের বাহিনী মিজোরাম থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামে ঢুকে পড়ে কিছু কমান্ডো ও অনিয়মিত বাহিনীর সামান্য কিছু সদস্যের নিয়ন্ত্রণে থাকা রাঙামাটি দখল করবে এবং চট্টগ্রাম আক্রমণের উপক্রম করবে। এলাকাটি পাহাড় ও ঘন বনজঙ্গলে পূর্ণ থাকায় সুজান সিংয়ের বাহিনী তাদের ওপরে অর্পিত দায়িত্ব সহজেই পালন করতে সমর্থ হয়। যুদ্ধবিরতির পর তারা চট্টগ্রামে চলে আসে এবং সেখান থেকে তাদের ভারতে ফিরিয়ে নেওয়া হয়।
কক্সবাজার অভিযান
পাকিস্তানিরা যেন স্থলপথে পালিয়ে বার্মায় যেতে না পারে সে জন্য কক্সবাজারেও একটি অভিযান চালানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এই উদ্দেশ্যে ভারতের ১/৩ গুর্খা রাইফেলস ব্যাটালিয়ন এবং একটি বিহার ব্যাটালিয়নের দুটি কোম্পানি নিয়ে ‘রোম ফোর্স’ নামে একটি নতুন বাহিনী গঠিত হয়। এই বাহিনীকে কয়েকটি মর্টারও দেওয়া হয়। বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ ‘ভিক্রান্ত’ থেকে এই বাহিনীকে বিমান সহায়তা এবং কামানের সাহায্যে সহায়তা দেওয়ার নির্দেশ ছিল। ‘রোম ফোর্স, ভারতের কলকাতা বন্দরে একটি বাণিজ্যিক জাহাজে ওঠে ১১ ডিসেম্বর রাত্রে এবং ১৪ ডিসেম্বর জাহাজটি কক্সবাজারের অদূরে পৌঁছে যায়। এরপর কক্সবাজারের মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তায় ‘রোম ফোর্স’-এর সদস্যরা কক্সবাজারে অবতরণ করে। কিন্তু সেখানে তারা কোনো পাকিস্তানি সৈন্যকে দেখতে পায় না। ১৬ ডিসেম্বর ওই অভিযানটি বাতিল করে দেওয়া হয়। ততক্ষণে অবশ্য পাকিস্তানিরা আত্মসমর্পণ করে ফেলে এবং যুদ্ধবিরতি ঘোষিত হয়েছে।
এই অভিযানের প্রেক্ষাপট এবং খুঁটিনাটি বর্ণনা পাওয়া যায় জ্যাকবের গ্রন্থে। তিনি লিখেছেন, ‘পাকিস্তানিরা যাতে বার্মায় পালিয়ে যেতে না পারে, সেই লক্ষ্যে সমুদ্রপথে কক্সবাজারে সৈন্য পাঠানোর জন্য ৯ ডিসেম্বর জেনারেল মানেকশ ফোনে নির্দেশ দেন। আমি তাকে বললাম যে, তেমন কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু তিনি তার কথায় অনড় রইলেন। আমি বললাম, উভচর অভিযানরে জন্য প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কোনো বাহিনী আমাদের নেই এবং আমাদের লাইফ বেল্ট, স্ক্রাম্বলিং নেট বা ল্যান্ডিং ক্র্যাফ্ট কিছুই নেই। সবচেয়ে বড় কথা, যে সৈন্যদলকে তিনি পাঠাতে চাইলেন, সমুদ্র সম্পর্কে তাদের কোনো অভিজ্ঞতাও নেই। আমাকে থামিয়ে দিয়ে তিনি বললেন, তিনি কোনো অজুহাত শুনতে রাজি নন এবং তিন বাহিনীর চিফ অব স্টাফের এটাই নির্দেশ। উপযুক্ত একটি বাণিজ্যিক জাহাজ ঠিক করে রাখার জন্য কলকাতায় নৌবাহিকীকে আমি অনুরোধ করি। সৌভাগ্যবশত বিশ্ব বিজয় তখন সবেমাত্র মাল কমান্ডে আমরা নৌবাহিনী সঙ্গে আলোচনা করি। বেশ কয়েকটি উভচর অপারেশনে প্রশিক্ষণে প্রয়োজন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আমি বার্মায় কাজ করেছি এবং সেখানকার তটরেখা ও সৈকত সম্পর্কে আমার সম্যক ধারণা ছিল। উখিয়ার সৈকত ছিল মৃদু ঢালসম্পন্ন এবং বেশ কিছু খাঁড়ি সেখানে ছিল যেগুলো সরাসরি লাইফ বেল্ট নেই এবং আমাদের সৈন্যরা আগে কখনও সমুদ্র দেখেনি, আমি নৌবাহিনীকে বোঝাই, লান্ডিং ক্রাফ্টগুলো সৈকতে রেখে জোয়ারের সময় সেগুলো ভাসানো যেতে পারে। নৌবাহিনী এতে সম্মত হয়, কিন্তু পরে এই পরিকল্পনা তারা বদলে ফেলে। এর পরিণতি হয় ভয়ংকর। পরিকল্পনা অনুযায়ী সৈন্যদল নিয়ে একটি বাণিজ্যিক জাহাজ ১০ ডিসেম্বর রওনা দিয়ে ১২ ডিসেম্বর নির্দিষ্ট অবস্থানে পৌঁছে যাওয়ার কথা ছিল। জাহাজ থেকে সৈন্যদের নামানোর জন্য দুটি এলএসটি ব্যবহার করার কথা ছিল, সৈন্যরা যাতে পায়ে পানি না লাগিয়ে তীরে নামতে পারে। বিমানবাহী জাহাজ ভিক্রান্ত থেকে প্রয়োজনীয় বিমান ও গোলন্দাজ-সহায়তা পাওয়ার কথা ছিল। রোমিও কোডনেম বিশিষ্ট এই বাহিনীকে জড়ো করা হয়েছিল তাড়াহুড়ো করে। আমরা ঠিক করে রেখেছিলাম, ২য় কোরের অধীনে ব্রিগেডিয়ার এস এস রাইয়ের কমান্ডে ৮ মাউন্টেন আর্টিলারি ব্রিগেড, ১/৩ গুর্খা রেজিমেন্ট, ১১ বিহারের দুটি কোম্পানি এবং একটি আর্টিলারি এই ফোর্সে থাকবে। এই অভিযানে নৌবাহিনীর ১৫০ জনের একটি দলের অংশগ্রহণ করার কথা থাকলেও শেষ পর্যন্ত তারা আসেনি। নির্ধারিত সময়ের দু’দিন পরে ১২ ডিসেম্বর এই দল কলকাতা থেকে যাত্রা শুরু করে।
সমুদ্রে থাকাকালীনই ১৪ ডিসেম্বর বাহিনীকে আইএনএস গিলদার ও ঘড়িয়ালের তোলা হয়। ম্যাপ দেখে সব পরিকল্পনা করা হয়েছিল বলে অকুস্থলে পৌঁছানোর পর সৈকতের প্রকৃত জরিপ করার ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল। এর মধ্যে নৌবাহিনীও পূর্বনির্ধারিত পরিকল্পনা বদলানোর সিদ্ধান্ত নেয় এবং সৈন্যদের নামানোর জন্য নৌকা ব্যবহারের চেষ্টা করে। এই কাজের জন্য সৈকতের প্রাথমিক সমীক্ষাও যথাযথভাবে করা হয়নি। খাঁড়িগুলো সম্পর্কে নৌবাহিনীকে আমি আগেই সতর্ক করে দিয়েছিলাম। তারপরও একটি নৌকা কূলে ভেড়ার চেষ্টা করতে গিয়ে সোজা একটি খাঁড়িতে ঢুকে যায়। মাত্র ১২ জন সৈনিক তীরে পৌঁছাতে পারে এবং তাদের মধ্যে দু’জন ডুবে যায়। আরেকবাবের চেষ্টায় ৩০ জন সৈনিককে তীরে নামানো হয়। ভিক্রান্ত এতে অংশ নেয় নি। ততক্ষণে পরিষ্কার বোঝা গেছে যে, ওই এলাকায় কোনো শত্রুসৈন্য ছিল না। কাছাকাছি শুধু মুক্তিবাহিনীর একটি ক্যাম্প ছিল। শেষ পর্যন্ত এই সৈন্যদলকে ১৬ এবং ১৮ ডিসেম্বরের মধ্যে দেশি নৌকায় করে জাহাজ থেকে নামানো হয়। দুর্বল পরিকল্পনার ফসল তাড়াহুড়ো-করে করা এই অপারেশন থেকে বড় ধরনের লোকসানের হাত থেকে আমরা বেঁচে যাই স্রেফ ভাগ্যক্রমে। সেনাপ্রধানের একটি টেলিফোন ছাড়া দিল্লির সার্ভিস হেডকোয়ার্টাস থেকে আর কোনো লিখিত নির্দেশ পাঠানো হয় নি। উভচর অভিযানে প্রয়োজন বিশেষ ধরনের যান ও সাজ-সরঞ্জাম, সুসমন্বিত বিস্তৃ
ত পরিকল্পনা, অংশগ্রহণকারী সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনীর সদস্যদের নিবিড় প্রশিক্ষণ এবং মহড়া। এ সমস্ত পূর্বশর্তের কোনোটিই ছিল না’।*
* লে জেনারেল জে এফ আর জেকব : সারেন্ডার অ্যাট ঢাকা : একটি জাতির জন্ম (ঢাকা : ইউপিএল, ২০১১) পৃ-১০১-১০২।
- বিষয় :
- স্মৃতি