ক্যামেরায় জীবনের গল্প

জয়িতা আফরিন তৃষা। ছবি: ফয়সাল সিদ্দিক কাব্য
রিক্তা রিচি
প্রকাশ: ১০ মার্চ ২০২৪ | ০৭:২৪ | আপডেট: ১০ মার্চ ২০২৪ | ১৬:২০
বাংলাদেশের বাস্তবতায় অধিকাংশ নারীকে অনেক প্রতিবন্ধকতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। সেখানে নারী হিসেবে ফটোগ্রাফিকে প্যাশন ও পেশা হিসেবে নেওয়া চ্যালেঞ্জিং। সেই চ্যালেঞ্জিং এ কাজে তাঁর ছবি অন্যদের হৃদয়ে অনুরণন সৃষ্টি করতে পারে। জীবনের গল্প ক্যামেরার আঁচড়ে ফুটিয়ে তোলেন জয়িতা আফরিন তৃষা। আত্মপ্রত্যয়ী এ নারীর ছবিতে প্রধান হয়ে ধরা দেয় ঢাকার রাস্তা, জ্যাম, ভিড় ইত্যাদি উঠে আসে। ঢাকা ঠিক যেমন সেভাবেই উপস্থাপন করার চেষ্টা করেন তিনি। একজন রিকশাওয়ালার বসে থাকা, একটি পরিবারের পথের জীবনযাপন, বাচ্চা মেয়েদের ফুল বিক্রি, প্রেমিক-প্রেমিকার বসে থাকা– এমন হাজারো গল্প দেখা যায়। আর সেই গল্প তিনি ছবিতে প্রকাশ করেন।
জয়িতা আফরিনের ছবি চিরচেনা ও অচেনা দুই ধরনের গল্প বলে। ছবি তোলার আগে তিনি রীতিমতো একটা গবেষণা চালান। ক্যামেরায় ক্লিক করার আগে মস্তিষ্কে তাঁর প্রতিফলন ঘটান। তিনি বলেন, ‘ছবি তোলার জন্য চিন্তার জায়গা পরিষ্কার করতে হবে। যে ছবি তুলব বা যার ছবি তুলব, সেখানে মনোযোগ দিতে হবে। পর্যবেক্ষণ করতে হবে। ব্যক্তির ভেতরের চরিত্রকে আবিষ্কার করতে হবে। ছবির মাধ্যমে যদি সেগুলো ফুটিয়ে তোলা যায়, তাহলে ছবি কথা বলবে। মানুষের ভেতরের সত্তা যেন ছবিতে প্রতিফলিত হয়, সেদিকে খেয়াল করতে হবে। আমি ছবি তুলতে সময় নিই। ভালো করে দেখি। শুধু তোলার জন্য ছবি তুলি না।’
জয়িতা আফরিনের ছবি তোলার প্যাশন ২০০৩ সালে শুরু হয়। তখন তিনি উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করেছেন। ২০০৪-০৫ সালে পাঠশালা থেকে ডিপ্লোমা ও অ্যাডভান্স ডিপ্লোমা করেছেন ফটোগ্রাফিতে। তখন তাঁর ছবি তোলা শুরু হয় ডকুমেন্টারি ও স্ট্রিট ফটোগ্রাফি দিয়ে। এরপর লম্বা বিরতি নেন। বিয়ে করেন।
সংসার ও সন্তান সামলান। তাঁর ভাষায়, ‘বিরতির পর আবার যখন শুরু করি তখন দেখলাম– সংসার, সন্তান সামলে ডকুমেন্টরি ও স্ট্রিট ফটোগ্রাফি করা কঠিন। ডকুমেন্টরি ছবির জন্য সারাদিন বাইরে বাইরে ঘুরতে হবে। অনেক সময় দিতে হবে। স্ট্রিট ফটোগ্রাফির ক্ষেত্রেও তাই। পরে আমি একজন মডেলকে দিয়ে ক্যারেক্টার প্লে করানোর চিন্তা করলাম। পরিচালক যেমন একজন অভিনেতা বা অভিনেত্রীকে দিয়ে কাজ করান, ব্যাপারটা ঠিক তেমনই। তাঁকে রবীন্দ্রনাথের নায়িকা কিংবা কোনো উপন্যাসের অন্য কোনো চরিত্র দিলাম। ওভাবেই একটা চরিত্রের মাধ্যমে ছবিতে গল্প বলার চেষ্টা করেছি। পোর্ট্রেট ফটোগ্রাফি ও লাইফস্টাইল সম্পর্কিত ছবি তুলেছি। এমনভাবে তুলি যেন মনে হয় ছবির মধ্য দিয়ে একটা চরিত্রকে দেখা যায়।’
ফটোগ্রাফির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের নারীদের বাধা ও প্রতিবন্ধকতা নিয়ে জয়িতা বলেন, ‘নিরাপত্তা বড় ব্যাপার। কাজ করে বাসায় ফিরতে ফিরতে অনেক সময় রাত হয়ে যায়। ক্যামেরা নিয়ে বাইরে অনেক রাত পর্যন্ত কাজ করাকে অনেক পরিবার ও সমাজের অনেকে ভালো চোখে দেখে না। এগুলো বড় প্রতিবন্ধকতা। পুরুষ ফটোগ্রাফার বাইক চালিয়ে বিভিন্ন জায়গায় চলে যেতে পারে। কাজ শেষ করে রাতবিরাতে বাসায় ফিরতে পারে। মেয়েদের ক্ষেত্রে তা হয় না বললেই চলে। বাসায় মেয়েদের নিয়ে বেশি টেনশন করে। নারী ফটোগ্রাফারদের মধ্যে ইভেন্ট করা ফটোগ্রাফার খুবই কম। আমি নিজেও অনেক ধরনের বাধার সম্মুখীন হই। যদি বেশি রাতে কাজ থাকে কিংবা শুট করতে বেশি রাত হবে– এমন কাজ নিই না। আর কাজ করলেও বাসায় ফিরি ভয়ে ভয়ে।’
স্বাধীনচেতা এ নারী বলেন, ‘এ দেশের অনেক মা ভাবতেই পারে না ছেলেরা ঘরের কাজ করবে। তারা মনে করে, ছেলেদের কাজ কেবল বাইরে আর মেয়েদের কাজ ঘরে। আসলে কাজ সবার। এখানে লিঙ্গভেদ করার কিছু নেই। আমি যেহেতু কর্মজীবী নারী, আমার ছেলেকে দিয়ে আমি ঘরের কাজ করাই। ও গাছে পানি দেয়, পোষা প্রাণীদের খাবার দেয়, থালাবাসন ধোয়, বিছানা গোছায়। স্বনির্ভরশীলতা দরকার সবার। দেশের বাইরে পড়তে গেলেও তো সবকিছু নিজের করতে হবে। কারও ওপর নির্ভর থাকা যাবে না।’
মেয়েদের মানসিক ও অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী হতে হবে বলে জয়িতার ভাষ্য, ‘আমাদের দেশে মেয়েদের দুর্বল ভাবা হয়। দুর্বলের ওপর সবলের অত্যাচার সব সময় বেশি থাকে। নারী যতদিন পর্যন্ত অর্থনৈতিকভাবে স্বাধীনতা লাভ করবে না, ততদিন পর্যন্ত দুর্বলই রয়ে যাবে।’
লড়াকু এ নারীকে সংসারজীবনে যেমন যুদ্ধ করতে হয়েছে, তেমনি জীবনের সঙ্গে লড়াই করতে হচ্ছে প্রচুর। আক্রান্ত হয়েছিলেন মরণব্যাধি ক্যান্সারে। তবে তিনি ভয় পাননি। থেমে যাননি। জয়িতা বলেন, ‘আমি মানসিকভাবে শক্ত থাকার চেষ্টা করেছি সব সময়। এটি একটি জার্নি ছিল। প্রতিটি জার্নি আমাকে অনেক কিছু শিখিয়েছে। কষ্ট থেকে মানুষ অনেক পরিপক্ব হয়। ক্যান্সারের পর আমার চিন্তাভাবনায় অনেক পরিবর্তন এসেছে। এখন আর বিষণ্নতা আমাকে ছোঁয় না। প্রতিটি মুহূর্ত উপভোগ করার চেষ্টা করি। আমার কাছে প্রতিটি ছোট মুহূর্ত দামি। বেঁচে থাকার চেয়ে সুন্দর আর কিছু নেই। আমি যখন অসুস্থ ছিলাম, তখন কেবলই বাঁচার সাধ জাগত।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমি প্রকৃতি খুব ভালোবাসি। পাহাড়-নদী-সমুদ্র আমার পছন্দের। এলাকায় যত কুকুর আছে, সবার সঙ্গেই আমার ভালো সম্পর্ক। ওদের খাবার দিই। ওরা ওদের দুঃখ-কষ্ট, ক্ষুধার কথা বলতে পারে না। আমাদের সবার উচিত ওদের প্রতি সহায় হওয়া।’