ঢাকা রবিবার, ০৬ জুলাই ২০২৫

এক সংগ্রামী অন্তঃপ্রাণ

এক সংগ্রামী অন্তঃপ্রাণ

জাহানারা ইমাম (৩ মে ১৯২৯–২৬ জুন ১৯৯৪)

শাহেরীন আরাফাত

প্রকাশ: ২৩ জুন ২০২৪ | ১৩:১৩ | আপডেট: ২৪ জুন ২০২৪ | ১৭:৪৮

১৯২৯ সালের ৩ মে অবিভক্ত ভারতের মুর্শিদাবাদ জেলার সুন্দরপুর গ্রামে এক বাঙালি মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন জাহানারা ইমাম। বাবা সৈয়দ আবদুল আলী ছিলেন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। মা সৈয়দা হামিদা বেগম। জাহানারা ইমাম মেট্রিক পাস করেন ১৯৪২ সালে। ১৯৪৪ সালে রংপুর কারমাইকেল কলেজ থেকে আইএ পাস করে ১৯৪৫ সালে ভর্তি হন কলকাতার লেডি ব্রেবোর্ন কলেজে। সেখান থেকে বিএ পাস করেন ১৯৪৭ সালে। ১৯৬০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্জন করেন বিএড ডিগ্রি। যুক্তরাষ্ট্র থেকে সার্টিফিকেট ইন এডুকেশন ডিগ্রি অর্জন করেন ১৯৬৪ সালে। দেশে ফিরে ১৯৬৫ সালে বাংলায় স্নাতকোত্তর পাস করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে।

তবে কলকাতায় ব্রেবোর্ন কলেজের সময়টি ছিল জাহানারা ইমামের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়। তখন পরিচয় ঘটে শরীফ ইমাম ও সহপাঠী অঞ্জলি দাশগুপ্তের সঙ্গে। এ সহপাঠীর মাধ্যমে জাহানারা ইমাম বাম রাজনীতির সঙ্গে পরিচিত হন এবং অল্প বিস্তর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডেও যুক্ত হন। তবে বাবার আপত্তির কারণে রাজনীতি থেকে সরে আসেন। অঞ্জলি নিজের আদর্শ ও মর্যাদাকে ত্যাগ করবেন না বলে প্রথম প্রেমকে প্রত্যাখ্যান করে। তাঁর এই ত্যাগ ও আদর্শের দৃঢ়তা জাহানারা ইমামের জীবনে গভীর ছাপ ফেলেছিল।
জাহানারা ইমাম ১৯৪৮ সালের ৯ আগস্ট শরীফুল আলম ইমামকে বিয়ে করেন। তখন তিনি ময়মনসিংহ বিদ্যাময়ী বালিকা বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক। শরীফ ইমাম ছিলেন সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। তৎকালীন সময়ে বাহুল্যবর্জিত ওই বিয়ে ছিল প্রগতিশীল চিন্তার ধারাবাহিকতা।

কর্মজীবনের পাশাপাশি জাহানারা ইমাম ষাটের দশকে সাহিত্য চর্চা শুরু করেন। মূলত শিশুসাহিত্যিক হিসেবে লেখালেখি শুরু করেন। ছোটদের জন্য কয়েকটি প্রয়োজনীয় বই তিনি অনুবাদ করেন। বইগুলো বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করে। আশির দশক থেকে তিনি গল্প, উপন্যাস, অনুবাদ এবং মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক বহু গ্রন্থ রচনা করেন। তাঁর লেখা কয়েকটি উল্লেখযোগ্য বই হলো–‘একাত্তরের দিনগুলি’, ‘অন্য জীবন’, ‘বীরশ্রেষ্ঠ’, ‘জীবন মৃত্যু, ‘চিরায়ত সাহিত্য’, ‘বুকের ভিতরে আগুন’, ‘নাটকের অবসান’, ‘দুই মেরু’, ‘নিঃসঙ্গ পাইন’, ‘নয় এ মধুর খেলা’, ‘ক্যান্সারের সঙ্গে বসবাস’ ও ‘প্রবাসের দিনলিপি’।

জাহানারা ইমামের মুক্তিযুদ্ধের দিনলিপি ‘একাত্তরের দিনগুলি’ লেখার সূচনা হয়েছিল ১৯৭১-এর উত্তাল ১ মার্চে। এদিনই পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদ অধিবেশনের স্থগিত ঘোষণা দিয়েছিলেন। রাজনীতি সচেতন জাহানারা ইমাম বুঝতে পেরেছিলেন, স্বাধীনতার সময় ঘনিয়ে এসেছে। ১৪ মার্চ লেখক কমিটির ডাকে মিছিলে যোগদান করেন। এই মিছিলে যোগদান তাঁর জীবনে নতুন অধ্যায় সূচনা করে। 

মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময়টায় তিনি এবং তাঁর পরিবারের সদস্যরা মুক্তিযোদ্ধাদের সবরকম সাহায্য করে গেছেন। তাঁদের এলিফ্যান্ট রোডের বাড়ি ‘কণিকা’ হয়ে উঠল মুক্তিযোদ্ধাদের পরম আশ্রয়স্থল। ক্র্যাক প্লাটুনের মুক্তিযোদ্ধারা জানতেন, জাহানারা ইমামের বাড়ি কণিকাতে গেলেই ভালোমন্দ কিছু হলেও খাওয়া জুটবে। পাওয়া যাবে আশ্রয়। তাই মুক্তিযোদ্ধারা এই বাড়িতে লুকিয়ে আশ্রয় নিতেন। শরীফ ইমাম এক সময় সরকারি প্রকৌশলী ছিলেন। ব্রিজের ঠিক কোন কোন পয়েন্টে বিস্ফোরণ ঘটালে ব্রিজ ভাঙবে অথচ কম ক্ষতি হবে অর্থাৎ দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সহজে মেরামত করা যাবে, তিনি সেভাবে বিস্তারিত তথ্য দিতেন মুক্তিযোদ্ধাদের।

মুক্তিযুদ্ধ যখন তুঙ্গে তখন অসংখ্য তরুণ মুক্তিযুদ্ধের গেরিলা বাহিনীতে নাম লিখিয়েছিলেন। সেই সময়ে বড় ছেলে তরুণ রুমীও গেরিলা বাহিনীতে নাম লেখান। একপর্যায়ে পাকিস্তানি সেনারা রুমীসহ বাবা শরীফ ইমাম ও ছোট ভাই জামীকেও ধরে নিয়ে যায়। অকথ্য নির্যাতনের শিকার হন সবাই। দু’দিন পর পাকিস্তানি বাহিনীর অত্যাচারের চিহ্ন শরীরে ও হৃদয়ে বহন করে শরীফ ইমাম ও জামী ফিরে এলেও রুমী আর কখনও মায়ের কোলে ফিরে আসেননি। 
রুমীর শোকে শরীফ ইমাম একাত্তরের ১৪ ডিসেম্বর হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। রুমী ও শরীফকে হারিয়ে জাহানারা ইমাম কখনও একা হননি। লাখো তরুণ শহীদের মা হিসেবে স্বীকৃতি পান ‘শহীদ জননী’।

১৯৯১ সালের ২৯ ডিসেম্বর গণধিকৃত গোলাম আযমকে জামায়াতে ইসলামী তাদের দলের আমির ঘোষণা করে। এতে বাংলাদেশে গণবিক্ষোভ শুরু হয়। বিক্ষোভের অংশ হিসেবে ১৯৯২ সালের ১৯ জানুয়ারি জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে ১০১ সদস্যবিশিষ্ট একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি গঠিত হয়। ১৯৯২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিটি’ গঠিত হয়। আহ্বায়ক হন জাহানারা ইমাম। ওই বছরের ২৬ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ‘গণআদালত’-এর মাধ্যমে একাত্তরের ঘাতক গোলাম আযমের ঐতিহাসিক বিচার অনুষ্ঠিত হয়। গণআদালতে গোলাম আযমের বিরুদ্ধে ১০টি সুনির্দিষ্ট অপরাধ মৃত্যুদণ্ডযোগ্য বলে চিহ্নিত হয়। জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে আন্দোলন আরও বেগবান হয়। তবে ১৯৯৪ সালে জাহানারা ইমামের শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটতে থাকে। ১৯৮২ সালে তিনি মুখের ক্যান্সারে আক্রান্ত হন। এজন্য প্রতি বছর একবার যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে চিকিৎসা নিতে হতো। ১৯৯৪ সালের ২৬ জুন যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগানের ডেট্রয়েট নগরীর সাইনাই হাসপাতালে ৬৫ বছর বয়সে জাহানারা ইমাম শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
 

আরও পড়ুন

×