ঢাকা বৃহস্পতিবার, ০৩ জুলাই ২০২৫

তিব্বতি মঠ রক্ষা করছেন নারীরা

তিব্বতি মঠ রক্ষা করছেন নারীরা

.

 প্রমিত দেবনাথ

প্রকাশ: ০৬ জুলাই ২০২৪ | ২৩:৪৭ | আপডেট: ০৭ জুলাই ২০২৪ | ১৩:৫৮

চরম আবহাওয়া ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ১৫ শতকের তিব্বতি মঠগুলো হুমকির মুখে পড়েছে। তিব্বত-নেপাল সীমান্তে ধোলাগিরি পর্বতমালায় নির্মিত কাগ চোড মঠ সংরক্ষণে এগিয়ে এসেছেন স্থানীয় নারীরা। এই মঠ নির্মাণের পেছনে এক মিথ রয়েছে। মঠের সন্ন্যাসী তাশি কুঙ্গা এক অশুভ শক্তির সঙ্গে গুরু রিনপোচের যুদ্ধের প্রাচীন কাহিনি বর্ণনা করেন।

কথিত আছে, কয়েক শতাব্দী আগে অশুভ শক্তিটি তিব্বতের একটি মঠে খারাপ কাজে লিপ্ত হয়েছিল। গুরু রিনপোচে অশুভ শক্তিকে দক্ষিণ নেপালের উঁচু মুস্তাং পর্যন্ত তাড়া করেন এবং এক ভয়ানক যুদ্ধের পর তাকে পরাজিত করেন। এর পর পর্বতমালাজুড়ে ওই অশুভ শক্তির দেহাবশেষ সমাধিস্থ করেন। স্থানীয়রা অশুভ শক্তির দেহাংশের ওপর মঠ তৈরি করে ওই পবিত্র স্থানকে সম্মানিত করেন।

আজ থেকে প্রায় দুই দশক আগে ১৫ শতক বা তার চেয়ে পুরোনো অনেক মঠ ভেঙে পড়তে শুরু করে। বিশেষজ্ঞরা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবকে মঠ ধসের কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন। অঞ্চলজুড়ে ভয়াবহ ঝড় এবং তীব্র বৃষ্টিপাতের ফলে মাটির আর্দ্রতা বাড়তে থাকে, যার ফলে ছাদের ফুটো হওয়া এবং স্যাঁতসেঁতে হওয়ার মতো সমস্যা দেখা দেয়। 

কুঙ্গা বলেন, ‘বৌদ্ধদের জন্য মঠগুলোর চিত্রকর্ম ও শিল্পকর্ম বিশেষভাবে পূজনীয়। আমরা কখনোই অর্ধ-ক্ষতিগ্রস্ত মূর্তির আরাধনা করতে পারি না। এটি মেরামত করার জন্য কেউ ছিল না। আমরা ভেবেছিলাম দেবতারা আমাদের ওপর ক্রুদ্ধ হয়েছে।’ 

হিমালয়সংলগ্ন অঞ্চল ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে। যখন অতি বৃষ্টিপাত হয়, তখন দেবে যাচ্ছে। খরাও সাধারণ একটি ঘটনা এখানে। ২০২৩ সালে ভারী বৃষ্টিপাতের ফলে মুস্তাংয়ের গ্রামগুলো বন্যায় প্লাবিত হয়, ব্যাপক ক্ষতি হয়।

বৌদ্ধ মঠগুলো বহুকাল ধরে তিব্বতি সংস্কৃতির আধার। তবে চরম আবহাওয়ার ব্যাপারটি মঠগুলোর জন্য হুমকিস্বরূপ। দেয়াল শক্তিশালী করা থেকে শুরু করে ধাতব মূর্তি তৈরি করছেন স্থানীয় নারীরা। চিত্রকর্ম পুনরুদ্ধার করার স্বার্থে পশ্চিমা শিল্প সংরক্ষণবাদীদের দ্বারা প্রশিক্ষিত স্থানীয়দের একটি দল গোলাকার কাঠ, নদীর পাথর এবং জলরোধী স্থানীয় কাদামাটি ব্যবহার করে মন্দিরের ছাদের ফুটো, দেয়াল চিত্র, মূর্তি, ভাস্কর্য স্তম্ভ এবং ছাদের সজ্জা পুনরুদ্ধার করে, যা শতাব্দী-প্রাচীন স্মৃতিস্তম্ভগুলোকে নতুন জীবন দিয়েছে।

পুনরুদ্ধার প্রকল্পে নেতৃত্ব দেন ইউরোপের শিল্প সংরক্ষক লুইগি ফিয়েনি। জানান, বেশির ভাগ স্থানীয় লোকজন এর আগে কখনও কলম বা পেইন্ট ব্রাশ ধরেননি। তাই তাদের ব্যাপক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে হয়েছিল। তিনি বলেন, ‘মুস্তাং ভ্রমণকারী পর্যটকরা ধর্মের প্রতি গভীরভাবে আকৃষ্ট। তাই আমরা বুঝতে পারি যে, এই পবিত্র নিদর্শনগুলো শুধু তাদের ঐতিহাসিক তাৎপর্যের জন্যই নয়, জীবিকা নির্বাহের জন্যও মঠ সংরক্ষণ করা প্রয়োজন। প্রাথমিকভাবে ১০ জন সদস্য নিয়ে গঠিত এই দলটি ধীরে ধীরে ৪৫ জন সংরক্ষকের একটি দল হয়ে ওঠে, যাদের মধ্যে বেশির ভাগই নারী।

যদিও প্রাথমিকভাবে কোনো মহিলাকে দলে নেওয়া উদ্দেশ্য ছিল না আমাদের। স্থানীয় ঐতিহ্য অনুযায়ী, নারীর পবিত্র বস্তু স্পর্শ করা নিষিদ্ধ। তবুও নারীরা অবশেষে লো মানথাং পুনরুদ্ধার প্রকল্পে অংশ নেন। স্থানীয় ধর্মীয় নেতাদের সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে কয়েক বছর সময় নিয়ে সংরক্ষণ দলে স্থানীয় নারীদের অন্তর্ভুক্ত করতে সফল হয়েছি আমরা।’  

বিবাহিত তিব্বতি নারীরা সাধারণত রান্না করা, পরিষ্কার করা, পশুদের দুধ খাওয়ানো, মাখন মন্থন করা এবং জ্বালানির জন্য ইয়াকের গোবর সংগ্রহ করেন। ৪০ বছর বয়সী তাশি ওয়াংমোর সময় কাটত গৃহস্থালি কাজ, ভেষজ সংগ্রহ ও বিক্রি করে। এগুলো করে তিনি কখনোই খুব বেশি আয় করতে পারেননি। তিনি যখন পুনরুদ্ধার প্রকল্পে প্রশিক্ষণ গ্রহণ এবং দৈনিক মজুরি অর্জনের সুযোগ পান, তখন তিনি এতে ভীষণ উৎসাহী হন। ওয়াংমো বলেন, ‘এটি আমাদের নারীকে বাড়ির সীমানা থেকে মুক্ত হতে, আমাদের দক্ষতা বাড়াতে এবং নতুন সুযোগ খুঁজে পেতে সক্ষম করেছে। অন্যথায় জীবিকা নির্বাহ করা আমাদের জন্য কষ্টকর হয়ে দাঁড়াত।’ 

অন্য এক নারী পুনরুদ্ধারকারী ডলমা সেরিং বিশ্বাস করেন, মঠের পুনরুদ্ধারে অংশ নিয়ে তিনি আধ্যাত্মিক যোগ্যতা অর্জন করবেন এবং তাঁর কাজের মাধ্যমে তিব্বতি বৌদ্ধ ধর্মের প্রচারে অবদান রাখবেন। সেরিং বলেন, ‘আমরা যদি আমাদের সংস্কৃতিকে বাঁচাতে চাই, আমাদের সবাইকে এক হতে হবে এবং মঠগুলো বাঁচাতে হবে। কারণ এখানকার সবকিছুই আমাদের ধর্মীয় চিন্তাধারা ও আদর্শকে নির্দেশ করে।’

ফিয়েনির মতে, পুনরুদ্ধারের প্রচেষ্টা একটি সাংস্কৃতিক পুনর্জাগরণের জন্ম দিয়েছে। অসংখ্য নারী ও তরুণী ঐতিহ্যবাহী কারুশিল্পের প্রশিক্ষণ যেমন পেয়েছেন, তেমনি বহুদিনের হারিয়ে যাওয়া উৎসব পুনরুজ্জীবিত করা সম্ভব হয়েছে।

আরও পড়ুন

×