ক্যামেরাবন্দি প্রতীক্ষা

জাতীয় জাদুঘরের নলিনীকান্ত ভট্টশালী গ্যালারি
দ্রোহী তারা
প্রকাশ: ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ২৩:৪৬ | আপডেট: ০৬ অক্টোবর ২০২৪ | ১৮:২৭
জাতীয় জাদুঘরের নলিনীকান্ত ভট্টশালী গ্যালারিতে ‘গুম: জান ও জবান’ শীর্ষক আলোকচিত্র প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। ৩০ আগস্ট শুরু হওয়া এ প্রদর্শনী চলেছে ৬ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। আলোকচিত্রী মোশফিকুর রহমান জোহান বিভিন্ন সময়ে গুম হওয়া ব্যক্তিদের স্বজনদের আর্জি ক্যামেরায় বন্দি করেছেন, যা এ প্রদর্শনীতে স্থান পেয়েছে। এসব ছবিতে প্রিয় মানুষকে জীবিত খুঁজে পাওয়ার প্রচেষ্টা, আকাঙ্ক্ষা ও আকুলতা জীবন্ত হয়ে ধরা পড়েছে। প্রদর্শনীর ছবি তুলেছেন জে জে পার্লিয়া, লিখেছেন দ্রোহী তারা
‘মানুষটা ফিরে আসবে’, ‘আমার সন্তান তার বাবাকে বাবা বলে ডাকতে যেন পারে’, ‘তার ফিরে আসার অপেক্ষায় বাকি জীবন কাটিয়ে দেব’, ‘বাবা কেন আসে না, সন্তানদের এই কেন প্রশ্নের উত্তর আমি কী দেব?’– এ রকম নানা আশা-হতাশা নিয়ে বিগত ১৪ বছর অনেক মা, বোন, সন্তান বেঁচে আছেন। দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন, অনুরোধ করছেন তাদের মানুষটিকে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য। সেইসব মানুষের সংগঠন হলো– ‘মায়ের ডাক’। গুমের শিকার ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যরা ২০১৪ সাল থেকে তাদের প্রিয়জনেরা কোথায় আছেন–জানতে চেয়ে একত্র হতে শুরু করেন এবং তখন থেকেই বাংলাদেশে তারা ‘আন্তর্জাতিক গুম প্রতিরোধ দিবস’ পালন করে আসছেন।
তারই ধারাবাহিকতায় নানা ঘাত-প্রতিঘাত পাড়ি দিয়ে গত ৩০ আগস্ট জাতীয় জাদুঘরের নলিনীকান্ত ভট্টশালী গ্যালারিতে গুম হওয়া ব্যক্তিদের পরিবারের দুর্ভোগের চিত্র নিয়ে ‘গুম: জান ও জবান’ শীর্ষক আলোকচিত্র প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়।
আলোকচিত্রী মোশফিকুর রহমান জোহান গত ৩-৪ বছরে ক্যামেরায় বন্দি করেছেন এসব বেদনা ও অপেক্ষায় থাকা মানুষের চিত্র। তিনি ছবি তোলার সময়কার স্মৃতি হাতড়ে বলেন, ‘‘এ ছবিগুলো তোলা আমার জন্য অনেক বেদনাদায়ক একটা সময় ছিল। মানুষগুলোর আবেগ, কষ্টগুলো ক্যামেরাবন্দি করেছি আমি। এমন অনেক সময় দেখা গেছে, পরিবারের সদস্যরা কথা বলতে বলতে কান্না করছেন। তাদের সেই কষ্ট দেখে আমি তখন নিজেকে সংবরণ করতে পারিনি। আমিও তাদের সঙ্গে কেঁদেছি। আপনজন হারানোর স্মৃতি বলতে গিয়ে তারা খুব ভেঙে পড়েন এত বছর পরও। এ বিষয়গুলো তো নেওয়ার মতো নয়, মানসিক যন্ত্রণাদায়ক। একজন আপাকে তাঁর স্বামী বলছেন, ‘চা এনে দাও, তোয়ালে এনে দাও’। এসব যে বলছেন, তা তিনি শুনতে পান। আবার অন্য একজন আপা তাঁর স্বামীকে স্বপ্নে দেখেছেন যে, তিনি শুয়ে আছেন। আপা তাঁকে প্রশ্ন করেন, ‘আমরা তোমাকে সারাদিন খোঁজ করি আর তুমি শুয়ে আছো। তখন তাঁর স্বামী বলেন, তুমি আমাকে কীভাবে খুঁজতেছ? তুমি তো আমাকে ভালোভাবে খুঁজতেছ না। তুমি যদি ভালো করে খোঁজো, তাহলে ঠিকই পাবে।’ এই স্বপ্ন দেখে তিনি আগের মতো আবার রাস্তায় দাঁড়ানো শুরু করেন। এ রকম আরও বহু ঘটনার সম্মুখীন হয়েছি আমি। তাই সবসময় সচেতন থাকতাম যে– এ রকম সেনসিটিভ বিষয়গুলো নিয়ে তাদের প্রশ্ন করার ক্ষেত্রে। সরাসরি প্রশ্ন না করে কথোপকথনের মাধ্যমে তথ্য জানতাম। তবে প্রদর্শনী করতে পারব না–এটা ভাবিনি কখনও। কারণ আমার মনে হয়েছে কাজটা যেভাবেই হোক করতে হবে, যত প্রতিকূলতাই আসুক না কেন। পরিবারগুলোর সঙ্গে থাকতে থাকতে একটা সময় হয়েছে যে, এটা আমার পরিবার। পরিবারের প্রতি আমার দায়বদ্ধতার জায়গা আছে। সেই জায়গা থেকে কাজটা করা।’ ‘মায়ের ডাক’-এর পরিবার মানে প্রতিটি গুম পরিবার আলাদা আলাদা। আবার এই আলাদা পরিবারগুলো মিলে একটা পরিবার।’’
প্রদর্শনীতে আসা দর্শনার্থীরা ছবিগুলো দেখে খুব বিস্ময় প্রকাশ করেন। পর্দার ফাঁক দিয়ে চশমা চোখে অপলক তাকিয়ে থাকা নারী, গুম হওয়া মানুষটির খোঁজে বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে প্ল্যাকার্ড হাতে অক্লান্তভাবে দাঁড়িয়ে থাকা, স্মৃতিচারণ করা ডায়েরির পাতা কিংবা ঝাপসা সিসিটিভি ফুটেজ–সবকিছুই দর্শনার্থীরা শুধু দেখছেন না, পর্যবেক্ষণও করছেন, ছবিও তুলে নিচ্ছেন। অনেক দর্শক আবার বেশ সময় নিয়ে ছবিগুলো দেখছিলেন।
লাল ফ্রক পরা ছোট্ট মেয়ে ও তার বাবার ফ্রেমবন্দি ছবিটি দেখিয়ে এক দর্শনার্থী বলেন, ‘এও কি সম্ভব? এতটা বছর ধরে অপেক্ষা। মারা গেছে না বেঁচে আছে–সেটা জানা নেই। কিন্তু এই মেয়েটা তার বাবা ফিরে আসবে, সেই অপেক্ষা করছে এখনও। এই গণঅভ্যুত্থান না হলে হয়তো এগুলোও সামনে আসত না, আমরাও জানতে পারতাম না আয়নাঘরের মতো ভয়াবহ জায়গার কথা। আমি চাই, এই গুম হওয়া মানুষগুলো ফিরে আসুক।’
প্রদর্শনীর কিউরেটর সরকার প্রতীক বলেন, ‘‘গুমের বিষয়টা তো আজকের না, এটা বহু বছর ধরে চলে আসছে। জনসাধারণের সামনে আসেনি তেমনভাবে। এখন আসছে। একটা গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে আমরা নিজেদের চাওয়াগুলো বলতে পারছি। আসলে ভাবিনি যে এ ছবিগুলো আমাদের দেশে দেখাতে পারব। মনে করেছি যে, কাজটাকে চালিয়ে যাওয়া উচিত যতদিন পারা যায়। প্রদর্শনীতে ১৭টি পরিবারের গল্পের ছবি আছে। কিন্তু গুম পরিবার এখন অনেক বেশি। অফিসিয়ালি ৭০৯টি পরিবার তালিকায় আছে। আমরা নিয়মিত বসতাম কাজটাকে কীভাবে আরও ভালোভাবে করা যায়। গণঅভ্যুত্থানের পর ৩০ আগস্ট ‘আন্তর্জাতিক গুম প্রতিরোধ দিবস’ সামনে রেখে এই প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয় খুব অল্প সময়ে। এই দিবস উপলক্ষে কাজটা সবাইকে দেখানো জরুরি মনে করেছিলাম। হঠাৎ করে জাদুঘরে গ্যালারি পাওয়া স্বপ্নের মতো বিষয় ছিল। যে ছবিগুলো আমরা দেশের কোথাও দেখাতে পারব কিনা জামতাম না; সেই ছবি এখন আমরা জাতীয় জাদুঘরে দেখাচ্ছি। এখানে আয়োজন করতে দুই দিন সময় পেয়েছি। অনেক সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও এটা করা হয়েছে। আমাদের চিন্তা ছিল, ছবিগুলো জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দিতে হবে, যেন তারা দেখতে পারে। মানুষকে দেখানোটাই প্রধান উদ্দেশ্য। প্রদর্শনী কতটা শৈল্পিকভাবে সফল হলো সেটি গুরুত্বে আনিনি। পারিবারিক অনেক ছবি আছে এখানে। সেই ছবিগুলোতে আশা জিইয়ে বেঁচে থাকার গল্প জোহান তুলে ধরেছেন। আর আমিও মনে করি, গত ১৫-১৬ বছর যে কথাগুলো বলতে পারিনি, তা এখন বলার সময় এসেছে।’’
এর আগে গত ২৯ আগস্ট গুম প্রতিরোধে নাগরিকদের সুরক্ষাবিষয়ক আন্তর্জাতিক কনভেনশনে স্বাক্ষর করেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। উপদেষ্টাদের সাপ্তাহিক বৈঠকে নাগরিকদের গুম হওয়া থেকে সুরক্ষায় এ সনদে স্বাক্ষর করেন তিনি। প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘এটি একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত। গুমের শিকারদের জন্য আন্তর্জাতিক দিবসের এক দিন আগে আমরা এই সনদে স্বাক্ষর করেছি।’
এ রকম একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত জানতে পারার পর নতুন করে আশায় বুক বাঁধেন গুম হওয়া কাওসার হোসেনের স্ত্রী মিনু। ২০১৩ সালের ৪ ডিসেম্বর মধ্যরাতে কাওসার হোসেনকে নাখালপাড়ার বাসা থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় র্যাব সিভিল পরিচয় দিয়ে। কাওসার স্বেচ্ছাসেবক দল করতেন।
স্মৃতিকাতর হয়ে মিনু বলেন, ‘চার বছর আট মাসের সংসার জীবনে সে আমাকে একা কখনও ছাড়েনি। আমি যেখানে যেতাম, আমার সার্বক্ষণিক ছায়াসঙ্গী সে ছিল। তবুও কাজের খাতিরে তাকে আমি জোর করে ঢাকায় পাঠিয়ে দিই। একটা মাত্র মেয়ে আমাদের, মীম। তিন বছর বয়স থেকে সে বাবার স্নেহ থেকে বঞ্চিত। কাওসার মেয়ে বলতে পাগল ছিল। কাজের থেকে অবসর পেলেই মেয়ের কাছে ছুটে আসত। সেই মানুষটিকে এখন আর পাচ্ছি না। এতটা বছর ধরে খুঁজছি আমরা। পাঁচ আগস্ট রাতে শুনেছিলাম, গুম হওয়া কিছু ব্যক্তিকে ছেড়ে দেওয়া হবে। সেটি শুনে আমি আমার মেয়েকে বলেছিলাম, নামাজ পড়ে দোয়া করো। তোমার বাবাকে আজকে ছেড়ে দেবে, আমি নিয়ে আসব। এই বলে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি।’
তবে মিনুর দৃঢ় বিশ্বাস, তাঁর স্বামী বেঁচে আছেন। এবং এক দিন তিনি খুঁজতে খুঁজতে তাঁকে নিশ্চয়ই ফিরে পাবেন। মিনুর মতো এ রকম আশা আর অপেক্ষার চিহ্নগুলোই মোশফিকুর রহমান জোহান ক্যামেরাবন্দি করে তুলে ধরেছেন সবার সামনে।