জুলাই আন্দোলনের স্মৃতিতে জেগে থাকা মন

গত ১২ ডিসেম্বর আঁচল ফাউন্ডেশন ‘মেন্টাল হেলথ ক্রাইসিস: ডিলিং উইথ পোস্ট জুলাই রেভ্যুলেশনারি আসপেক্টস’ শীর্ষক সেমিনারের আয়োজন করে
তানসেন রোজ
প্রকাশ: ১৪ ডিসেম্বর ২০২৪ | ২২:৪৪ | আপডেট: ১৫ ডিসেম্বর ২০২৪ | ১০:৫২
জুলাই মাসের ১৫ তারিখে তৎকালীন সরকারদলীয় ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের হামলায় যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস রক্তাক্ত, রায়হানও তখন আহত হয়েছিলেন। লাঠির আঘাতে মাথায় চোট লেগেছিল তাঁর। দুই দিন পর ক্যাম্পাস বন্ধ করে তাদের হল থেকে বের হয়ে যেতে বাধ্য করা হলেও তিনি ঢাকায়ই থেকে যান। বাড্ডাতে আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হন। রায়হান জানান, ১৮ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত কোনো রাতেই দুশ্চিন্তায় ঘুম হয়নি। রায়হান ভেবেছিলেন আবারও ঠিকমতো ঘুমোতে পারবেন। কিন্তু চার মাস ধরে রাতে ঘুম ভেঙে যায়। পরিপূর্ণভাবে ঘুম আসে না। সবসময়ই কোনো একটা চিন্তা এসে ভর করে। ঘুমের মধ্যেও বিভিন্ন ধরনের বাজে স্বপ্ন দেখার পর ঘুম ভেঙে যায়। রায়হান জানে না কতদিন এটা সহ্য করতে হবে। এর সমধানটাই বা কী!
একই ধরনের অভিজ্ঞতা সামান্তার ক্ষেত্রেও। গণঅভ্যুত্থানের পর তিনি ভাবছিলেন পড়াশোনা, ক্লাস শুরু করে দিলেই দুশ্চিন্তা কেটে যাবে। কিন্তু তাঁকে অবাক করে দিয়ে প্রতিনিয়তই প্যানিক অ্যাটাক হতে থাকে। ক্লাসে প্রেজেন্টেশন দেওয়ার সময় কোনো কারণ ছাড়াই ভয় পেয়ে থেমে যান। মাঝে মাঝে ফোনের নোটিফিকেশনের রিং শুনে, বাবা-মায়ের ফোনের আওয়াজে, বন্ধুবান্ধব কেউ অসুস্থ হলেও ভীত হয়ে যান। সামান্তা জানান, আন্দোলনের সময় প্রতিমুহূর্তেই ফোন ধরতে তিনি ভয় পেতেন।
এসব বিষয় নিয়েই গত ১২ ডিসেম্বর (বৃহস্পতিবার) স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন আঁচল ফাউন্ডেশন ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে ‘মেন্টাল হেলথ ক্রাইসিস: ডিলিং উইথ পোস্ট জুলাই রেভল্যুশনারি আসপেক্টস’ শীর্ষক এক সেমিনারের আয়োজন করে। সেখানে প্রধান অতিথি ছিলেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফরিদা আখতার। তিনি বলেন, ‘গণঅভ্যুত্থানের পক্ষে আহতদের অঙ্গহানির জন্য তাদের যারা তিরস্কার বা কটুকথা দ্বারা মানসিক আঘাত দেয়, তারা মানুষের মধ্যে পড়ে না। আমরা দেখেছি, আন্দোলনের পর থেকে অনেক মা-বাবাও ট্রমাটাইজড। অনেক পরিবারের মেয়েরা আন্দোলনে ট্রমাটাইজড হয়ে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হচ্ছেন না এই ভয়ে যে, যদি মানুষ জেনে যায় তাহলে তাদের বিয়ে দিতে সমস্যা হতে পারে।’
প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী সায়েদুর রহমান বলেন, ‘গণঅভ্যুত্থানে আহতরা যে পক্ষেরই হোক তারা চিকিৎসা পাবেন। গণঅভ্যুত্থানের পক্ষে থাকা আহতদের অর্ধেককে এখনও সহায়তার আওতায় আনা সম্ভব হয়নি। সর্বোচ্চ চেষ্টা চলছে সব গুছিয়ে নিতে। তাদের শিক্ষা, চিকিৎসা ও সার্বিক প্রয়োজনে সর্বোচ্চ চেষ্টা রয়েছে; যা তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতিতে সহায়ক হবে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক কামাল চৌধুরী বলেন, ‘গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী পরিস্থিতিতে আলোচনায় বিশেষ গুরুত্ব পায় মানসিক স্বাস্থ্যের অন্যতম ও জটিল একটি রোগ– পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডার, যেটিকে সংক্ষেপে ‘পিটিএসডি’ বলা হয়। তীব্র শোক বা মানসিক আঘাত থেকে এ সমস্যা দেখা দেয়। এ কারণে অনেক সময়ই তাদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হয়, সামাজিক সম্পর্কের অবনতি ঘটে, পড়াশোনায় অমনোযোগিতা বা আগ্রহ হারিয়ে ফেলে, কর্মক্ষেত্রে কাজের পারফরম্যান্স খারাপ হয়ে যায়, এমনকি চাকরি বা ব্যবসা ছেড়ে দেওয়ার মতো কাজও করে ফেলে নিজেকে প্রতিরক্ষার জন্য। এর মাঝে অনেকেই কারণ থাকুক বা না থাকুক বিষণ্নতা বা অবসাদে ভুগতে পারেন, এমনকি আত্মহত্যার চিন্তাও শুরু করতে পারেন।’