ঢাকা শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫

কর্মজীবী নারীর দিনলিপি

কর্মজীবী নারীর দিনলিপি

মডেল: নুসরাত; ছবি: কাব্য

আনিকা আনজুম ঐশী

প্রকাশ: ১৪ ডিসেম্বর ২০২৪ | ২৩:০২ | আপডেট: ১৫ ডিসেম্বর ২০২৪ | ১১:০৫

সমতা ও ক্ষমতায়নের প্রতীক হিসেবে দেখা হয় নারীর শ্রমে যুক্ত হওয়াকে। তবে অনেক মধ্যবিত্ত নারীর জন্য কর্মক্ষেত্রের বাস্তব অভিজ্ঞতা অনেকটাই ভিন্ন। অফিস– যা হওয়া উচিত পেশাগত উন্নতির ক্ষেত্র, তা অনেকের জন্য হয়ে দাঁড়ায় কাদা ছোড়াছুড়ি, সূক্ষ্ম বা স্থূল বিদ্রূপ এবং ক্ষতিকর কথোপকথনের আখড়া। এগুলো যে শুধু নারীর পেশাগত কাজকে প্রভাবিত করে তা নয়; একইভাবে এগুলো তাঁর ব্যক্তিগত জীবনেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।

লাঞ্চ ব্যাগ, এক্সেল শিট, চা বিরতি এবং রুদ্ধদ্বার মিটিংগুলো নীরব সাক্ষী হয়ে থাকে নারীর প্রতিদিনের লড়াইয়ের। এ লড়াই মাইক্রোঅ্যাগ্রেশন বা ক্ষুদ্র পরিসরে আক্রমণ এবং বৈরিতার এক জটিল গোলকধাঁধা, যা প্রায়ই নিরীহ ঠাট্টা বা ‘গঠনমূলক সমালোচনা’র ছদ্মবেশে লুকিয়ে থাকে।

মিতার গল্পটি এমনই এক উদাহরণ। একটি কর্মক্ষেত্র থেকে একটি ভ্রমণের জন্য মনোনীত হওয়ার পর তিনি শুনতে পান সহকর্মীদের ফিসফিস– ‘ওকেই কেন এতজনের মধ্যে বেছে নেওয়া হলো? নিশ্চয়ই তার বসের সঙ্গে বিশেষ কোনো সম্পর্ক আছে।’ এমন মন্তব্য করা হয় মিতার দক্ষতার ওপর সন্দেহ থেকে নয়; বরং তার সাফল্যকে ‘অবৈধ উপায়ে অর্জিত’ বলে দেখানোর জন্য।

নূপুরের অভিজ্ঞতাও তিক্ত। এক মিটিংয়ে তিনি সহকর্মীদের সমালোচনা করে বলেছিলেন, ‘অফিসে সবাই আমার পেছনে কথা বলে। তাদের মতে, আমি নাকি বাড়িতে অত্যাচারী, আমার স্বামীর জীবনকে আমি নিয়ন্ত্রণ করি’– এ ধরনের ভিত্তিহীন মন্তব্য নিছক রসিকতা নয়; এগুলো তাঁর ব্যক্তিত্ব ও পেশাদারিত্বকে কালিমালিপ্ত করার উদ্দেশ্যে করা।

তৌসিফার অভিজ্ঞতা আরও গভীর। তিনি একটি এনজিওতে কাজ করেন। একটি প্রকল্পে কঠোর পরিশ্রমী কাজের পর তাঁর প্রকল্পের বিদেশি দাতাগোষ্ঠী তাঁকে প্রশিক্ষণের জন্য বিদেশে আমন্ত্রণ করেন। কিন্তু তাঁর সুপারভাইজার পরে জানান, ‘তুমি ভালো কাজ করেছ; কিন্তু তোমার উন্নতিতে মূল কৃতিত্ব আমার। তাই আমিই প্রশিক্ষণের জন্য বিদেশ যাব, পরে আমি তোমাকে সব শিখিয়ে দেব।’ তৌসিফা হতাশ কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণের জন্য সমালোচনা করা হলেও, বেসরকারি খাতেও সুপারভাইজাররা তাদের অধীনদের পরিশ্রমের কৃতিত্ব নিজের নামে চালিয়ে সুযোগ গ্রহণ করেন।’

একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন আনিরা। তিনি ভিন্ন ধরনের বৈষম্যের শিকার হয়েছিলেন। তাঁর টিমের বেতন বাকি থাকার বিষয়ে জানতে চাইলে সুপারভাইজার বলেন, ‘আপনি বেতন নিয়ে এত উদ্বিগ্ন কেন? আমি ব্যস্ত ছিলাম, চেকগুলো সই করতে পারিনি। যদি কিছুদিন দেরি হয়, ক্ষতি কী? আপনাদের পারফরম্যান্স এমন কিছু নয় যে সময়মতো বেতন দিতে হবে।’ এমন মন্তব্য কাজকে ছোট করার পাশাপাশি তাঁর উদ্বেগকে তুচ্ছজ্ঞান করে। তাঁকে আরও বলা হয়, ‘বেতন সম্পর্কে জানতে চাওয়া ভীষণ অশোভন।’

সাদিয়ার অভিজ্ঞতাও কম গুরুতর নয়। তাঁর সুপারভাইজার তাঁকে আরেক নারী সহকর্মীর সঙ্গে তুলনা করে বলেছিলেন, ‘নদী এখন বিজনেস ডেভেলপমেন্টের কাজ করছে এবং খুব ভালো করছে। সাবধান হও, তোমার চাকরি কিন্তু যায় যায়।’ এমন মন্তব্য সাদিয়ার প্রচেষ্টাকে স্বীকৃতি দেওয়ার বদলে তাঁর মধ্যে অনিরাপত্তার বীজ বপন করে দেয়।

এ ঘটনাগুলো তুচ্ছ মনে হতে পারে, কিন্তু এগুলো কর্মজীবী নারীর প্রতি অসম্মান এবং অবমূল্যায়নের প্রতিদিনের চিত্র। এগুলো আত্মবিশ্বাস ও মর্যাদার ক্ষয় ঘটায়। এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়ে তাদের পেশাগত ও মানসিক সুস্থতায়। কর্মক্ষেত্রে নারীর পোশাক, আচরণ, সম্পর্ক এবং দক্ষতাকে বিদ্বেষপূর্ণ দৃষ্টিতে দেখা হয়। তাদের সাফল্যকে ছোট করা হয় এবং তাদের সংগ্রামকে অপ্রাসঙ্গিক করে দেখানো হয়। নারীর উদ্বেগকে অবজ্ঞা করা, অভিযোগ খারিজ করা এবং কাজের যথাযথ স্বীকৃতি না দেওয়া ব্যবস্থাপনাগত ক্ষমতার অপব্যবহারের নিদর্শন। এভাবে এমন একটি পরিবেশ তৈরি করা হয়, যেখানে নারীকে বারবার যোগ্যতা প্রমাণ করতে হয় এবং ক্রমাগত অবজ্ঞার শিকার হতে হয়।

‘#মিটু’ আন্দোলন কর্মক্ষেত্রে নির্যাতনের গুরুতর ঘটনাগুলোকে সামনে এনেছে। তবে লুকানো ও সূক্ষ্ম বৈষম্য এখনও রয়ে গেছে। নারীর প্রতি সব রকমের সহিংসতার বিরুদ্ধে ১৬ দিনের সচেতনতা কর্মসূচি ১০ ডিসেম্বর শেষ হলো। ২৫ নভেম্বর আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস থেকে ১০ ডিসেম্বর মানবাধিকার দিবস পর্যন্ত চলে এ কর্মসূচি। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় শুধু শারীরিক নয়, মানসিক হয়রানির বিরুদ্ধেও গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। কর্মক্ষেত্রের বিষাক্ত পরিবেশ এবং লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে সংগ্রামে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ। এখন সময় এসেছে পরিবর্তনের। নারীর পেশাগত স্বপ্ন পূরণের পথে এই অবমাননাগুলো মেনে নিতে বাধ্য করা উচিত নয়। এ ধরনের মানসিক নিপীড়নকে স্বীকৃতি দিয়ে তা নির্মূল করার জন্য দরকার সম্মিলিত উদ্যোগ। তবেই একটি ন্যায়সংগত ও নারীবান্ধব কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করা সম্ভব। 

লেখক: সিনিয়র অ্যাডভোকেসি অফিসার, নারী মৈত্রী
 

আরও পড়ুন

×