ঢাকা রবিবার, ০৬ জুলাই ২০২৫

সালতামামি

অদম্য মেয়েদের সাফ জয়

অদম্য মেয়েদের সাফ জয়

ছাদখোলা বাসে নারী ফুটবল দল

সমকাল ডেস্ক

প্রকাশ: ২৮ ডিসেম্বর ২০২৪ | ২৩:০০ | আপডেট: ২৯ ডিসেম্বর ২০২৪ | ১৩:০৫

সাফজয়ী নারী দল টানা দ্বিতীয়বারের মতো শিরোপা ধরে রেখেছে। গত ৩০ অক্টোবর নেপালের দশরথ স্টেডিয়ামে আরেকবার ইতিহাস গড়লেন বাংলাদেশের মেয়েরা। স্বাগতিক নেপালকে আরেকবার বাকরুদ্ধ করে ২-১ ব্যবধানে জয় পেয়েছে বাংলাদেশ। সর্বশেষ ২০২২ সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে নেপালকে হারিয়েই প্রথমবার চ্যাম্পিয়ন হয় বাংলাদেশ। মনিকা চাকমা ও ঋতুপর্ণা চাকমার দুই গোলে বাংলাদেশ দ্বিতীয়বার চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। এ অর্জন অনেকটা কল্পরাজ্য জয়ের মতোই। এর পেছনে রয়েছে নানা গল্পগাথা, প্রত্যেকের জীবনই সংগ্রামী গল্পে ঠাসা। 

যখন নারীকে তাঁর পোশাক নিয়ে প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়, তখন হাফপ্যান্ট ও টি-শার্টের লাল-সবুজ জার্সি পরা মেয়েরা পুরো দেশে আনন্দের জোয়ার বইয়ে দিলেন। এটি শুধু একটা টুর্নামেন্ট জেতা নয়; বরং দেশের নারী ফুটবলে এক নতুন জোয়ার, যে জোয়ারের অংশীদার দেশের আপামর জনসাধারণ।

হাজারো প্রতিবন্ধকতা ডিঙিয়ে এ বন্ধুর পথে নেতৃত্ব দিয়েছেন সাবিনা আক্তার। বাংলাদেশ নারী ফুটবল দলের অধিনায়ক। সাহসের প্রতিধ্বনি। বাহ্যিক অবয়ব, হাঁটাচলা এবং কথা বলায় রয়েছে ভিন্ন অভিব্যক্তি। নেতৃত্বের সব গুণ যাঁর মাঝে বিরাজমান। নেতার কাজ হলো দলকে আগলে রাখা। প্রত্যেক সদস্যকে উদ্যমী করে তোলা, যেটি সাবিনা করে যাচ্ছেন বেশ কয়েক বছর ধরে। তিনি বলেন, ‘গুছিয়ে কথা বলতে পারি না। তবে আপনাদের ভালোবাসার শক্তিকে মূল্যায়ন করতে চাই। আপনাদের এই অকৃত্রিম ভালোবাসা নিয়েই বহু পথ হাঁটতে চাই। যে পথ পেরিয়ে এসেছি, তা সহজ ছিল না। বাধামুক্ত পৃথিবী গড়ার হাতিয়ার হতে পারে ফুটবল। এটি নারীকে অগ্রসর করে তোলার একটি ধাপ।’

কৃষ্ণা রানী সরকার। বেড়ে উঠেছেন টাঙ্গাইলের গোপালপুর উপজেলার উত্তর পাথালিয়া গ্রামে। বাড়ির আশপাশ প্রাণ-প্রকৃতিতে ভরপুর। তাঁর হাসির ভেতর লুকিয়ে আছে গ্রামের সারল্য। বাবা একসময় দর্জির কাজ করতেন। কৃষ্ণা ও পলাশ দুই ভাইবোন। বাবার স্বল্প আয়ে বহু কষ্টে চলত সংসার। ধুলামাটির সঙ্গে বেড়ে ওঠা। টিনের ঘর। মাটির বারান্দা, যেখানে মাদুর বিছিয়ে পেতেন মায়ের ভালোবাসা। 

কৃষ্ণা বলেন, ‘আমার আগ্রহ দেখে কাকা একদিন ৩ নম্বর ডিআর বল কিনে দেন। মানুষের কটুকথা সহ্য করতে না পেরে মা একদিন বঁটি দিয়ে ফুটবল কেটে ফেলেছিলেন। তবু খেলা ছাড়িনি।’ তখন তিনি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়তেন। ক্লাস ফোর-ফাইভের কথা। তাদের স্কুলে আরও বেশ কয়েকজন মেয়ে ফুটবল খেলা শুরু করেছিলেন। কিন্তু তারা থেমে যান সামাজিক প্রতিবন্ধকতায়। ক্রীড়া শিক্ষক গোলাম রায়হান বাপনের একান্ত সহযোগিতায় কৃষ্ণার খেলোয়াড়ি জীবন শুরু হয়।

ময়মনসিংহের ধোবাউড়ার কলসিন্দুর মানেই এক সংগ্রামের নাম। মিডফিল্ডার সানজিদা আক্তার এই গ্রামেরই মেয়ে। মিডিয়ায় রয়েছে তাঁকে নিয়ে বেশ হৈ-হুল্লোড়। তাঁর কথায় রয়েছে কলসিন্দুরের টান। তা পাল্টাতেও তেমন আগ্রহী নন সানজিদা। মুখে মধুর হাসি। পায়ে যেন সব অশুভকে তাড়ানোর জোর। সানজিদা বলেন, ‘আমার বেড়ে ওঠা কলসিন্দুরে। সেখানেই পড়াশোনা করেছি। ফুটবল খেলা জানতাম না। মেয়েরা ফুটবল খেলে, সেটিও জানতাম না। প্রথমে আমরা হাত দিয়ে বল খেলেছি। পা দিয়ে বল খেলতে জানতাম না। প্রথমে তো আগ্রহই ছিল না। লজ্জা পেতাম। স্যার জোর করে মাঠে নামিয়েছেন। এরপর এমন অবস্থা হলো যে ফুটবল না খেললে ভালো লাগত না। এক ধরনের নেশার মতো হয়ে গিয়েছিল। বাড়ি থেকে বকাঝকা শুরু হয়; কিন্তু কারও কথা না শুনে স্কুল ছুটির পর চুরি করে খেলতাম। পাড়া-পড়শীর কটুকথা শুনতে হয়েছে। তবে এখন সমাজে সমর্থন বেড়েছে।’

সম্প্রতি বাংলাদেশে গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ছাত্র-জনতার বিজয় হয়েছে। নতুনভাবে চিন্তা করার প্রেরণা পাচ্ছে সর্বস্তরের মানুষ। এ সময় নারী দলের সাফ জয়ের ইতিহাস আরও সাহস জোগায়; জয়ের প্রেরণা তৈরি করে। তবে এ অর্জনের মাঝেও কিছু কষ্টের স্মৃতি রয়েছে, যার কথা ভুলে যাননি সাবিনা-কৃষ্ণারা। প্রথমবার সাফজয়ী নারী দলের অন্যতম সদস্য ছিলেন রাজিয়া সুলতানা। বাবা মারা গেছেন যক্ষ্মায় ভুগে, মায়ের দিন কাটে গোবরে ঘুঁটে বানিয়ে। মেয়ের স্বপ্ন আকাশছোঁয়া, তবুও অভাব যেন নিত্যসঙ্গী। বিয়ের কথা গোপন করে পেটে সন্তান নিয়ে ফুটবল খেলেছেন। ১৩ মার্চ রাতে সন্তান জন্ম দিয়ে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মারা যান রাজিয়া। এই করুণ ঘটনা আমাদের সমাজ বাস্তবতাকেই নির্দেশ করে।

আরও পড়ুন

×