কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার বাড়ছে আর্থিক খাতে

.
সমকাল প্রতিবেদক
প্রকাশ: ২২ নভেম্বর ২০২৪ | ২৩:৫১
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) বৈশ্বিক আর্থিক খাতে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলেছে। বাংলাদেশ ধীরে ধীরে এ প্রযুক্তি গ্রহণ করছে এবং আর্থিক খাতে এর ব্যবহার বাড়ছে। প্রক্রিয়া স্বয়ংক্রিয়করণ থেকে শুরু করে গ্রাহকসেবার মান আরও উন্নত করতে দেশের কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ইতোমধ্যে অপারেশনাল দক্ষতার জন্য এআই ব্যবহার শুরু করেছে। তবে বাংলাদেশে আর্থিক অন্তর্ভুক্তি, ঋণ ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা এবং প্রতারণা শনাক্ত করার মতো ক্ষেত্রে আরও বেশি এআই গ্রহণ ও কার্যকর করা প্রয়োজন, যাতে এ প্রযুক্তির পূর্ণ সুবিধা নেওয়া যায়।
ব্যবস্থাপনা পরামর্শক প্রতিষ্ঠান লাইটক্যাসল পার্টনার্সের অ্যানালিটিকস উইং সম্প্রতি বাংলাদেশের আর্থিক খাতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার এবং এর সম্ভাবনা নিয়ে একটি বিশ্লেষণমূলক নিবন্ধ প্রকাশ করেছে। লাইটক্যাসল পার্টনার্সের ডিজিটাল প্রডাক্ট ম্যানেজার ও বিজনেস কনসালট্যান্ট রাফসান জিয়ার লেখা নিবন্ধে এর নানা দিক উঠে এসেছে।
লাইটক্যাসল পার্টনার্সের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশের আর্থিক খাতে ব্র্যাক ব্যাংক ও সিটি ব্যাংকের মতো আর্থিক প্রতিষ্ঠান গ্রাহকসেবার মান উন্নত করতে এআইচালিত চ্যাটবট বা ভার্চুয়াল অ্যাসিস্ট্যান্ট ব্যবহার করছে। দ্রুত গ্রাহক প্রশ্নের উত্তর প্রদান এবং কল সেন্টারের চাপ কমানোর জন্য এ প্রযুক্তি ব্যবহৃত হচ্ছে। চ্যাটবটগুলো ব্যালান্স অনুসন্ধান, লেনদেনের বিজ্ঞপ্তি, ঋণ আবেদনসহ প্রাথমিক কাজগুলো পরিচালনা করে। বৈশ্বিক গবেষণায় দেখা গেছে, প্রায় ৬০ শতাংশ গ্রাহক নিয়মিত সহায়তার জন্য চ্যাটবটকে মানব এজেন্টের অপেক্ষার চেয়ে বেশি পছন্দ করেন, যা এআই ইন্টিগ্রেশনের প্রয়োজনীয়তাকে আরও জোরালো করে তোলে।
শুধু আর্থিক খাত নয়, বাংলাদেশের বিভিন্ন খাতে এআইর ব্যবহার বাড়ছে। জার্মানভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ডয়চে ভেলের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, টেলিযোগাযোগ মার্কেটিং এমনকি কৃষি খাতেও এর ব্যবহার শুরু হয়েছে। বাংলাদেশে পাঁচ শতাধিক প্রতিষ্ঠান এআই ও মেশিন লার্নিং নিয়ে কাজ করে। তবে প্রতিষ্ঠানের বাইরে ব্যক্তিগতভাবে কাজ করেন এ রকম মানুষের সংখ্যা কমপক্ষে ১০ লাখ। বাংলাদেশে ২০০৮ সাল থেকে এআই নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে কাজ শুরু হয়। বাংলাদেশের সব খাতেই এআইর সম্ভাবনা আছে। বিশেষ করে প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষেত্রে এআইর ব্যবহার অনেক ক্ষতি থেকে বাঁচিয়ে দিতে পারে।
প্রতারণা শনাক্ত করা এবং ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা
বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে আর্থিক প্রতারণা একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্বেগের বিষয়। সন্দেহজনক লেনদেন তাৎক্ষণিকভাবে শনাক্ত করার জন্য এআই অ্যালগরিদম ব্যবহার করা হচ্ছে। মেশিন লার্নিং (এমএল) মডেলগুলো গ্রাহকদের লেনদেনের ধরন বিশ্লেষণ করে অস্বাভাবিকতা চিহ্নিত করতে পারে, যা সম্ভাব্য প্রতারণার বিরুদ্ধে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে সহায়ক।
ঋণ স্কোরিং এবং ঋণ বিতরণ
প্রচলিত ঋণ স্কোরিং মডেলগুলোর অতিরিক্ত ক্রেডিট ইতিহাস এবং আনুষ্ঠানিক ডকুমেন্টেশনের ওপর নির্ভরতা অনেক ব্যক্তিকে ঋণ সুবিধার বাইরে রেখে দেয়। এআইভিত্তিক ঋণ স্কোরিং সিস্টেম বিকাশ এবং শপআপের মতো ফিনটেক কোম্পানি ব্যবহার করছে। বিকল্প উপাত্ত যেমন ফোন ব্যবহার, লেনদেনের আচরণ এবং সামাজিক মাধ্যম কার্যক্রম বিশ্লেষণ করে অনগ্রসর জনগোষ্ঠীকে ক্ষুদ্রঋণ দিতে সহায়তা করে, আর্থিক অন্তর্ভুক্তি বাড়ায়। উদাহরণস্বরূপ, এমএফএস প্রতিষ্ঠান বিকাশ জানিয়েছে, ‘নিমন্তন’ ও ‘বিপণন’ নামে ইন্টেলিজেন্ট মেশিনসের দুটি এআই পণ্যের সহায়তায় তাদের উৎপাদনশীলতা ৭৬ শতাংশ বেড়েছে এবং মাসিক অনবোর্ডিং হার ১৫ শতাংশ বেড়েছে।
অ্যালগরিদমিক ট্রেডিং এবং পোর্টফোলিও ব্যবস্থাপনা
লাইটক্যাসল পার্টনার্সের নিবন্ধে বলা হয়, অ্যালগরিদমিক এবং পোর্টফোলিও ব্যবস্থাপনা এখনও প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। কিছু আর্থিক প্রতিষ্ঠান অ্যালগরিদমিক ট্রেডিং সিস্টেম ব্যবহার করে শেয়ারবাজারের প্রবণতা পূর্বাভাস এবং বিনিয়োগ পোর্টফোলিও পরিচালনার জন্য এআই প্রয়োগ করছে। সিস্টেমগুলো মানবিক ত্রুটি কমিয়ে ধারাবাহিক ডেটা বিশ্লেষণ ও শেখার মাধ্যমে আয় সর্বাধিক করতে সাহায্য করে। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) আধুনিক প্রযুক্তি গ্রহণের পথে এগোচ্ছে, যার মধ্যে নাসডাকের এক্স-স্ট্রিম আইএনইটি দ্বারা সমর্থিত ট্রেডিং প্ল্যাটফর্ম অন্তর্ভুক্ত। যদিও অ্যালগরিদমিক ট্রেডিং এখনও বিকাশমান, স্বয়ংক্রিয় সিস্টেমের জন্য অবকাঠামো আধুনিকীকরণের প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।
এআই গ্রহণের সম্ভাবনা
প্রতিবেদনে বলা হয়, এআই ব্যবহার করে গ্রামীণ অঞ্চলের ব্যাংকিং সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর জন্য আর্থিক সেবা প্রদান করা যেতে পারে। মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস (এমএফএস) থেকে সংগৃহীত ‘বিগ ডেটা’ কাজে লাগিয়ে উন্নত ক্রেডিট স্কোরিং টুলগুলো কৃষক এবং ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের ঋণ দিতে সহায়তা করতে পারে, যাদের আনুষ্ঠানিক ক্রেডিট ইতিহাস নেই। গ্রাহকের ব্যক্তিগত উপাত্ত ব্যবহার করে এআই ব্যাংকগুলোকে হাইপার-পারসোনালাইজড আর্থিক পণ্য, যেমন আয়ের প্যাটার্ন এবং ব্যয়ের আচরণের ওপর ভিত্তি করে সঞ্চয় পরিকল্পনা বা বিনিয়োগ কৌশল তৈরি করতে সাহায্য করতে পারে। এআই বায়োমেট্রিক অথেনটিকেশন এবং লেনদেনের উপাত্ত বিশ্লেষণ একত্র করে প্রতারণা প্রতিরোধ ব্যবস্থা আরও শক্তিশালী করতে পারে। পূর্বাভাসমূলক বিশ্লেষণ প্রতারণামূলক পরিকল্পনা আগেই শনাক্ত করে সক্রিয় সমাধান দিতে পারে, যা আর্থিক অপরাধের ঝুঁকি কমাবে। এআই টুলগুলো কেওয়াইসি (আপনার গ্রাহককে জানুন) এবং মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ প্রক্রিয়া স্বয়ংক্রিয় করতে পারে, যা মসৃণ অপারেশন নিশ্চিত করার পাশাপাশি সম্মতির খরচ কমাতে সাহায্য করবে। এ ছাড়া সাইবার দুর্বলতা চিহ্নিত করা এবং সাইবার আক্রমণ প্রতিরোধের মাধ্যমে এআই সাইবার নিরাপত্তা জোরদার করতে পারে।
সম্পূর্ণভাবে গ্রহণের চ্যালেঞ্জ
লাইটক্যাসল পার্টনার্সের প্রতিবেদনে সুপারিশ করা হয়েছে, এআই ব্যবহার বৃদ্ধি সত্ত্বেও গ্রাহকের তথ্য সুরক্ষিতভাবে পরিচালনা করার জন্য শক্তিশালী উপাত্ত সুরক্ষা কাঠামোর প্রয়োজন রয়েছে। খসড়া উপাত্ত সুরক্ষা বিল ২০২৩ কিছু উদ্বেগ সমাধান করলেও এটি বৈশ্বিক মানদণ্ড পূরণের জন্য আরও পরিমার্জনের প্রয়োজন। ব্যক্তিগত উপাত্ত ব্যবস্থাপনা এবং আন্তঃদেশীয় উপাত্ত প্রবাহের ক্ষেত্রে বিলটি সর্বোত্তম চর্চা নিশ্চিত করছে না বলে শঙ্কা রয়েছে। ডয়চে ভেলের রিপোর্টে বলা হয়, বাংলাদেশ সরকার এরই মধ্যে এআই নিয়ে একটি আইন করার উদ্যোগ নিয়েছে। বিশ্লেষকরা মনে করেন, আইন অবশ্যই এর অপব্যবহার রোধে প্রয়োজন। একই সঙ্গে এআইর জন্য অবকাঠামো, দক্ষ মানবসম্পদ এবং প্রযুক্তিগত সহায়তা অনেক বেশি প্রয়োজন।
আর্থিক খাতে এআই দক্ষতার ঘাটতি উল্লেখযোগ্য। ব্যাংকগুলোকে কর্মীদের প্রশিক্ষণে বিনিয়োগ করতে হবে বা প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে অংশীদারিত্বে এআই সক্ষমতা তৈরি করতে হবে। এআই সমাধান বাস্তবায়নের প্রাথমিক খরচ অনেক বেশি। বিশেষত ছোট ব্যাংকগুলো এআই প্রযুক্তিতে বিনিয়োগের জন্য প্রণোদনা বা অংশীদারিত্বের প্রয়োজন অনুভব করে।
ভবিষ্যতের জন্য ব্যবহার
এআই বাংলাদেশে আর্থিক খাতে উন্নত দক্ষতা, গ্রাহক অভিজ্ঞতা এবং আর্থিক অন্তর্ভুক্তি বৃদ্ধির মাধ্যমে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলতে পারে। তবে এসব সুবিধা পুরোপুরি কাজে লাগাতে হলে উপাত্তের গোপনীয়তা, কর্মশক্তির প্রস্তুতি এবং খরচ-সংক্রান্ত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। সরকারি সহায়তা, বেসরকারি খাতের উদ্ভাবন এবং নিয়ন্ত্রক নজরদারির সমন্বিত প্রচেষ্টা দায়িত্বশীল এআই গ্রহণের জন্য অপরিহার্য। যেহেতু আর্থিক খাত দ্রুত পরিবর্তনশীল, সে ক্ষেত্রে যারা শুরুতেই কৌশলগতভাবে এআই গ্রহণ করবে, তারা শিল্পের নেতৃত্ব দিতে এবং বাংলাদেশের সার্বিক প্রবৃদ্ধি ও অন্তর্ভুক্তি বাড়াতে সক্ষম হবে।
- বিষয় :
- কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা