আয়ের পথ খুলে সগৌরবে ফিরছে মণিপুরি তাঁত

কোলাজ
জসিম উদ্দিন বাদল
প্রকাশ: ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ | ০১:১১ | আপডেট: ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ | ১০:৫২
সরকারি-বেসরকারি নানা উদ্যোগে এগোচ্ছে দেশের ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাত। তৈরি হচ্ছে নতুন উদ্যোক্তা ও কর্মসংস্থান। কিশোরগঞ্জের ভৈরব, মৌলভীবাজারের বড়লেখা ও শ্রীমঙ্গল ঘুরে পাদুকা, আগর ও মণিপুরি তাঁতশিল্প নিয়ে সমকালের স্টাফ রিপোর্টার জসিম উদ্দিন বাদল তৈরি করেছেন তিন পর্বের ধারাবাহিক প্রতিবেদন। তৃতীয় পর্বে আজ থাকছে মণিপুরি তাঁতশিল্পের অগ্রযাত্রা, সম্ভাবনা ও সমস্যা নিয়ে বিস্তারিত।
সকাল থেকে বিকেল পুরো এক দিন লেগে যায় একটি চাদর বুনতে। মজুরি মেলে ১৫০ টাকার মতো। তাতেও খুশি। লেখাপড়া করে অলস বসে থাকার চেয়ে অল্প হলেও আয় করা সম্মানের। এই টাকা দিয়ে কিছুটা সহায়তা করা যায় টানাপোড়েনে থাকা নিজের পরিবারকেও। অর্থ উপার্জনের এই গল্প মল্লিকা দেববর্মার। তিনি মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলের পাহাড়ি অঞ্চল ডলুছড়া গ্রামের তরুণী। এইচএসসি পাসের পর শিক্ষাজীবনের ইতি টেনে তাঁত বস্ত্র উৎপাদনের কাজ করছেন ‘সবুজ ছায়া মণিপুরি তাঁত হস্তশিল্প’ নামে একটি প্রতিষ্ঠানে।
মল্লিকা দেববর্মা সমকালকে বলেন, তারা ছয় বোন, এক ভাই। তিনি সবার ছোট। পরিবারের সদস্য বেশি থাকায় অর্থ সংকটে তাঁর পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। নিজ গ্রামে কারখানা তৈরি হওয়ায় খুঁজে পেয়েছেন আয়ের উৎস।
কারখানায় কর্মব্যস্ত দেখা গেছে নম্রতা দেববর্মা নামের আরেকজনকে। সেখানে সে সবচেয়ে কম বয়সী শ্রমিক। মা বিনতা দেববর্মার ঠিক পেছনের তাঁতযন্ত্রে কাজ করছে নম্রতা। সে স্থানীয় দ্য বার্ডস রেসিডেনসিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের উচ্চ মাধ্যমিকে প্রথম বর্ষের ছাত্রী। নম্রতা সমকালকে জানায়, দৈনিক যে টাকা আয় করে, তা দিয়ে পড়ালেখার পাশাপাশি সংসারেরও কিছু খরচ চালাতে পারে।
শ্রীমঙ্গল সদর থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বদিকে ডলুছড়া গ্রাম। দু’পাশে ঘন সবুজ চা বাগানের সারি সারি টিলা আর আঁকাবাঁকা পথ পাড়ি দিয়ে গেলে পাহাড়ের ঢালে দেখা মিলবে সবুজ ছায়া মণিপুরি তাঁত হস্তশিল্পের কারখানাটির। সম্প্রতি সরেজমিন দেখা যায়, মল্লিকা ও নম্রতার মতো ছোট কারখানাটিতে কাজ করছেন ১০ থেকে ১২ নারী তাঁতি। তৈরি করছেন চাদর, গামছা, শাড়ি, ওড়না, থ্রিপিসসহ নানা তাঁতবস্ত্র। তারা সবাই ডলুছড়া গ্রামের বাসিন্দা। স্থানীয় ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর সদস্য। কারখানাটিতে হস্তচালিত তাঁতযন্ত্রে কেউ বুনছেন চাদর বা গামছা। আবার কেউ বুনছেন শাড়ি বা ওড়না। বুননের এই কর্মযজ্ঞের খট খট আওয়াজে যেন মুখরিত হয়ে উঠছে গাছগাছালিঘেরা গহিন বনের ভেতরের টিনশেডের ঘরটি। এভাবেই উৎপাদন কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে সগৌরবে ফিরছে শত বছরের পুরোনো বিলুপ্তপ্রায় মণিপুরি তাঁত হস্তশিল্প। এই তাঁতশিল্পের হাত ধরেই নতুন জীবিকার সন্ধান পেয়েছে স্থানীয় ত্রিপুরা জাতিগোষ্ঠী।
ক্ষুদ্র এই জনগোষ্ঠীর এমন কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছেন রবিউল ইসলাম রাসেল নামে এক ছোট উদ্যোক্তা। এসএমই ফাউন্ডেশনের সহায়তায় বছর দুয়েক আগে তিনি ওই কারখানা স্থাপনের উদ্যোগ নেন। তিনি জানান, অনলাইনে এসএমই ফাউন্ডেশনের প্রশিক্ষণের বিজ্ঞপ্তি দেখে ঢাকায় গিয়ে প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে যোগাযোগ করেন শিল্পকে পুনরুজ্জীবিত করার বিষয়ে। এরপর এসএমই ফাউন্ডেশনের কর্মকর্তারা ঢাকা থেকে এসে পাঁচ দিনের উদ্যোক্তা তৈরি হওয়ার প্রশিক্ষণ দেন। পরে আরও এক মাস প্রশিক্ষণ দেন তাঁত শ্রমিকদের। এভাবে এসএমই ফাউন্ডেশনের সহায়তায় সেখানে গড়ে ওঠে তাঁতশিল্প ক্লাস্টার।
রাসেল জানান, আধা পাকা ঘরটি দুই লাখ টাকায় লিজ নেন পাঁচ বছরের জন্য। সেখানে প্রতিটি ৪০ হাজার টাকা ব্যয়ে মোট সাতটি তাঁতযন্ত্র বসান। সংগ্রহ করেন আনুষঙ্গিক অন্যান্য কাঁচামাল। সব মিলিয়ে ৭ লাখ টাকার মূলধন বিনিয়োগ করে কারখানা স্থাপন করেন। বর্তমানে তাঁর কারখানায় উৎপাদিত তাঁতবস্ত্র সরবরাহ করা হয় ইউনিমার্ট, কেক্রাফট ও স্থানীয় ব্র্যান্ড এমডি বিলাসসহ বিভিন্ন শোরুমে। এখান থেকে পণ্য নিয়ে অনেকেই বিক্রি করেন অনলাইনে। আসেন বিদেশি ক্রেতাও।
এ কারখানা থেকে বস্ত্র কিনে তা অনলাইনে বিক্রি করেন মো. নোমান নামে এক বিক্রেতা। তিনি সেখানে একটি ব্যাংকে কর্মরত। সমকালকে নোমান বলেন, ফেসবুকের মাধ্যমে তিনি তাঁতবস্ত্র বিক্রি করেন। একটি শাড়ি বিক্রিতে মুনাফা থাকে ২০০ থেকে ৩০০ টাকা।
শ্রীমঙ্গল উপজেলার ওয়েবসাইটের তথ্যমতে, ডলুছড়া গ্রামের মোট জনসংখ্যা প্রায় ১ হাজার ২০০। সেখানে ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর ৯৫টি পরিবারের বসবাস। মণিপুরি এই পল্লির প্রায় প্রতি বাড়িতে রয়েছে কোমর তাঁত। বংশপরম্পরায় পরিবারের নারীরা মণিপুরি তাঁতশিল্পের সঙ্গে জড়িত। বাংলা জানলেও তাদের দৈনন্দিন কথাবার্তা চলে ‘কক বরক’ মাতৃভাষায়।
স্থানীয়রা জানান, সনাতন পদ্ধতিতে সুতার এক প্রান্তের বিম খানিকটা উঁচু কিছুর সঙ্গে বেঁধে অন্য প্রান্তকে কোমরে বেল্টসদৃশ রশি বা দড়ি জাতীয় বস্তু দিয়ে পেঁচিয়ে টান টান করে তাঁতবস্ত্র বোনা হয়। যাকে বলা হয়, কোমর তাঁত। এ পদ্ধতি এখনও চলমান। তবে এভাবে বস্ত্র তৈরি বেশ কষ্টকর ও সময়সাপেক্ষ। উৎপাদনও হয় কম। খরচ তুলনামূলক বেশি। সেই তুলনায় উপযুক্ত দাম পাওয়া যায় না। ফলে কায়িক শ্রমভিত্তিক তাঁতবস্ত্রের বাজার সংকুচিত হয়ে আসে। এসব সীমাবদ্ধতার পরও মণিপুরি এবং ত্রিপুরা সম্প্রদায় ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। যদিও উৎপাদন ব্যয় আর বাজার সম্প্রসারণের অভাবে আগ্রহ কমেছে বড় একটা গোষ্ঠীর। সময়ের আবর্তনে পরিবর্তন এসেছে উৎপাদন ব্যবস্থায়। এখন কোমর তাঁতের পরিবর্তে অনেকটা সহজে তাঁতযন্ত্রের মাধ্যমে কাজ করা যায়। এতে উৎপাদন বেড়েছে দ্বিগুণ। নকশায়ও এসেছে বৈচিত্র্য। দামও বেড়েছে কিছুটা। তারা চান ঐতিহ্যবাহী এ শিল্প টিকে থাকুক। নিজ সম্প্রদায়ের লোকেরা এই পেশায় আসুক। যদিও পরিশ্রম অনুযায়ী তাদের মজুরি নিতান্তই কম। ন্যায্য মজুরি পেলে এ শিল্প টিকিয়ে রাখতে পারবেন তাঁতিরা।
কারখানাটির তাঁতি অম্বালিকা দেববর্মা বলেন, এটা পারিবারিক কর্ম। মজুরি একটু কম। তার পরও করতে হয়। পরিবারের অন্য সদস্যরাও এ পেশায় নিযুক্ত থাকুক এমনটা এ সম্প্রদায়ের সবাই চান।
ডলুছড়া গ্রামের বাসিন্দারা জানান, কয়েকশ বছরের পুরোনো এবং ঐতিহ্যবাহী মণিপুরি তাঁতশিল্প পুঁজি আর উপযুক্ত প্রশিক্ষণের অভাবে প্রায় বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে ছিল। রাসেলদের মতো উদ্যোক্তার হাত ধরে এটি আবারও উজ্জীবিত হচ্ছে। এর বদৌলতে উন্নত হচ্ছে তাদের জীবনযাত্রা।
শিল্পের অগ্রযাত্রায় কিছুটা প্রতিবন্ধকতার শিকার হচ্ছেন উদ্যোক্তারা। তারা জানান, বস্ত্র উৎপাদনের মূল কাঁচামাল সুতা। প্রতিটি চাদর তৈরি করতে লাগে ৩৫০ গ্রাম সুতা। ভারত থেকে আসা এ সুতা কিনতে হয় শহরের বড় সওদাগরদের কাছ থেকে। তাতে দাম বেশি পড়ে যায়। প্রতি কেজিতে গুনতে হয় ৫৫০ টাকা। দেশে সুতা উৎপাদন হলে কম দামে পাওয়া যেত। বস্ত্র উৎপাদনে খরচও কমত। তাছাড়া সহজে ঋণ পেলে কারখানার সংখ্যা বাড়বে। এতে একদিকে নতুন উদ্যোক্তা তৈরি হবে, অন্যদিকে স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে রপ্তানিও করা যাবে। বাড়বে কর্মসংস্থানের পরিধিও। এ ছাড়া পণ্যের প্রচার ও প্রসারে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়ার দাবি জানান তারা।
সবুজ ছায়া মণিপুরি তাঁত হস্তশিল্পের স্বত্বাধিকারী রবিউল ইসলাম রাসেল বলেন, সব খরচ বাদ দিয়ে তিনি বছরে আয় করেন ৪ থেকে ৫ লাখ টাকা। এখন রপ্তানির প্রস্তুতি নিচ্ছেন। গত বছরে এসএমই ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে নেপালে এসএমই মেলায় অংশ নেন। সেখানে কয়েকজন ক্রেতার সঙ্গে পরিচয় ঘটে। গেল বছর তাদের কাছে ৬ থেকে ৭ লাখ টাকার তাঁতপণ্য রপ্তানি করেন। অন্য ব্যবসার পাশাপাশি তিনি এখন বড় উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন। রাসেল বলেন, অনেক শ্রমিক কাজ করতে চান। অর্থ সংকটে কারখানা সম্প্রসারণ করা যাচ্ছে না। কারখানা বড় করা গেলে আরও বেশি কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হবে। সেজন্য সহজ শর্তে ও কম সুদে ঋণ দরকার।
ডলুছড়া গ্রামে কথা হয় রাসেলের মতো আরেক উদ্যোক্তা সালেহা বেগম বৃষ্টির সঙ্গে। তিনি শ্রীমঙ্গলের উত্তরসুর গ্রামের বাসিন্দা। ব্যাংকের চাকরি ছেড়ে তিনি ২০১৬ সালে এ শিল্পে যুক্ত হন। সালেহা বেগম জানান, তাঁর কারখানায় পাটজাত পণ্য তৈরি হয়। সেখানে কাজ করেন ২০ থেকে ২৫ শ্রমিক, যাদের সবাই নারী। মুনাফা কম হলেও অনেকের কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে। প্রশিক্ষণ ও আর্থিক সহায়তা পেলে কারখানা বড় করা সম্ভব।
ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের উদ্যোক্তাদের নিয়ে বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করছে এসএমই ফাউন্ডেশন। সংস্থাটির চেয়ারপারসন মো. মুশফিকুর রহমান বলেন, দেশে সুতা উৎপাদন বিষয়ে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব থাকলে সে বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করা হবে। বাজার সম্প্রসারণে বিভিন্ন দেশের আন্তর্জাতিক মেলায় উদ্যোক্তাদের পাঠানো হচ্ছে। এতে রপ্তানির পথ খুলছে। প্রশিক্ষণ ও ঋণসহায়তা দেওয়া হচ্ছে। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আনোয়ার হোসেন চৌধুরী বলেন, ২৩টি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে চলতি অর্থবছরে ৪৫০ কোটি টাকা ঋণ দেওয়া হবে। তাঁতশিল্পের সঙ্গে জড়িতরাও ঋণ পাবেন
- বিষয় :
- তাঁতীবাজার
- মণিপুর