ঢাকা রবিবার, ০৬ জুলাই ২০২৫

অতিরঞ্জন আর বাগাড়ম্বরের মধ্যে পড়ে থাকা এক দার্শনিক আউটলেট

অতিরঞ্জন আর বাগাড়ম্বরের মধ্যে পড়ে থাকা এক দার্শনিক আউটলেট

মানস চৌধুরী

প্রকাশ: ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২২ | ১২:০০ | আপডেট: ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২২ | ২৩:৫৩

এক।। শৃঙ্খলাবিধির সেই কারিগর
আমার জীবনে দ্বিতীয় আনুষ্ঠানিক পিটাইখানা জোটে, যখন আমি সপ্তম শ্রেণির ছাত্র। দ্বিতীয়; কারণ প্রথমটা তাহলে ঘটেছিল এরও বছরখানেক আগে। তবে প্রথমটার কথা মনে না করাই ভালো। আমি অন্তত করতে চাই না। শিক্ষকদের কমনরুম থেকে সহকর্মীদের সঙ্গে মাথা-গরম করে হনহন কিংবা গনগন, এমনকি ঘোঁৎ ঘোঁৎ করে আসতে থাকা কিছু শিক্ষক সামনে পড়ে যাওয়া যে কোনো ছাত্রছাত্রীকে আচ্ছামতো পিটিয়ে নেদিয়ে বা হিসিয়ে দিতে সক্ষমতা রাখেন। এ রকম বীর শিক্ষকের কথা সব অঞ্চলেই শোনা যায়। আমি সামনে পড়ে গেছিলাম, কারণ কোনো এককালে হাবাগোবা ফার্স্টবয়কেই ক্লাসের 'মনিটর' বানিয়ে দিয়েছিলেন অন্য কিছু শিক্ষক। আমি সেই 'নেতা'র চাকরিতে খাতা পাহারা দিচ্ছিলাম। ফলে 'তুই এখানে কী করিস' বলে বেদম পিটিয়ে দিতে তাঁর কোনো যুক্তিশীলতার বাধা ছিল না। এত কিছুর পরও এটা মনে করা যেতে পারত। কিন্তু তিনি তাঁর বীরত্বের বাণীতেই কেবল বসবাস করে থাকেন নাই; আমিও তাঁর সঙ্গে মানানসইভাবে হিসি করে ফেলেছিলাম। ফলে ওই প্রসঙ্গটা বিস্মৃত হওয়া আমার শৈশবের জন্য গৌরবময় থাকবে।

আনুষ্ঠানিকের হিসাবটাও আলাপযোগ্য। আমার পিতামাতা কখনও দাবি করেন নাই যে, তাঁরা আমাকে গুরুতর বা এমনকি মৃদুমন্দ পিটাই করেছেন এ জীবনে। আমারও স্মৃতিতে এ রকম কিছু ধরা পড়ে না। স্মৃতিনিরপেক্ষ বানিয়ে বানিয়ে যে কোনো একটা পিটাই কাহিনি বলব, তারও যথেষ্ট কারণ আমি খুঁজে পাইনি এত বছরে। ফলে সত্যনিষ্ঠার নীতিশাস্ত্রীয় বিচারে আমার ধরে নেওয়া উচিত হবে- মা-বাবা ও আমি এই উভয় পক্ষের স্মৃতিতে ফ্যাকাসে হয়ে যাওয়া কোনো না কোনো পিটাই পর্ব আমার জীবনে ঘটে থাকতে পারে। তবে আনুষ্ঠানিক পিটাইয়ের স্মৃতি অমলিন আছে বলেই আমি মনে করতে পারি। এর মধ্যে প্রথমটা আকস্মিক ও অগৌরবময় বিধায় আমি না-উল্লেখ করতে চাইলেও দ্বিতীয়টি সুপরিকল্পিত এবং গৌরবের এক স্মারক পেটাই। কারণ, সপ্তম শ্রেণির ওই বেত্রাঘাত ছিল আমার 'মুক্তচিন্তা প্রকাশ'-এর সুস্পষ্ট নিগ্রহ। আমাকে হেডমাস্টার স্যার কেবল দাওয়াত দিয়েই উপরে তাঁর অফিসকক্ষে নেননি; উপরন্তু তিনি পর্যবেক্ষক হিসেবে দাওয়াত দিয়েছিলেন তাঁর সহকর্মী বাংলার শিক্ষক আমার বাবাকে। বঙ্গাল মুল্লুক কিশোর-প্রতিভা আর বালকবীরের অঞ্চল! ঠিকমতো নথিভুক্তি থাকলে আমার ওই নিগ্রহের কারণে 'মুক্তচিন্তার লড়াইয়ের প্রথম কাতারের বালক বীর' হিসেবে আজ আমার পরিচয় শোভা পেতে পারত।

ক্লাস সিক্স থেকেই আমি কমবেশি নানান বয়সের লোককে দরখাস্ত লিখে দিতাম। অবশ্যই অনুরোধে। কীভাবে দরখাস্তবিশারদ হিসেবে আমার পরিচয় প্রসারিত হয়েছিল, তা আর মনে নেই। কিন্তু মোটামুটি নানান ক্লাসের ছেলেদের দরখাস্ত লিখে দেওয়ার দায়িত্ব পেতাম আর সেগুলো খুবই গর্বের সঙ্গে আমি পালন করতাম। পরবর্তী জীবনে আরও কিছু বিচিত্র ধরনের নানাবিধ পত্রও বেনামিতে আমি লোকজনকে লিখে দিয়েছি। তবে স্কুলজীবনের সিক্স-সেভেন-এইটে আমার প্রধান খ্যাতি ছিল দরখাস্ত লেখার। এর মধ্যে আমার নিজের জন্যও মোটামুটি নিয়মিতই দরখাস্ত লিখতে হতো। আমি এক রোগ-জর্জর বিদঘুটে অনাকর্ষণীয় বাচ্চা ছিলাম, যার সারাবছরে বার তিন-চারেক জ্বর হতো। আমার জ্বরে বাবা কাতর হতেন আমার থেকেও বেশি। আর আমার স্বহস্ত-লিখিত একটা দরখাস্ত তিনি নিয়ে যেতেন স্কুলে যাওয়ার সময়। একই স্কুলে দুই ভূমিকায় থাকার সুবিধাটা এভাবে নেওয়া হতো। এ-দফা দরখাস্ত লিখতে বসে আমি 'অধীনের বিনীত নিবেদন' কথাটা লিখেও আর বরদাশত করতে পারছিলাম না। এর আগেও, মনে পড়ে, এই ভাষামালার যাথার্থ্য বিষয়ে বাবাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিলাম।

আমার বাবা 'এত প্রশ্ন করিস কেন' কিংবা 'বেশি বোঝো? এখনো ঠিকমতো হাত-পা গজায়নি, পাঙ্খা গজাইছে তোমার!' ধরনের হুংকার দিতে খুবই অপারগ ধরনের বাবা ছিলেন। ফলে তিনি কোনো প্রশ্নে আটকে গেলে 'আসলেও এর তো কোনো মানে নাই' ধরনের সম্মতিমূলক ভূমিকা নিতেন। সে রকম ভূমিকাতে তাঁকে পেয়ে আমি দরখাস্তে 'অধীনের বিনীত নিবেদন' লেখার কোনোই কারণ পেলাম না। ফলে হেডস্যারের হাতে যে দরখাস্ত জমা পড়েছিল সেটা শুরু হয়েছিল এভাবে :'জনাব (কিংবা মহাত্মন... দুটোই আমি হরেদরে ব্যবহার করতাম, ফলে এটাও হতে পারে), আমি আপনার বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র।...' হেডমাস্টার সাহেব, আমাদের চলতি ভাষায় হেডস্যার, দরখাস্তে ছুটি হয়তো বরাদ্দ করেছিলেন কিংবা এ ধরনের দরখাস্তে বরাদ্দের সুযোগ সামান্যই থাকে। ছুটিখানা আমি খেতে-থেকেই তো পাঠিয়েছিলাম; কিন্তু তিনি কিছু বেত্রাঘাত বরাদ্দ করেছিলেন। তাঁর তরফে সেটি ছিল সুপরিকল্পিত। ফলে জ্বর শেষে যে-ই না আমি স্কুলে এসেছি, তিনি বেত্রাঘাত হাতে-নাতে বরাদ্দ করতে তাঁর ঘরে তলব করেছিলেন।

আমার তাঁর টেবিলের সামনে দুই হাতের তালু বের করে দাঁড়াতে হয়েছিল। এর পরের দরখাস্তে কী করেছিলাম, তা অবিকল মনে নেই। তবে দরখাস্তে এই বাহুল্য চর্চা, ভাষাভঙ্গিতে অধীনতা ব্যক্ত করার লাগাতার বিধি-ব্যাকরণ নিয়ে বিরক্ত হতে হতেই বড় হয়েছি। আমার ওই হেডস্যারের বিষয়ে ভীতি ছিল, নাকি বিরক্তি, নাকি ঘৃণা তা আসলে মনে নেই। যা বলব, বানিয়ে বলা হবে। কিন্তু এই এত বছর বাদে তাঁর জন্য আছে এক বিশাল মায়া। বিধানের বিহ্বল পাহারাদার হিসেবে তাঁকে দেখতে পাই; এমন এক বিধান যে বিধানের বিষয়ে প্রশ্ন করতে কখনও সক্ষমতা পাননি এমন এক মানুষ।

দুই।। প্রণালি আর শৃঙ্খলার সূক্ষ্ণ ফারাক
'মুক্তচিন্তা' কিংবা 'স্বাধীন চিন্তা' প্রচারণার সবচেয়ে বড় বিপজ্জনক দিক হলো এই, প্রচারণাটি 'বদ্ধ' ও 'পরাধীন' চিন্তাধারী একটা পক্ষকে আগাম-আন্দাজ করে আগায়। ফলত, চতুষ্পার্শ্বে গাদা গাদা 'বদ্ধ' মানুষজনকে অনুসন্ধান করে ফেলে, সাব্যস্ত করে ফেলে এবং পরিশেষে আচ্ছামতো মল্লযুদ্ধ লড়তে থাকে সেই পক্ষের সঙ্গে। এই বড় ক্ষয়ক্ষতিটির কয়েকটা পর্ব বললাম মাত্র। কিন্তু এখানেই বিপদটা শেষ হয়ে যায় না। এ রকম কড়া বিচারবোধের মধ্য দিয়ে চিন্তাপ্রণালি এবং চিন্তার শাসনব্যবস্থা নিয়ে বোঝাবুঝি পাতলা হয়ে যেতে বাধ্য। এখানে চিন্তাপ্রণালি আর চিন্তার শাসনব্যবস্থা দুটোই খুব সতর্ক (্‌ও বিচক্ষণ) ভাবে হাজির করেছি আমি। চিন্তার পিঠে আরেক চিন্তা, তার পিঠে আরেক চিন্তা। এভাবে মাকড়সার জালের মতো শত চিন্তা পেঁচিয়ে-পুঁচিয়েই যে আমাদের চিন্তার প্রণালি গড়ে ওঠে, তা আমি বিলক্ষণ বুঝতে পারি। নিশ্চয় আপনারাও পারেন, অবশ্যই যখন প্রচারণার মুডে থাকেন না তখন পারেন। তারপর সেই প্রণালি খোদ আবার পাটাতনের মতো কাজ করে; চাইলে তার নাম আমরা দিতে পারি উপলব্ধি, আবার কখনও ভিত্তিপ্রস্তাব বা প্রিমাইজ দিতে পারি। সেই পাটাতন-প্রিমাইজ আবার নতুন চিন্তাকে পিঠ পেতে দেয়; তার পিঠে আবার চিন্তা। দ্বান্দ্বিক আর কাকে বলে! মুক্ত বনাম বদ্ধ চিন্তার কুস্তি এই প্রণালিকে দেখতে দিতেই অপারগ থাকে।
আর থাকে অতি অবশ্যই শাসনপ্রণালি। শাসনপ্রণালি যে কীভাবে চিন্তার রকমফের, গতিপ্রকৃতি আর অভিব্যক্তিকে গড়াপেটা বা কারিগরি করতে পারে সে বিষয়ে দু'মিনিট গালে-হাত দিয়ে বসলেই স্পষ্ট বোঝাবুঝি তৈরি হয়ে যাবে। বর্তমান বাংলাদেশ থেকে বেশ কিছু উদাহরণ অনায়াসে দেয়া সম্ভব। বিশেষত, প্রতিটা বিশ্ববিদ্যালয়ে, কর্মক্ষেত্রে, গবেষণা ও প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানে যে-রকম ছাঁচে-বাঁধা মানুষজন উৎপন্ন হচ্ছেন সেদিকে নজর দিয়ে দারুণ সব উদাহরণ দেয়া সম্ভব। তবে বিদ্যমান বাংলাদেশে শাসনপ্রণালিই কেবল নয়, খোদ 'আইনের শাসন'ও এমন শক্তিশালীভাবে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে যে পান থেকে চুন খসলেই যে কেউ গ্রেপ্তার হয়ে যেতে পারেন। গ্রেপ্তার হলে তবু কপাল ভালো মানতে হবে; যদি আপনি গুম হয়ে যান তাহলে আপনি জানতেও পারবেন না যে কোথায় গেলেন।

এমনকি এই সুবিধাও তেমন নাই যে আমি উদাহরণ দিচ্ছি বলে নিছক আমাকেই গ্রেপ্তারযোগ্য ভাবা হচ্ছে, আপনি তা পড়ছেন বলেও গ্রেপ্তার বা গুম হয়ে যেতে পারেন। এরকম একটা মুক্ত আইনের শাসন বিরাজ করছে বলে কোনো কোনো অঞ্চলে গবেষক ও লেখকেরা কোনো কোনো বিষয়ে 'কারো দ্বারা প্ররোচিত না হইয়া' গ্রন্থ লিখে চলেছেন, কী নিবিড় মমতায় দেশপ্রেম প্রদর্শন করছেন, কিংবা কতটা প্রকট আনুগত্যে রাষ্ট্রীয় আইকনের প্রতি ভক্তিভাব দেখাচ্ছেন সেসব উদাহরণ না-দেয়া আমার পক্ষে বিচক্ষণ হবে। আমি তা দিলামও না। তবে আপনারা চেষ্টা করলে আমার না-দেয়া উদাহরণগুলো কল্পনা করে সাজিয়ে নিতে পারবেন। এই যে কল্পনা করে মনে-মনে সাজালেন তাকে আমরা শিথিল শর্তে 'মুক্তচিন্তা' বলতে পারব। কিন্তু এখানেও পুরোটা দুশ্চিন্তা সরে গেল না। এমন তো আর নয় যে, আমাদের না-উল্লেখ করা গ্রন্থগুলো রচনা করার জন্য কোনো বিশেষ উর্দিহীন ছাত্র বাহিনিকে দিয়ে পেটানো হয়েছিল; কিংবা উর্দিপরা কোনো বাহিনিকে দিয়ে। তা হয়নি। হবেও না। অথচ দিকে দিকে লোকজন প্রপাগাণ্ডাতে নেমে কষ্ট করে বই আর বক্তৃতা রচনা করছেন। এঁদের বিশাল একটা অংশ দীর্ঘকাল ধরে বাংলাদেশে 'মুক্তচিন্তা'র ওকালতি করেছেন। আপনাদের যদি বিশ্বাস না হয়, আমার এই নিবন্ধ পড়ার পর শিল্পকলা একাডেমি ও অন্যান্য জায়গায় বাংলাদেশের সাম্প্রতিককালে প্রকাশিত 'দেশাত্মবোধ' বইয়ের তালিকা জোগাড় করুন, তাঁর গ্রন্থকারদের ধরে ধরে তদন্ত করুন যে কী ধরনের 'দর্শন-ঘোষণা' তাঁরা দিতে থাকেন। এই তালিকা অতিশয় লম্বা এবং আমাকে আপনাদের এই তদন্ত কাজে না নেয়াই ভালো হবে। আমার অন্য কাজ আছে।

আপনারা হয়তো ভাবছেন আমি বাংলাদেশের দিকেই মনোনিবিষ্ট এক কূপমণ্ডূক; নিখিল বিশ্ব সম্বন্ধে আমার কোনোই ধারণা নাই। অন্যান্য বিষয়ে যতই অজ্ঞতা আমার থাকুক, এই 'মুক্তচিন্তা' বিষয়ে আমি হলপ করে বলতে পারি যে নিখিল বিশ্বের অবস্থা খুব ভিন্ন নয়। বাংলাদেশের পরিস্থিতি সন্দেহাতীতভাবে বেশি ল্যাদল্যাদা। তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে ইউরোপ অবধি 'মুক্ত' ও 'স্বাধীন' চিন্তকেরা মহাবিশ্বের উন্নয়ন থেকে শুরু করে দারিদ্র্যমুক্তির উপায়, জলবায়ু পরিবর্তন থেকে শুরু করে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক কাঠামো সকল বিষয়ে ঠিক সেই চিন্তাই উৎপাদন ও প্রকাশ করতে থাকবেন, যা তাঁর বাপদাদা 'মুক্তচিন্তকেরা'ও করেছেন। ব্রিটেনের বা ডাচভূমির রানি বা রাজা বিষয়েও তাঁদের 'স্বাধীন বিহ্বলতা' প্রায় কাছাকাছি 'স্বাধীন' (্‌ও সমরূপ হতবিহ্বল)। এই যে একই 'মুক্ত' চিন্তা ১৪ গুষ্টি ধরে নিখিল বিশ্বের মানুষজনের মাথায় কিলবিল করছে তা আসলে থাকলেই কী, আর না থাকলেই কী। বরং না থাকলেই আপনি শান্তিতে থাকতে পারবেন। অন্তত একই ভ্যাজর-ভ্যাজর বংশানুক্রমিকভাবে শুনতে থাকার পরিশ্রান্তি বেঁচে যাবে আপনার।

বিষয়টা আসলে আরো অনেক বিপজ্জনক। গাঢ় ও অনড় ভেদবিচারের ওপর দাঁড়িয়ে আছে মুক্তচিন্তার প্রচারণা, এমনকি দর্শন। এই প্রগাঢ় ভেদবিচারে মনুষ্যকুল বর্গীকৃত হতে থাকেন এমন দুরূহ প্রতিপক্ষতায়, যার থেকে যাপিত জীবন ও অভিজ্ঞতামণ্ডলী দূরবর্তী। যাপিত জীবনে আমরা পাই এমন এক পুরোহিত কিংবা ইমাম সাহেব যিনি কেবল অন্য ধর্মের আত্মীয়ই সামলাচ্ছেন না, দরকার মতো আশ্রয় দিচ্ছেন কুমারী মাতা কিংবা অন্য কোনো 'পাপিষ্ঠ'কে; আবার পাই এমন ভ্যানগার্ড বা 'মুক্তচিন্তার অগ্রদূত'কে যিনি মেয়ের (বা ছেলের) এমনকি বৈধ বিয়েটাতেই খান্দান না মিললে হুংকার ছেড়ে বাড়ি মাথায় করছেন। আমার এই স্থূ্থল উদাহরণের লক্ষ্য এটা দেখানো নয় যে মানুষের পেটভর্তি 'ডাবলস্ট্যান্ডার্ড', বরং এটাই যে মানুষের অজস্র আচরণ লাগাতার চলমান থাকে; আর সেগুলো প্রায়ই বর্গ বা খোপে ভরে রাখা মানদণ্ডগুলোর সাথে মানানসই থাকে না। বরং, চিন্তার নিয়মের মধ্যে না থাকলে, নিজেকে না-আনলে, অধিকাংশ মানুষই অজস্র আচরণের একটা বড়সড় ডিব্বা মাত্র, প্রায়ই তা আপাতগ্রাহ্যে খাপছাড়া সব আচরণ আর কর্মকাণ্ডের সমাহার। অন্তত, নানাবিধ মুখোমুখি উল্টা-অর্থের যে বর্গ ভাগ করে রাখা আছে তা মেপে সেসব আচরণ বা কর্মকাণ্ড সাধিত হয় না। সেদিক থেকে, খুব সাধারণভাবেও যদি চিন্তা করেন, দেখবেন তথাকথিত 'মুক্তচিন্তা' বলে যদি কোনো কিছুকে আমরা সাব্যস্ত করতে পারিই তা চিন্তাকে প্রণালিবদ্ধ করার একটা দুর্নিবার অনুশীলন। 'যেমন খুশি তেমন চিন্তা'র কোনো মাতলামি নয়। এটা তাই বড়জোর 'নিজেদের' উৎকৃষ্টতা দাবির একটা ঝাণ্ডা মাত্র।

'মুক্তচিন্তা' তাই কাঁঠালের আমসত্ত্ব, জিলিপির রসুন। যদি প্রবক্তারা বুঝিয়ে থাকেন যে তাঁরা বন্দি অবস্থাতে থেকেও শাসকের প্রণালির বাইরে চিন্তিতে পারেন, তাহলে এর থেকে কার্যকরী ও অর্থবোধক পদ-প্রত্যয় খুঁজে বের করতে পারা জরুরি। এমনকি 'শাসকবিরুদ্ধ' বা 'শাসনবিরল্ফম্নদ্ধ' চিন্তা নাম দিলেও অভিধানে রাগ করবে না। মুক্ত বা স্বাধীন চিন্তা একটা নিরর্থক ধরনের কথা; খামোকাই বলতে-বলতে স্তম্বের মতো খাড়া করে ফেলা একটা খামোকা-মিনার।
লেখক
প্রাবন্ধিক
কথাশিল্পী

আরও পড়ুন

×