ঢাকা রবিবার, ০৬ জুলাই ২০২৫

বহুত্ববাদী সমাজে আদিবাসী

বহুত্ববাদী সমাজে আদিবাসী

ঞ্যোহ্লা মং

প্রকাশ: ১২ অক্টোবর ২০২৩ | ০২:১৩ | আপডেট: ১২ অক্টোবর ২০২৩ | ০২:১৩

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের গবেষণা মতে, বাংলাদেশে বাংলাসহ মোট ৪১টি ভাষা রয়েছে। এ ছাড়া ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সাংস্কৃতিক আইন-২০১০-এ মোট ৫০টি আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর নাম পাওয়া যায়। বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামসহ অনেকের মতে এই সংখ্যা আরও অধিক হতে পারে। সে অর্থে বাংলাদেশ একটি বহু ভাষাভাষী ও নানা ছোট-বড় জাতিগোষ্ঠী নিয়ে বৈচিত্র্যপূর্ণ একটি দেশ।

এ দেশে আদিবাসীরা কেমন আছেন, তা জানতে পরিচিত মুখদের সাম্প্রতিক সময়ের কিছু ফেসবুক পোস্টে ঘুরে আসতে পারি। যেমন– প্রথম আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা পদকপ্রাপ্ত মথুরা বিকাশ ত্রিপুরা গত ৫ সেপ্টেম্বর ২৩ তারিখে লিখেছেন, “পাঠ্যপুস্তকে আদিবাসী পরিচিতি, সমাজ, সংস্কৃতি ইত্যাদি সম্পর্কে কী লেখা আছে, তা দেখা শুরু করেছিলাম ২০০৩ সাল থেকে। তখনও অনেক অসংগতি ছিল পাঠ্যপুস্তকে। যেমন– সাঁওতাল সম্পর্কে বিবরণে লেখা ছিল ‘সাঁওতালদের চুল কুঁকড়া’, গারো পরিচিতিতে লেখা ছিল, ‘গারোদের চোখ ঘোলাটে’, চাকমাদের ছবি ছিল শিংওয়ালা শিরস্ত্রাণ পরিহিত পুরুষ। এগুলোর ব্যাপারে স্থানীয় ও জাতীয়ভাবে বিভিন্ন কর্নার থেকে বিস্তর আলোচনা, পরামর্শ, প্রতিবাদ ও লেখালেখি হয়। ২০১১ সাল হতে এই অসংগতিগুলো কিছুটা ঘুচে যেতে শুরু করে।” বর্তমানে পাঠ্যপুস্তকে অনেক পরিবর্তন এসেছে তা সত্য। চতুর্থ শ্রেণির গণিত বইয়ে অনেক পাহাড়ি, আদিবাসীদের নাম পাওয়া যায়। ‘বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচিতি’ বইয়ে বাংলাদেশে স্বাধীনতা সংগ্রামে বাঙালির পাশাপাশি অন্য ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর অংশগ্রহণের কথা এক লাইন যুক্ত করার উদাহরণ রয়েছে।

শিক্ষা ক্ষেত্রে বড় একটি পরিবর্তন হিসেবে জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-এ আদিবাসী শিশুদের মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষালাভ এবং ঝরে পড়া রোধে হোস্টেল নির্মাণের কথা উল্লেখ আছে। আরও গুরুত্বপূর্ণ হলো শিক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ নীতিতে আদিবাসী শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। ২০১০-এর শিক্ষানীতির আলোকে ইতোমধ্যে পাঁচটি আদিবাসী ভাষায় তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত বই রচিত ও বিতরণ করা হয়েছে। যদিও কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের অভাবে বিতরণকৃত বইগুলো স্কুলেই পড়ে রয়েছে। এটি একটি দিক। অন্যদিকে শহর-বন্দরে স্কুলগুলোতে আদিবাসী শিক্ষার্থীদেরও নানা প্রতিবন্ধকতায় পড়তে হতে শোনা যায়। যেমন– উন্নয়নকর্মী মৃনাল কান্তি ত্রিপুরার ছোট মেয়ে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে, তোমার মাতৃভাষার নাম কী লেখ? প্রশ্নের উত্তরে ত্রিপুরা বা ককবরক লিখলে, ভুল উত্তর হিসেবে কেটে দেওয়া হয়। ঢাকার একটি স্বনামধন্য স্কুলের শিক্ষিকা আমায় বললেন, “আপনার ছেলে মাতৃভাষায় দুর্বল।” আমি বললাম, “সে মাতৃভাষায় খুব ভালো। রাষ্ট্রভাষাটি আয়ত্তে আনতে তাকে আপনাদের কিছুটা সময় দিতে হবে।” তিনি আমার কথাটি মানতে পারেননি। আমিও বোঝাতে পারিনি, বাংলা আমার মাতৃভাষা নয়, আমার রাষ্ট্রভাষা। 

সম্প্রতি একটি দৈনিকে প্রকাশিত প্রতিবেদন মতে, পাহাড়ে ৪০ শতাংশ শিশু প্রাথমিক শিক্ষার পরে ঝরে পড়ে। তিন পার্বত্য জেলায় হস্তান্তরিত বিভাগ হিসেবে শিক্ষা খাতে উন্নতির সুযোগ থাকলেও তা করতে পুরোপুরি ব্যর্থ বলতে পারি। জেলা পরিষদ কর্তৃক প্রতি বছর শিক্ষক নিয়োগ ও বদলি নিয়ে ব্যাপক অনিয়মের কথা শোনা যায়। মেধাবীরা শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ না পাওয়ায় প্রতি বছর ফেসবুকে নানা রসালো গল্প পাওয়া যায়। পার্বত্য জেলা পরিষদগুলোর নিজস্ব আইন দ্বারা পরিচালিত ও গঠিত হওয়ার কথা থাকলেও কয়েক দশক ধরে মনোনীত সদস্যদের দিয়ে পরিষদ গঠিত হওয়ায় একপ্রকার মন্ত্রণালয়ের পোস্টবক্সে পরিণত হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। মনোনীত সদস্যদের রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী হওয়ায় স্থানীয় জনগোষ্ঠীর স্বার্থের বদলে দলের দৃষ্টিভঙ্গি এবং তার নিজের চেয়ার আঁকড়ে থাকতে অধিক আগ্রহী হতে দেখা যায়। ফলে এ যাবৎকালে গঠিত তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানদের মধ্যে অধ্যাপক মানিক লাল দেওয়ান ও গৌতম দেওয়ান ছাড়া আর নতুন কাউকে স্থানীয়দের মনে দাগ কাটতে দেখা যায়নি। এককেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থার মাঝেও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর অংশগ্রহণে প্রশাসন বিকেন্দ্রীকরণের একটি সুন্দর উদাহরণ। কিন্তু রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবে পরিষদগুলোকে নিজ আইনের আলোকে চলার বদলে মন্ত্রণালয়ের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখা যায়। এবং নানা তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে পরিষদকে বিভিন্ন নামে অভিহিত করে সম্বোধন করা হয়। 

শহর শিক্ষিত সমাজে নানা সময়ে আদিবাসীদের প্রশ্নে তিন পার্বত্য জেলা পরিষদে আসীন পাহাড়ি প্রতিনিধিদের দেখানো হয়। কিন্তু তারা চেহারায় পাহাড়ি আদিবাসী হলেও মননে, চিন্তায় মনোনীত রাজনৈতিক দলের তা বোঝানো কঠিন হয়ে পড়ে। কাপেং ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক, পল্লব চাকমা, সম্প্রতি (২৭ সেপ্টেম্বর ২৩) একটি ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, “পাহাড়ের খুমী জাতির প্রথম স্নাতক-লেলুং দা ঢাবিতে পড়ার সুযোগ পাননি। ঢাবিতে মেধাবী শিক্ষার্থী বেছে নেয়ার নিয়মের কারণে তিনি ভর্তি পরীক্ষার ফরমও নিতে পারলেন না। তখন ঢাবির কয়েকজন শিক্ষক এবং পাহাড়ি শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ জানিয়েছিলেন। পাহাড়সম অনেক প্রতিকূলতা পেরিয়ে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করা খুমী জাতির প্রথম শিক্ষার্থী হিসেবে বিশেষ বিবেচনায় লেলুং খুমীকে যেন ভর্তির সুযোগ দেয়া হয়। শিক্ষকরা পত্রিকায় কলাম পর্যন্ত লিখলেন লেলুং দাকে নিয়ে। কিন্তু এত বড় উদারতা দেখাতে ব্যর্থ হলেন প্রাচ্যের অক্সফোর্ডের কর্তাব্যক্তিরা। যে লেলুং খুমীকে ঢাবি সুযোগ দেয়নি, সেই লেলুং খুমী অস্ট্রেলিয়া সরকারের সহায়তায় সেদেশের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অত্যন্ত সফলতার সাথে স্নাতক ডিগ্রি সম্পন্ন করেন। খুমী জাতির এই প্রথম গ্র্যাজুয়েটকে নিয়ে সাউদার্ন ক্রস ইউনিভার্সিটি সেলিব্রেশন করেছে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, নিজ দেশের একটি জাতির সন্তানকে প্রথম স্নাতক বানানোর কৃতিত্ব থেকে বঞ্চিত হলো আমাদের প্রিয় ঢাবি।”

পাহাড়ের শিক্ষার্থীরা নানা সংগ্রাম, প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে বেড়ে ওঠে। লেখাপড়া শেষে চাকরিতে ঢোকার জন্য বিসিএসে ৫ শতাংশ কোটা থাকলেও কোটা আন্দোলনের বলি হয়ে সেটিও বাতিল করা হয়। আদিবাসী মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের বিসিএস কর্মকর্তা হওয়ার স্বপ্ন শেষ হয়ে যায়। কোটা বাতিলের পরে ৪০তম ব্যাচে মোট ১৭ জন ভাইভা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেও মাত্র একজন ক্যাডার কর্মকর্তা পদের জন্য সুপারিশপ্রাপ্ত হন বলে জানা যায়। বাকিদের সবাইকে নন ক্যাডার পদের জন্য সুপারিশ করা হয়। এর পরে ৪১তম বিসিএস পরীক্ষায় ২৪ জন ভাইভা পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন, তাদের মধ্যে মাত্র একজনকে চূড়ান্তভাবে ক্যাডার কর্মকর্তা হিসেবে সুপারিশ করা হয়। কোটাবিহীন বিসিএস পরীক্ষায় গত দুই ব্যাচে মাত্র একজন করে নির্বাচিত হয়েছেন। এ পর্যন্ত যারা কোটায় মনোনীত হয়ে বিসিএস কর্মকর্তা হয়েছেন, তারা প্রায় সবাই অত্যন্ত সুনামের সাথে কাজ করেছেন, করছেন। এখন কোটাবিহীন সত্ত্বেও যারা ভাইভায় পাস করছেন, তাদেরকে আরও অগ্রাধিকার দৃষ্টিতে দেখার সুযোগ ছিল বলে মনে করি। কর্মকর্তা আমলাদের মাঝে যদি বৈচিত্র্য না থাকে, একটি দেশ বৈচিত্র্যপূর্ণ বৈশিষ্ট্য নিয়ে টিকে থাকার কথা চিন্তা করতে পারি না। তাছাড়া পার্বত্য জেলা পরিষদ, পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড, পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ, পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোতে যদি সংশ্লিষ্ট জাতিগোষ্ঠীর প্রতিনিধি না থাকে, একসময় মুখ থুবড়ে পড়তে বাধ্য। কারণ সমতলের একজন আমলা পাহাড়, আদিবাসীদের প্রথা, নীতি সম্পর্কে ভালো ধারণা পোষণ না করলে সুফলের সম্ভাবনা আশা করতে পারি না। 

পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক কমিটির মতে, “ব্রিটিশ আমলে জেলার প্রধান অর্থাৎ ডেপুটি কমিশনারদের অধিকাংশই ইউরোপীয় ছিলেন যারা আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে আইনানুগভাবে নিজেদের পরিচালনা করবার ক্ষেত্রে শুধু নীতিনিষ্ঠ ছিলেন তা নয়, পার্বত্য চট্টগ্রামে পদায়ন নেয়ার সময় তারা পার্বত্য চট্টগ্রাম রেগুলেশন সম্পর্কে অধ্যয়ন করে বা সম্যক ধারণা নিয়েই আসতেন। … কিন্তু পাকিস্তান সৃষ্টির অব্যাবহিত পরে ডেপুটি কমিশনার হিসেবে এ দেশীয় কর্মকর্তারা নিয়োজিত হওয়ার পর থেকে হাতে কিছু সংখ্যক প্রাজ্ঞ ডেপুটি কমিশনার ছাড়া অধিকাংশই হিল ট্র্যাক্ট ম্যানুয়াল সম্পর্কে স্বচ্ছ কোনো ধারণাই ছিল না। ফলে এখানকার ভূমি প্রশাসন ও ভূমি ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত কোনো ইস্যুতে তারা পার্বত্য চট্টগ্রাম রেগুলেশন ১৯০০-এর অভিপ্রায় প্রতি শতভাগ নিষ্ঠ হতে ব্যর্থ হতেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এসব কর্মকর্তার অনেকেই তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব সম্পাদনে নিরপেক্ষতা বজায়ে অসমর্থ ছিলেন” (দেখুন: প্রফেসর মংসানু চৌধুরী, পার্বত্য ভূমি সহায়িকা, পৃষ্ঠা xiii)। 

পাহাড় কিংবা সমতল দ্বন্দ্বের মূলে রয়েছে ভূমি। রক্ষাকবচ হিসেবে সমতলের জন্য ১৯৫০ সালের আইন আর পাহাড়ের জন্য ১৯০০ সালের আইনটি থাকলেও চর্চার মানসিকতার অভাবে দ্বন্দ্ব আরও প্রকট করে তুলেছে। বান্দরবানে লামা উপজেলায় রাবার ইন্ডাট্রিজ লিমিটেড নামে ভূমি দখলের নানা অপচেষ্টার কথা আমরা বলতে পারি। প্রভাবশালী ৬৪ জনের বিপরীতে ২৫ একর করে ১৬০০ একর জমি লিজ দেওয়া হলেও আরও তিনটি গ্রাম, জুম ভূমি, মৌজা ভূমিও গ্রামীণ বনসহ প্রায় ৩৫০০ একর ভূমি দখল করা হয়েছে (দেখুন: ১০ নভেম্বর স্মরণে, পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি, পৃষ্ঠা ৬৫)। এ ছাড়া পর্যটন, রিসোর্ট, মোটেলের নামে হাজার একর দখলের উদাহরণ পেতে খুব বেশি কষ্ট করতে হবে না। আমরা প্রশ্ন করতে পারি, ঢাকা শহরে অনেকগুলো পাঁচতারা মোটেল রয়েছে। সে হোটেল-মোটেল, রিসোর্টগুলো কি ১০০০ একরের ওপর গড়ে উঠেছে? তবে কেন পাহাড় বা আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকায় পর্যটন কিংবা উন্নয়নের নামে কোনো প্রকল্প হাতে নিলেই শত শত একরের প্রয়োজন হবে? বসতি জায়গা সব দখলে নিতে থাকলে তারা কোথায় বাস করবে? কোথায় যাবে? চিন্তা করছি কি? 

জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সাংস্কৃতিক আইন ২০১০ ছাড়াও নির্বাচনী ইশতেহারে পরিষ্কারভাবে আদিবাসীদের কথা উল্লেখ থাকলেও বিভিন্ন সময়ে সরকার থেকে আদিবাসী শব্দের ব্যবহার নিয়ে চিঠি, বিবৃতি দিতে দেখা যায়। সরকারের এমন মানসিকতার প্রভাবে প্রভাবশালীরা আদিবাসীদের নানাভাবে হেয় করার, বঞ্চনা, বৈষম্য করার, শোষণ করার উৎস হিসেবে কাজ করে। 

আদিবাসী এলাকায় উন্নয়ন বা প্রকল্পে সংশ্লিষ্ট এলাকায় আদিবাসী প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণ, মতামত প্রকাশের সুযোগ রাখা হয় না। ফলে প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে বিরোধিতায় গেলে ‌‘উন্নয়নবিরোধী’ ইত্যাদি বলে দ্বন্দ্ব হতে দেখা যায়। নীতিনির্ধারকদের বোঝা উচিত, আদিবাসীরা তাদের অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদেই বিরোধিতা করে। সরকার আদিবাসী ও ট্রাইবাল জনগোষ্ঠীর উন্নয়নে অঙ্গীকারাবদ্ধ হতে আইএলও কনভেনশন ১০৭ অনুস্বাক্ষর করেছে। চলমান অষ্টম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় আইএলও কনভেনশন ১৬৯ এবং আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর অধিকারবিষয়ক জাতিসংঘ ঘোষণাপত্র ২০০৭ অনুস্বাক্ষরে প্রতিজ্ঞা করেছে (পৃষ্ঠা ৭৭২)। সরকার তার প্রতিজ্ঞার আলোকে আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকায় যে কোনো উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণে তাদের সাথে বসে পরিকল্পনা করা উচিত। 

সমতলের তুলনায় পাহাড়ে কিছুটা হলেও ইউনিয়ন পরিষদের মতো প্রতিষ্ঠানে তাদের কিছু প্রতিনিধি রয়েছে। সমতলের আদিবাসীদের সে সুযোগ কম। ফলে নিজেদের প্রতিনিধি না থাকায় বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা হতে বঞ্চিত হবে তা অনুমেয়। যেমন– করোনাকালে প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক পরিবারপ্রতি ২৫০০ টাকার এককালীন বিশেষ সহায়তা মাত্র ২-৪ জন পেয়েছিল বলে জানিয়েছিল হাজং জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধি নিরমল চন্দ্র দাস (দেখুন দ্য ডেইলি স্টার, ৩০ জুলাই ২০)। আবার সুফল চাকমার এক প্রতিবেদনে জানা যায়, রুমা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে ১১টি পদ থাকলেও শিক্ষক রয়েছেন মাত্র চারজন। এর মধ্যেও দু’জন বিএড প্রশিক্ষণে রয়েছেন। ফলে পুরো একটি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় চলছে দু’জন শিক্ষক দিয়ে (দেখুন: প্রতিদিনের বাংলাদেশ ১২ মার্চ ২৩)।

লেখাটি শেষ করতে চাই, আশার কথা বলে, বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো সর্বশেষ আদমশুমারিতে আদিবাসীদের আলাদা করে জাতিগোষ্ঠী ভেদে গণনা করা হয়েছে। এটি একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ। বৈচিত্র্য বা বহুত্ববাদী সমাজের প্রয়োজনে এমন উদ্যোগগুলো আমাদের এগিয়ে নিতে হবে। তবেই সমাজে নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ গুরুত্ব দিতে শুরু করবে। উন্নয়ন পরিকল্পনায় তাদের অংশগ্রহণের সুযোগ দিতে হবে। আমরা জানি এখনও পর্যন্ত অনেক জাতিগোষ্ঠী পাওয়া যাবে যাদের থেকে বিসিএস কর্মকর্তা দূরে থাক, একজন দ্বিতীয় শ্রেণির কর্মচারীও নেই। তাদের জন্য কোটা রাখতেই হবে। আদিবাসী কোটা বন্ধ হওয়ায় শুধু আদিবাসীরা বঞ্চিত হয়নি, সরকার, প্রশাসনের মাঝেও বৈচিত্র্য, ভিন্নভাবে দক্ষ-মেধাবী এবং দেশকে নানা জনগোষ্ঠীর দৃষ্টিতে দেখার সুযোগ কমল। বহুত্ববাদী সমাজ, নানা জাতিগোষ্ঠীর দেশ, বৈচিত্র্যপূর্ণ সংস্কৃতির দেশের বৈশিষ্ট্যের ধারক ও বাহক আদিবাসীরা। তাদের নিয়েই সব উন্নয়ন পরিকল্পনা হওয়া আবশ্যক। 

লেখক: উন্নয়নকর্মী ও কলাম লেখক

আরও পড়ুন

×