সমতা ও সামাজিক ন্যায্যতা

শাহীন আনাম
প্রকাশ: ১২ অক্টোবর ২০২৩ | ০২:৩২ | আপডেট: ১২ অক্টোবর ২০২৩ | ০২:৩২
গত ৫০ বছরে বাংলাদেশের নারীদের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। এখনকার নারীরা যেভাবে তাদের কর্মক্ষেত্রে এগিয়ে যাচ্ছে, তা ২০ বছর আগে অসম্ভব মনে হতো। পুলিশ বাহিনীতে এখন ৮ হাজারের বেশি নারী সদস্য আছে এবং পুরুষ সহকর্মীদের পাশাপাশি নারীরা শান্তিরক্ষা মিশনে যাচ্ছে, যুদ্ধবিমান চালাচ্ছে। সরকারের বিভিন্ন প্রশাসনিক দপ্তরে সচিব হিসেবে কাজ করছে ১০ জন নারী এবং আরও নারী পদোন্নতি পেয়ে উচ্চ অবস্থানে যাচ্ছে।
হিমালয় জয়ের পাশাপাশি ফুটবল, ক্রিকেট, অ্যাথলেটিকসেও মেয়েরা ভালো করছে। প্রতি বছরই প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষাগুলোতে মেয়েরা ছেলেদের চেয়ে এগিয়ে থাকছে। শ্রমশক্তিতেও নারীদের অংশগ্রহণ ধীরে ধীরে বেড়েছে। গার্মেন্টস সেক্টরের ৪০ লাখ নারীকর্মীর পাশাপাশি, অন্যান্য ক্ষেত্র যেমন– সেবামূলক খাত, সরকারি চাকরি এসব ক্ষেত্রেও নারীদের জন্য কাজের সুযোগ তৈরি হয়েছে।
মানব উন্নয়ন সূচকে নারীদের স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সার্বিক অবস্থার উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয়েছে। জেন্ডার সমতার ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান অন্যতম। ২০২৩ সালের বৈশ্বিক জেন্ডার বৈষম্য সূচক অনুযায়ী এ দেশের অবস্থান ৫৯তম এবং রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে ১৪৭টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ৭ম অবস্থানে আছে।
নারীদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি হয়েছে রাজনৈতিক অংশগ্রহণ ও রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে। বর্তমান সরকারের বিভিন্ন নীতিমালার কারণে একেবারে তৃণমূল থেকে সর্বোচ্চ পর্যায়ের রাজনীতিতে নারীরা অংশ নিতে পারছে। সারা বিশ্বে খুব কম দেশই আছে, যারা একই সঙ্গে একজন নারী প্রধানমন্ত্রী ও একজন নারী স্পিকার এবং গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের নারী মন্ত্রী নিয়ে গর্ব করতে পারে। গত ৩০ বছরে বাংলাদেশ দু’জন নারী প্রধানমন্ত্রী পেয়েছে, যা সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছানোর স্বপ্ন দেখতে বাকি নারীদের অনুপ্রেরণা দেয়।
তবে এই অগ্রগতি সারা বাংলাদেশের নারীদের সামগ্রিক অবস্থার চিত্র নয়, কারণ এখনও নারীরা নিজেদের ব্যক্তিগত ও জনপরিসরে নানা ধরনের বৈষম্য, সহিংসতা ও আধিপত্যের শিকার হচ্ছে। একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মনে রাখতে হবে, সব নারী কিন্তু এক নয়। তাদের শিক্ষা, অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থান, পেশা, জাতিসত্তা, ধর্ম ও বর্ণে পার্থক্য রয়েছে। মধ্যবিত্ত শ্রেণির নারীদের কিছুটা সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন হলেও নারীদের একটি বড় অংশ এখনও সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় কোনো ভূমিকা রাখতে পারে না।
যেসব নারী ঘরে বসে গৃহস্থালির কাজ করে ও পরিবারের অন্য সদস্যদের সেবা দেয়, তাদের কোনো সম্মান দেওয়া হয় না এবং তাদের এই কাজের কোনো মূল্যায়নও নেই। অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কর্মরত স্বল্পশিক্ষিত ও সীমিত দক্ষতাসম্পন্ন নিম্নবিত্ত নারীরা বেতনের ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হয় এবং তাদের চাকরির কোনো নিরাপত্তা নেই। বাংলাদেশে বাল্যবিয়ের হার ৫১ শতাংশ, যা বিশ্বে অন্যতম সর্বোচ্চ। বিবিএসের ২০১৫ সালের একটি জরিপ অনুযায়ী, অন্তত ৬০ শতাংশ নারী পারিবারিক সহিংসতার শিকার হয়। এখন প্রশ্ন হলো, নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে সরকারের এত প্রতিশ্রুতি, কয়েক দশকের নারী আন্দোলন এবং নারীদের জন্য এনজিও সেক্টরের বিরাট কর্মযজ্ঞের পরও বাংলাদেশের নারীদের এই অবস্থা কেন? এর উত্তর অত সহজ নয়। কারণ নারীর ক্ষমতায়ন বেশ কিছু বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ বিষয়ের সঙ্গে জড়িত, যেগুলোর জন্য বিভিন্ন পর্যায়ে পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।
বাস্তবতা হলো, আমাদের জীবনের নানা ক্ষেত্রে উন্নয়ন ও আধুনিকায়নের ছোঁয়া লাগলেও বাংলাদেশে এখনও সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় অনুশাসন ও আচার-আচরণের ভিত্তিতে তৈরি হওয়া একটি প্রথাগত সমাজব্যবস্থা বিরাজমান। এসব অনুশাসন ও আচার-আচরণ নারী ও কন্যাশিশুদের প্রতি বিরূপ ভাবাপন্ন এবং নারীদের অগ্রগতির পথে বাধাস্বরূপ। এর সবচেয়ে জ্বলন্ত উদাহরণ হলো বাল্যবিয়ে। কমবয়সী একটি মেয়েকে যখন জোর করে বিয়ে দেওয়া হয়, তখন সে এর জন্য প্রস্তুত থাকে না এবং এই পরিস্থিতি তার শিক্ষা, দক্ষতা বৃদ্ধি বা কর্মসংস্থানের দ্বার বন্ধ করে দেয়। মেয়েটির সিদ্ধান্ত নেওয়ার কোনো ক্ষমতা থাকে না এবং নতুন পরিবারের অনুশাসনই মেনে চলতে হয়, যারা আশা করে, সে শুধু গৃহস্থালির দায়িত্বই সুনিপুণভাবে পালন করবে।
করোনা মহামারি নারী ও কন্যাশিশুদের জীবনকে আরও বিপর্যস্ত করে তুলেছে। হাজারো অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েকে বিয়ে দেওয়া হয়েছে এবং নারীরা আগের চেয়ে বেশি পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে। বেশি ভুগতে হয়েছে গ্রামাঞ্চলের দরিদ্র নারী ও মেয়েদের। মধ্যবিত্ত শিক্ষিত নারীদের কিছুটা অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষমতায়ন হলেও নিজের পছন্দমতো পেশা বা জীবনসঙ্গী বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে তাদের প্রথাগত রীতিনীতিই মানতে হয় এবং লোকলজ্জার ভয়ে তারা পারিবারিক সহিংসতা মুখ বুজে সহ্য করে যায়, ডিভোর্স দিয়ে আলাদা হয়ে যেতে পারে না।
ব্যক্তিগত ও জনজীবনে নারীদের সত্যিকারের ক্ষমতায়ন ও সমতা অর্জন করতে হলে কিছু শর্ত অবশ্যই যুগপৎভাবে পূরণ হতে হবে। সবচেয়ে জরুরি হলো পরিবারে নারী ও মেয়েদের অবস্থানের পরিবর্তন ঘটাতে হবে এবং নারীর প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি আরও ইতিবাচক হতে হবে। যদি শিক্ষা, দক্ষতা অর্জন ও জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত স্বাধীনভাবে নেওয়ার ক্ষেত্রে মেয়ে ও ছেলেরা সমান সুযোগ পেত, তাহলে পরিস্থিতি অন্যরকম হতো। তবে এর জন্য রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতির পাশাপাশি পারিবারিক ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং মানসিকতায় আমূল পরিবর্তন আনতে হবে।
বর্তমান সরকারের শাসনামলে প্রণীত বিভিন্ন নীতিমালা ও আইনের পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি ঠিকই আছে, কিন্তু যেসব প্রতিষ্ঠান এই নীতিমালা ও আইনগুলো প্রয়োগের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত তাদের দায়বদ্ধতা ও আন্তরিকতা নেই। নারীর ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে জনসেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর নিষ্ক্রিয়তা একটি বড় বাধা। কোনো অন্যায়ের বিচার চাইতে গেলে নারীরা বাধার সম্মুখীন হয়, সরকারি পরিষেবাগুলো অপ্রতুল, প্রাথমিকের পরই মেয়েরা স্কুল থেকে ঝরে পড়ছে এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নারীদের সমস্যার বিষয়ে সংবেদনশীল নয়। যে আইনগুলো রয়েছে, সেগুলোর প্রয়োগের অভাবে বাল্যবিয়ে কমছে না। অন্যান্য আইন, যেমন– পারিবারিক সহিংসতা প্রতিরোধ আইন, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন এগুলোরও খুব বেশি প্রয়োগ নেই।
জীবনে নিরাপত্তা ও সুরক্ষার অভাব নারীদের বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ডে অংশ নেওয়া, ঘরের বাইরে কাজ করা এবং নির্দিষ্ট বয়সের পর লেখাপড়া করা থেকে দূরে থাকতে বাধ্য করে। ফলে তার এগিয়ে যাওয়া বাধাপ্রাপ্ত হয়। এটি টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের ক্ষেত্রে একটি হুমকি হয়ে উঠেছে। কারণ লক্ষ্যগুলোর মধ্যে রয়েছে– ২০৩০ সালের মধ্যে সব সামাজিক সূচকে জেন্ডার সমতা নিশ্চিত করা। তবে নিরাপত্তাহীনতা যে শুধু ঘরের বাইরেই তা নয়, নারীরা পারিবারিক সহিংসতারও উচ্চ ঝুঁকিতে থাকে। জনপরিসরে নিরাপত্তাহীনতা এবং নির্যাতন, ধর্ষণ, ধর্ষণচেষ্টার হুমকি নারী ও মেয়েদের মনে এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের মধ্যেও একটা ভীতি তৈরি করে। এই ভীতির কারণেই বাবা-মায়েরা অল্প বয়সে মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দেয়। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো অন্যায়কারীদের শাস্তি নিশ্চিত না হওয়া। মাত্র ২ শতাংশ ধর্ষণকারী সাজাপ্রাপ্ত হয়। অর্থাৎ নারী ও মেয়েদের প্রতি অন্যায় হলে অন্যায়কারীর শাস্তি নিশ্চিত হওয়া প্রায় অসম্ভব বিষয়। বিচার চাইতে গিয়ে পদে পদে অপমান, দুর্ভোগ, বিচারিক প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতা, বারবার যাতায়াত, নানা খরচ; এসব কারণে অনেক পরিবারই মাঝপথে হাল ছেড়ে দেয় এবং বিচার পাওয়ার যে মৌলিক অধিকার, তা থেকে বঞ্চিত হয়।
আমরা বিশ্বাস করি, যে কোনো সমস্যার সমাধান প্রথমে পরিবারেই হয়। পরিবার অবশ্যই নারীকে সম্মান দেবে এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারীর অবদান স্বীকার করবে; সেটা হোক বাড়ির বাইরে গিয়ে চাকরি করা বা ঘরে থেকে গৃহস্থালি কাজকর্ম ও সন্তান প্রতিপালন। আমরা মনে করি, প্রত্যেক নারীরই সমাজে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে এবং কর্মসংস্থানের জন্য তাদের শিক্ষা ও দক্ষতা বাড়াতে হবে। একই সঙ্গে এটিও মাথায় রাখতে হবে, গ্রামীণ নারীদের একটি বড় অংশ কখনোই ঘরের বাইরে অর্থ উপার্জনের জন্য যাবে না। সেবাদানে এবং পরিবারের স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও সার্বিক কল্যাণের জন্য এই নারীদের যে বড় ভূমিকা ও অবদান, তা অবশ্যই স্বীকার করতে হবে। তাদের অবদানকে রাষ্ট্রীয়ভাবে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিতে হবে। আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নারীদের যেসব গৃহস্থালি কাজের আর্থিক মূল্যায়ন হয় না, সেগুলোও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড হিসেবে বিবেচনা করতে ও জিডিপিতে যুক্ত করতে নির্দেশনা দিয়েছেন, যা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি পদক্ষেপ। আমরা একটি স্যাটেলাইট অ্যাকাউন্টস সিস্টেমের ধারণা নিয়ে আলোচনা করছি, যার মাধ্যমে নারীদের অবদানের আর্থিক মূল্যায়ন করা যাবে ও জিডিপির সমান্তরালে দেখাবে।
এত সব বাধা সত্ত্বেও কিছু সম্ভাবনাও আছে। সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে নারীদের প্রকৃত ক্ষমতায়নের এখনই সময়। ডিজিটাল বিশ্ব নারীদের সামনে নানা সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিয়েছে। প্রযুক্তির সাহায্যে নারীরা এখন বিভিন্ন ক্ষেত্রে সামনে এগিয়ে যেতে পারবে, যা কয়েক বছর আগেও সম্ভব ছিল না। ডিজিটাল বিভিন্ন সেবা এখন সহজে পাওয়া যায় এবং নারীদের তথ্যপ্রযুক্তির সঙ্গে যুক্ত হতে হবে। বর্তমানে প্রচুর নারী উদ্যোক্তা তৈরি হয়েছে। হাজারো নারী এখন ঘরে বসেই নানা রকম ব্যবসা পরিচালনা করছে এবং তাদের কাজের আরও প্রসার দরকার। ব্যাংকিং ব্যবস্থা আগের চেয়ে অনেক জেন্ডার সংবেদনশীল হয়েছে এবং নারীরা যেন ঋণ নিয়ে নিজেদের ব্যবসা শুরু করতে উৎসাহিত হতে পারে, এমন সব স্কিম চালু করেছে। নারীদের জাতীয় ফুটবল ও ক্রিকেট দলের সাফল্য তরুণদের খেলাধুলার প্রতি উৎসাহ দিচ্ছে এবং এ বিষয়ে পরিবারেরও মনোভাব বদলাচ্ছে। সারাদেশের সরকারি স্কুলগুলো মার্শাল আর্ট ও বিভিন্ন খেলায় মেয়েদের প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু করেছে।
পরিশেষে বলা যায়, প্রকৃত ক্ষমতায়ন তখনই হবে, যখন নারী-পুরুষ উভয়ই সমতায় বিশ্বাস করবে এবং সে অনুযায়ী কাজ করবে। প্রায় এক শতাব্দী আগে আমাদের প্রিয় জাতীয় কবি বলেছিলেন, ‘বিশ্বে যা-কিছু মহান সৃষ্টি, চির-কল্যাণকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।’ আমাদের স্বপ্নের আধুনিক, প্রগতিশীল ও সমৃদ্ধ সোনার বাংলা গড়তে হলে সমতা ও সামাজিক ন্যায্যতার ভিত্তিতে একটি সমাজ তৈরি করতে হবে এবং এর জন্য চাই নারী-পুরুষের সমান অংশগ্রহণ।
লেখক: নির্বাহী পরিচালক, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন
- বিষয় :
- নারীদে
- শাহীন আনাম
- প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী-২০২৩