ঢাকা রবিবার, ০৬ জুলাই ২০২৫

এসির বাজার দ্রুত বাড়ছে

এসির বাজার দ্রুত বাড়ছে

প্রতীকী ছবি

জসিম উদ্দিন বাদল

প্রকাশ: ১৯ মে ২০২৪ | ২৩:৫৯

জলবায়ু পরিবর্তনসহ নানা কারণে বাড়ছে তাপমাত্রা। বিগত বছরগুলোর তুলনায় এবার তাপপ্রবাহ বেশি। অসহনীয় গরমে দুর্বিষহ হয়ে উঠছে জনজীবন। তাপদাহ থেকে স্বস্তি পেতে মানুষ ছুটছে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের (এসি) দোকানে। বিলাসী পণ্য থেকে এখন প্রয়োজনীয় পণ্যের তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে এ পণ্য। এতে বিশাল চাহিদা তৈরি হচ্ছে এসির। একসময় শুধু অফিস-আদালত ও শপিংমলে এসির ব্যবহার দেখা যেত। এখন শহরের বেশির ভাগ বাসাবাড়িতেই ব্যবহার হচ্ছে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণের যন্ত্রটি। দিন দিন চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় দ্রুত বাড়ছে এসির বাজার। বছরে এসি বিক্রি হয় ছয় হাজার কোটি টাকার। আমদানিনির্ভরতা কাটিয়ে দেশে উৎপাদিত এসি এখন রপ্তানিও হচ্ছে।

খাত-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকারের নীতি-সহায়তার কারণে চাহিদার বেশির ভাগ এসি দেশেই উৎপাদিত হচ্ছে। তবে দীর্ঘ মেয়াদে করছাড়সহ বিনিয়োগবান্ধব বিভিন্ন নীতি নিলে এসি হতে পারে সম্ভাবনাময় রপ্তানি পণ্য। বর্তমানে দেশে ব্যবহৃত এসির প্রায় ৯০ শতাংশ এখন স্থানীয়ভাবে উৎপাদন হয়। বাকিটা আমদানি করা হয়। সরকার প্রয়োজনীয় সুবিধা দিলে আমদানির দরকার হবে না।

ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইর সিনিয়র সহসভাপতি মো. আমীন হেলালী সমকালকে বলেন, ‘অনেকেই বলে থাকেন, দেশে ইলেকট্রনিকস পণ্যের ব্যবহার বাড়ার কারণে বিদ্যুতের চাহিদা বাড়ছে। এটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। বিদ্যুতের চাহিদা বাড়লে উৎপাদন বাড়াতে হবে। কিন্তু সে জন্য তো ইলেকট্রনিকস খাতে সুযোগ-সুবিধা কমানোর প্রসঙ্গ আসতে পারে না।’
তাঁর মতে, ‘এ খাতে প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা অব্যাহত রাখতে হবে। এর ফলে এসব পণ্য হবে আরও সহজলভ্য। একই সঙ্গে বাড়বে দেশের রপ্তানি আয়ের আকার।’

বেচাকেনা কেমন
বাংলাদেশ এয়ারকন্ডিশনিং ইকুইপমেন্ট ইম্পোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বারিয়া) তথ্য অনুসারে, ২০২০ সালে দেশে বছরে প্রায় তিন লাখ ইউনিট এসি বিক্রি হয়েছিল। চার বছরে এর পরিমাণ দ্বিগুণ বেড়ে পৌঁছেছে প্রায় সাড়ে ছয় লাখ ইউনিটে। প্রতিবছর প্রবৃদ্ধির হার ২০ শতাংশের বেশি। বর্তমানে দেশে যেসব এসি কেনাবেচা হচ্ছে, সেগুলোর বেশির ভাগ দেশে উৎপাদিত। কোনো কোনো কোম্পানি যন্ত্রপাতি এনে বাংলাদেশে সংযোজন করে।
বিদেশি এসির মধ্যে শীর্ষস্থানীয় ব্র্যান্ড চীনা নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ‘গ্রি’। এই ব্র্যান্ডের এসি এখন বাংলাদেশে স্থানীয়ভাবে দেশীয় কোম্পানি ইলেক্ট্রোমার্ট উৎপাদন করে। দেশি ব্র্যান্ডের মধ্যে শীর্ষে আছে ওয়ালটন। উল্লেখযোগ্য ব্র্যান্ডের মধ্যে রয়েছে সিঙ্গার, জেনারেল, ভিশন, স্যামসাং, এলজি, ইকো প্লাস, বাটারফ্লাই, যমুনা, হিটাচি, প্যানাসনিক, ওরিয়ন ইত্যাদি। সম্প্রতি বিদেশি ব্র্যান্ড হাইসেন্স প্রবেশ করেছে দেশের বাজারে।

এক বছরে ব্যবহার বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০২৩ সালে প্রকাশিত স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিস্টিকসের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২ সালে দেশের ১ দশমিক ৭৪ শতাংশ পরিবারে (খানা) এসির ব্যবহার ছিল। এক বছরের ব্যবধানে এর পরিমাণ প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। ২০২৩ সালে এসির ব্যবহার বেড়ে দাঁড়ায় ২ দশমিক ২৮ শতাংশে। দেশে খানার সংখ্যা এখন প্রায় ৪ কোটি ১০ লাখ। এ খাতের ব্যবসায়ীরা বলছেন, বর্তমানে যে সাড়ে ছয় লাখ ইউনিট এসি বিক্রি হচ্ছে, এর বাজারমূল্য ছয় হাজার কোটি টাকার বেশি।
এ খাতের উদ্যোক্তারা জানান, দ্রুত চাহিদা বাড়ার কারণে গত বছরের এ সময়ের তুলনায় এবার এসির বিক্রি বেড়েছে ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশ। বিভিন্ন কোম্পানি এসি বিক্রির ক্ষেত্রে ইএমআই, সহজ কিস্তি, ফ্রি ইনস্টলেশনসহ বিভিন্ন সুবিধা দিচ্ছে। এ কারণে গ্রাহকদের এসি কেনায় আগ্রহ বাড়ছে। তবে ডলারের দাম বাড়ার কারণে এসির কাঁচামাল আমদানিতে ব্যয় বেড়েছে। এতে বেড়েছে উৎপাদন ব্যয়। ফলে চলতি বছর ৫ থেকে ১০ শতাংশ বেড়েছে এসির দাম। যদিও কোনো কোনো কোম্পানির দাবি, তারা দাম বাড়ায়নি।

বাজেটে যেসব সহায়তা চান উদ্যোক্তারা
উৎপাদনকারীরা জানান, একসময় এসির চাহিদার পুরোটাই আসত বিদেশ থেকে। আমদানিনির্ভর এখন স্থানীয় উৎপাদননির্ভরতায় চলে এসেছে। পাশাপাশি রপ্তানির মাধ্যমে অর্জিত হচ্ছে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা। এটি সম্ভব হয়েছে সরকারের শিল্পবান্ধব নীতি-সহায়তার সুবাদে। সরকার এক দশকের বেশি সময় ধরে এ খাতের উন্নয়নে নানা সহযোগিতা দিচ্ছে। যেমন– ২০২৪ সাল পর্যন্ত এ খাতে কর অব্যাহতি সুবিধা রয়েছে। অনেকে এ জন্য উৎপাদনমুখী কারখানা স্থাপন করেছে। কর অব্যাহতি সুবিধার মেয়াদ ২০৩৫ সাল পর্যন্ত বাড়ানো দরকার। তাহলে ইলেকট্রনিক পণ্যের বাজার আরও বেশি বিকশিত হবে। যে কোনো বিনিয়োগ নীতি প্রণয়ন করলে তা দীর্ঘ মেয়াদে করা উচিত। স্বল্পমেয়াদি নীতি হলে সেটি আবার কখন বন্ধ হয়ে যায়– এ ধরনের শঙ্কায় থাকেন বিনিয়োগকারীরা। ফলে বিনিয়োগে গতি থাকে না। কারণ, যে কোনো কারখানা স্থাপনের পর তা থেকে মুনাফা পেতে ১০ থেকে ১৫ বছর লেগে যায়। এ ছাড়া শিল্পে কাঁচামাল ও খুচরা যন্ত্রাংশ আমদানির ক্ষেত্রে দ্রুত এলসিপ্রাপ্তির নিশ্চয়তা, একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ভর্তুকি মূল্যে বিদ্যুৎ, গ্যাস ও ডিজেল সরবরাহ করার ব্যবস্থা করা দরকার।

ওয়ালটন এসির চিফ বিজনেস অফিসার মো. তানভীর রহমান সমকালকে বলেন, এ শিল্পের আরও দ্রুত বিকাশে বিদ্যমান নীতি-সহায়তা অব্যাহত রাখা জরুরি। একই সঙ্গে নীতিগত কিছু পরিবর্তনও দরকার, যেমন– বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী পণ্য উৎপাদনে আরও বেশি প্রণোদনা দেওয়া দরকার। ওয়ালটনের মাধ্যমে বাংলাদেশ বিশ্বের ভিআরএফ ও চিলার কমার্শিয়াল এসি উৎপাদনকারী নবম দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। কিন্তু এখনও ভিআরএফের মতো উচ্চ প্রযুক্তির এসির কিছু কিছু কাঁচামাল আমদানিতে উচ্চ হারে শুল্ক দিতে হচ্ছে।
স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে উদ্যোক্তারা এখন রপ্তানি বাজার সম্প্রসারণে কাজ করছেন উল্লেখ করে ওয়ালটনের এ কর্মকর্তা বলেন, বর্তমানে ওয়ালটনের এসি এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হচ্ছে। এ ছাড়া ইউরোপ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়াসহ উন্নত দেশগুলোতে রপ্তানি বাজার সম্প্রসারণের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।

ইলেক্ট্রোমার্ট গ্রুপের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক মো নুরুল আফছার বলেন, কয়েক বছর ধরেই চাহিদা বাড়ছে। গত বছরের তুলনায় এ বছর বিক্রি আরও বেশি। তাই এ খাতের বাজারের প্রসারের জন্য ভ্যাট-ট্যাক্স অব্যাহতির সুবিধা দীর্ঘ মেয়াদে ২০৩৫ সাল পর্যন্ত বাড়তে হবে। পাশাপাশি রাজস্ব বিভাগকে আরও বেশি ব্যবসাবান্ধব নীতি প্রণয়ন করতে হবে।
গরমে এবার এসির চাহিদা ৪৫ থেকে ৫০ শতাংশ বেড়েছে বলে মনে করেন মিনিস্টার-মাইওয়ান গ্রুপের হেড অব ব্র্যান্ড অ্যান্ড কমিউনিকেশন সোহেল কিবরিয়া। তিনি বলেন, স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় তাদের এসি বিক্রি বেড়েছে ৩৫ শতাংশ পর্যন্ত। মিনিস্টার দাম বাড়ায়নি বলে তিনি উল্লেখ করেন।

 

আরও পড়ুন

×