ঢাকা শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫

‘সন্তানদের স্যানিটেশন কর্মী বানাতে চাই না’

‘সন্তানদের স্যানিটেশন কর্মী বানাতে চাই না’

ফাইল ছবি

তানজীম আহমেদ, বাগেরহাট 

প্রকাশ: ৩১ ডিসেম্বর ২০২৪ | ০১:২৮ | আপডেট: ৩১ ডিসেম্বর ২০২৪ | ০৭:১৭

৩৫ বছর বয়সী আকাশ খান, এগারো বছর আগে জীবিকার তাগিদে ঢাকা থেকে আসেন বাগেরহাটে। পেটের দায়ে ভ্যান চালানো, সবজি বিক্রি, গবাদি পশু পালন– কী করেননি তিনি। তবে কোথাও থিতু হতে না পেরে বছর দুয়েক আগে ঢাকা থেকে বাগেরহাটে ফিরে গিয়ে পৌরসভার স্যানিটেশন কর্মী হিসেবে কাজ শুরু করেন। ভেবেছিলেন এখানে এ কাজে স্থায়ী হতে পারলে খাওয়া–পরা নিয়ে আর চিন্তা করতে হবে না। কিন্তু কপালে চিন্তার ভাঁজ আর নির্ঘুম রাত এখন তার নিত্যসঙ্গী।

শিপন হেলা। ২৬ বছর বয়সী এই যুবক সম্প্রতি বিয়ে করেছেন। পৌরসভার স্যানিটেশনকর্মী হিসেবে কাজ করছেন পাঁচ বছর ধরে। দিনে প্রায় আট ঘণ্টা স্যানিটেশনর কাজ করে দৈনিক বেতন মাত্র একশ টাকা! এ বেতনও বন্ধ পাঁচ মাস ধরে। বাধ্য হয়ে মাস দুয়েক আগে জেলা হাসপাতালে কাজ নিয়েছেন।

৬০ বছর বয়সী আব্দুল আজিজ। চার সদস্যের পরিবারের ভরণপোষণের দায়িত্ব তাঁর কাঁধে। ১৭ বছর পৌরসভার নৈশ প্রহরী হিসেবে কাজ করেছেন। এরপরে দায়িত্ব পান শহরসংলগ্ন মাঝিডাঙ্গা এলাকায় ময়লা ফেলানোর নির্ধারিত স্থান দেখভালের। বয়স্ক এই ব্যক্তির বিকল্প আয়ের উপায় না থাকায় সাড়ে তিন হাজার টাকা বেতনেই কাজ করে যাচ্ছেন তিনি। তার বেতনও বন্ধ পাঁচ মাস ধরে।

ওপরে উল্লিখিত তিনজন আলাদা ব্যক্তির সুখ-দুঃখের ভিন্ন ভিন্ন গল্প থাকলেও জীবনের গল্পটা এখন একটি নির্দিষ্ট রেখায় আটকে গেছে। শহর পরিচ্ছন্ন করে সাজিয়ে রাখলেও অর্থাভাবে নিজেদের জীবন সাজাতে পারছেন না তারা। পাঁচ মাস ধরে সবারই বেতন বন্ধ, খেয়ে না খেয়ে দিন কাটছে পরিবারগুলোর। বেতনের জন্য ঘুরতে ঘুরতে টাকার পরিবর্তে বাড়ছে  হতাশায়।

আকাশ খান বলেন, ছোট দুই সন্তান আর স্ত্রীকে নিয়ে পিসি কলেজের পেছনে ছোট একটা ঘর ভাড়া নিয়ে থাকি। খুব ভোরে শহরের ময়লা সাফ করতে বের হই। কাজ শেষে ফিরতে ফিরতে দুপুর হয়ে যায়। এরমধ্যে কত মানুষের কথা শুনতে হয় তার ঠিক নেই। সাম্প্রতিক এক অভিজ্ঞতার কথা ব্যক্ত করে তিনি বলেন, মানুষ ময়লা ইচ্ছা করে নির্দিষ্ট জায়গায় না রেখে ড্রেনে ফেলে দেয়। নিষেধ করলে উল্টো মারতে আসে। দিন দশেক আগে শহরের হাড়িখালি বটতলায় স্থানীয়দের ড্রেনে ময়লা ফেলতে নিষেধ করায় তোফাজ্জেল নামের একজন আমাকে মারধর করে। আমাদের শরীরে আঘাত করা যায়, গালিগালাজ করা যায়, যখন-তখন চড়থাপ্পড় মারা যায়। এর তো কোনো বিচার নেই! নিজের জীবনের হিসাব-নিকাশ মেলাতে না পারা আকাশ স্বপ্ন দেখেন তাঁর সন্তানদের উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হবে। স্বপ্ন দেখেন সন্তানদের ভালো স্কুলে পড়ানোর। তবে আকাশের এই স্বপ্ন পূরণে রাষ্ট্র ও সমাজের সদিচ্ছা ও সহযোগিতা প্রয়োজন।

শিপন হেলার পরিবারের সদস্য সংখ্যা ছয়। বাবা-মা, ভাই-ভাবি এবং স্ত্রী। হরিজন সম্প্রদায়ের শিপন সরকারি জমিতে ঘর তুলে থাকেন। যৎসামান্য যে বেতন পেতেন তাও বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বাবা-ভাইয়ের আয়ের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে তাঁকে। শিপন বলেন, প্রায় পাঁচ বছর ধরে স্যানিটেশন কর্মী হিসেবে কাজ করছি। পৌরসভার তিন হাজার টাকা বেতনের পাশাপাশি মানুষের বাসা, ট্যাঙ্কি পরিষ্কার করে মাসে সাত-আট হাজার টাকা আয় হতো। পৌরসভার বেতন বন্ধ হওয়ার পরেও তিন মাস কাজ করেছি। পরে বাগেরহাট জেলা হাসপাতালে স্যানিটেশনর কাজ নিয়েছি। দিনের বেশিরভাগ সময় এই কাজে যায়। অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, আমাদের কাজের ক্ষেত্রে ন্যূনতম কোনো সুযোগ সুবিধা নেই। কাজ করতে গিয়ে হাত-পা কেটে আহত হতে হয়েছে বহুবার। প্রায় সময় কাঁচে, কাঁটায় হাত-পা কেটে যায়। পায়ে লোহা ঢুকে যায়। কখনো তার জন্য পৌর কর্তৃপক্ষ কোনো চিকিৎসার খরচ বা নিরাপত্তার জন্য গামবুট, এপ্রন বা গ্লাভস দেয় না। রাতের বেলায় কাজ করতে গিয়ে নিরাপত্তাহীনতার কথা জানান শিপন।

অধিকাংশ মানুষ এটিকে সব পেশার মতো ভালো ভাবেই দেখেন। এক সময় সমাজের কটু কথা শুনতে হলেও সেই চিত্র এখন অনেকাংশে বদলেছে। এক দিনের জন্যও ছুটি পান না জানিয়ে শিপন আরও বলেন, কখনও অসুস্থ বা জরুরি প্রয়োজনে কোথাও যেতে হলে ছুটি মেলে না। যদি স্যারদের কাছে ছুটি চাই, তাহলে কাজের জন্য আরেকজন লোক দিয়ে যেতে হয়। তখন অফ ডিউটিতে থাকা কারও সহযোগিতা নিই। আবার অনেক সময় সেটা সম্ভব হয় না, অসুস্থ শরীরেও কাজ করতে হয়। নিজে এই পেশায় থাকলেও ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে কোনোভাবেই এই কাজে আনতে চান না তিনি। নতুন সরকারের কাছে পরিশ্রম অনুযায়ী বেতন, মাথাগোঁজার নির্দিষ্ট স্থান, চিকিৎসা সেবা, আর্থিক ও সামাজিক নিরাপত্তার দাবি তাঁর।

দুই ছেলে ও স্ত্রীকে নিয়ে চার সদস্যের পরিবার আব্দুল আজিজের। ছেলেদের যেনো ভুল করেও তার পেশায় না আসতে হয় সেজন্য অনাহারে থেকেও পড়াশোনা করাচ্ছেন। তিনি চান বকেয়া বেতন পরিশোধ করা হোক,  প্রতিমাসে নিয়মিত যেন বেতনটা পান। আর বেতনটা যেন দ্রব্যমূল্যের সঙ্গে সমন্বয় করে বাড়ে।  একই সঙ্গে  সন্তানদের উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করতে সরকারের সহযোগিতা, অসুস্থ হলে নিজেদের চিকিৎসা সহায়তা এবং বেতনের সাথে প্রভিডেন্ট ফান্ড চালুর প্রত্যাশা তাঁর।  
ফলে ময়লা ফেলা নিয়েও বিপাকে পড়তে হয় স্যানিটেশন কর্মীদের, আর দুর্গন্ধে নাকাল অবস্থা স্থানীয়দের।

স্যানিটেশন কর্মীরা মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে রয়েছে জানিয়ে বাগেরহাট সদর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা প্রদীপ কুমার বকশী বলেন, প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ছাড়া ময়লা-আবর্জনা সংগ্রহ, দিনের পর দিন সরাসরি এসবের সংস্পর্শে থাকতে থাকতে তারা চর্মরোগ, পেটের পীড়া, ক্ষুধামান্দ্যসহ নানা ঝুঁকিতে পড়ছেন। তাদের থেকে পরিবারের অন্য সদস্যরা আক্রান্ত হচ্ছেন। ফলে সমাজের একটি শ্রেণি ক্রমাগত পিছিয়ে পড়ছে।

আরও পড়ুন

×