‘কষ্ট বলে লাভ কী! কষ্টের সঙ্গে-ই বসবাস’

টাঙ্গাইলের সখীপুর পৌরসভার ৮ নম্বর ওয়ার্ডের স্যানিটেশন কর্মীরা
এনামুল হক ও আমিরুল হক, সখীপুর (টাঙ্গাইল)
প্রকাশ: ৩১ ডিসেম্বর ২০২৪ | ০১:৩৪ | আপডেট: ৩১ ডিসেম্বর ২০২৪ | ০৭:০৪
পরিবারের নয় ভাই-বোনের মধ্যে আটজনই স্যানিটেশন কর্মী। তারা সবাই বাসফোর (মেথর)। অনেকের রয়েছে অতিরিক্ত অভিজ্ঞতা। দু’জন ময়লা বহনকারী ট্রাকের চালক। তাদের বাবা গণেশ বাসফোর ও দাদা বানেশ্বর বাসফোরও ছিলেন পয়ঃনিষ্কাশন ও স্যানিটেশন কর্মী। নয় ভাইবোনের বেশিরভাগ সন্তানরাও যুক্ত হচ্ছেন একই পেশায়। তাদের মা পূর্ণিমা বাসফোরও একই পেশায় কর্মরত ছিলেন। টাঙ্গাইলের সখীপুর পৌরসভার আট নম্বর ওয়ার্ডে বসবাস তাদের। এখানেই তাদের বাবা গণেশ বাসফোর একখণ্ড জমি কিনে বসতি গড়েছিলেন। সেই ভিটেতেই সুখে-দুঃখে তারা একই সঙ্গে বসবাস করছেন। তারা মূলত সনাতন ধর্মাবলম্বীর হরিজন সম্প্রদায়ের নাগরিক।
কথা বলে জানা গেছে, আর্থিকভাবে পরিবারের কেউই সচ্ছল নয়। নুন আনতে পান্তা ফুরায় প্রতিটি পরিবারে। ভোর থেকে মধ্যরাত চলে তাদের কায়িক পরিশ্রম। এরপরও অনেকের পরিবারে তিন বেলা চুলা জ্বলে না। এক ঘরের ভেতর একাধিক পর্দার আড়ালে গাদাগাদি থাকতে হয় চার-পাঁচজনকে। বৃষ্টি নামলেই ঘরের চালের ফুটো চুয়ে ভেতরে জমে বৃষ্টির পানি। এ পেশায় নেই সামাজিক মূল্যায়ন, চাকরির স্থায়িত্ব, পরিচয় কার্ড, সাপ্তাহিক ছুটি, অসুস্থ ও ঝুঁকি ভাতা। তবুও ক্ষুধার তাড়নায় তাদের প্রতি মুহুর্তে জীবনযুদ্ধে লড়তে হচ্ছে। কয়েকটি হরিজন স্যানিটেশন কর্মীর পরিবারের জীবন-জীবিকার চিত্র এটি।
স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে সখীপুরে আসেন গণেশ বাঁশফোর ও তাঁর স্ত্রী পূর্ণিমা বাসফোর। ১৯৭৬ সালে থানা প্রতিষ্ঠার পর থেকেই সখীপুর বাজার ও হাটের ঝাঁড়ুদার ও মেথরের কাজ করতেন তারা। ওই সময় গাছের নিচে বা পরিত্যক্ত খুপরি ঘরে ছিল তাদের আবাসস্থল। পরে বাজার থেকে একটু দূরে একখণ্ড জমি কিনে স্থায়ী আবাসনের ব্যবস্থা করেন গণেশ বাসফোর। গণেশ ছিলেন তাঁর বাবা বানেশ্বর বাসফোরের উত্তরসূরি। গণেশের বাবা জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জের নান্দিনা গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন। পেটের তাগিদে ওই সময় গণেশ বাসফোর টাঙ্গাইলের সখীপুরে আসেন।
গণেশ বাসফোরের ছোট ছেলে কৃষ্ণ বাসফোর গত এক দশক আগে ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত হয়ে আলাদা সংসার করছেন। ওই সময় কৃষ্ণও স্যানিটেশন কর্মীর কাজ করতেন।
গণেশ বাসফোরের অন্য সন্তানরা হলেন বাদল, সজল, মুন্না, প্রদীপ, গোপাল, বাবু, সীমা ও দুলালী বাসফোর। গণেশের ছয় ছেলে ও দুই মেয়ে, মেয়ের জামাই ও তাদের সন্তানরা স্যানিটেশন কর্মী ও স্যানিটেশন সংশ্লিষ্ট পেশায় কর্মরত রয়েছেন। সীমা ও তার ছেলে অজয় এবং মেয়ে বোটন মির্জাপুরের গোড়াই এলাকায় ফ্যাক্টরিতে কর্মরত রয়েছেন। দুলালী ও তাঁর স্বামী গাজীপুরের কাশিপুরে একই পেশায় কাজ করছেন বলে তাদের পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে। গণেশের ছয় ছেলে ও তাদের ছেলে বউ, নাতি-নাতনিরা সখীপুরের বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আছেন। সব মিলিয়ে ওই বাসফোর পরিবারে বর্তমানে ২২-২৫ জন এ পেশায় কর্মরত রয়েছে।
গণেশ পরিবারের কেউই সরকারি চাকরি বা মাস্টাররোলে নিয়োগপ্রাপ্ত নন। তাই দৈনিক হাজিরায় কোনো কারণে একদিন কাজ না করলে ওই দিনের বেতন কর্তন করা হয়। তবে বাসফোরদের দাবি, এখন মুসলমানরা এ কাজে বেশি ঝুঁকে পড়ায় তাদের আয়ের পথ আগের চেয়ে সীমিত হয়ে গেছে। তাই ইচ্ছে থাকলেও সন্তানদের বিদ্যালয়ে পাঠানোর আগ্রহ নেই তাদের। বাড়িতেও পড়ার পরিবেশ নেই। ফলে ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও তাদেরও (সন্তান) একই পেশায় টানতে হচ্ছে।
সম্প্রতি কথা হয় ওই গোত্রের মুন্না বাসফোরের সঙ্গে। তিনি ইউএনওর কার্যালয় ও তাঁর বাংলোতে স্যানিটেশনর কাজ করেন। দৈনিক হাজিরায় তার বেতন হয়। ওই টাকায় তার সংসার চলে না। মাস শেষে তাঁর দোকানে বাকি রাখতে হয়। তিন সন্তানের মধ্যে বড় মেয়ে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে। প্রতি মাসে বিদ্যালয়ের বেতন দিতে হয়। তিন সন্তানসহ একটি ঘরে তাদের বসবাস। বৃষ্টি নামলেই ভেতরে পানি পড়ে। তিনি সরকারের কাছে তাদের কর্মস্থলের পরিচয়পত্রের দাবি জানান। যাতে দূরে কোথাও গিয়ে বিপদে পড়লে বা দুর্ঘটনায় মারা গেলে তাদের পরিচয় নিশ্চিত হতে পারে।
সখীপুর পৌরসভার স্যানিটেশন কর্মী ও ময়লা বহনকারী ট্রাক্টর চালক গোপাল বাসফোর জানান, দিনরাত পরিশ্রমের আয়ে কষ্টে সংসার চলে তাঁর। তিনি জানান, দরিদ্রদের জন্য সরকারের বিভিন্ন প্রকল্প বরাদ্দ থাকলেও এসবের কোনোটাই তাদের ভাগ্যে জোটে নাই। অসুস্থ হলেও তাদের জন্য বিশেষ কোনো চিকিৎসা সুবিধা নেই। তিনি তাদের প্রতি সরকারের সুনজর কামনা করেন। ছোট বোন দুলালী বাসফোর জানান, বাবার তো কোনো জমিজমা নেই। আলাদা সম্পদও নেই। তাই স্বামীর সংসারে এসেও জীবিকা চালাতে একই কর্মে যোগ দিতে হয়েছে।
- বিষয় :
- স্যানিটাইজার