চারজনের উপার্জনে প্রগতির পড়াশোনার যুদ্ধ

স্যানিটেশনকর্মী মিতা রানী
লতিফুল ইসলাম, ঢাকা
প্রকাশ: ৩১ ডিসেম্বর ২০২৪ | ০১:৩৭ | আপডেট: ৩১ ডিসেম্বর ২০২৪ | ০৭:০০
মিতা রানী (৪০) ও তাঁর বাবা বাইজু লাল (৬৫) দুইজনে সিটি করপোরেশনের স্যানিটেশন কর্মী। শুধু তারাই নন দুই শতাব্দী ধরে হরিজন গোষ্ঠীর এই মানুষেরা রাজধানীর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন কাজের দায়িত্বে। সরকারি প্রতিষ্ঠানে যাদের কাজের সুযোগ হয়নি তারাও বিভিন্ন বাসা-বাড়ির ময়লা সংগ্রহ বা পরিচ্ছন্নতার কাজ করেন। করপোরেশনের কর্তাদের ডাকে সকাল, দুপুর বা মধ্যরাতে কাজে যেতে হয় তাদের। কিন্তু এত পরিশ্রমের পরেও ভাগ্যের বিন্দুমাত্র পরিবর্তন হয়নি এই স্যানিটেশন কর্মীদের। কাজের নিরাপত্তাহীনতা, নিম্নমানের মজুরি আর আবাসন সংকটের মধ্যেও তাদের জীবন কাটে সবসময় আতঙ্কে। অস্থায়ী চাকরির কখন করপোরেশন থেকে চাকরি হারানোর নোটিশ আসে, মাথাগোঁজার ঠাঁইটুকু হারিয়ে যায়। এর মধ্যেও মিতা রানী স্বপ্ন দেখেন। স্বামী, দুই ছেলে আর নিজের সংগ্রামের উপার্জনে এসএসসি পড়ুয়া মেয়ে প্রগতি
রায় (১৬) একদিন পড়াশোনা শেষে বড় চাকরি করবে। সাধারণ মানুষের মতো তাদেরও নিজের ঘর হবে। সুখের সংসার কাটবে তাদের। সমকালের সাথে আলাপে নিজের যাপিতজীবন আর স্বপ্নের বর্ণনা দিয়েছেন তিনি।
মিতা রানী জানান, ক্লাস নাইনে পড়াশোনার সময় সংসারের হাল ধরতে তাঁর আর স্কুলে যাওয়া হয়নি। বাবা বাইজু লালের সাথেই করপোরেশনের স্যানিটেশন কর্মীর কাজে যোগ দেন। কিছুদিন পরেই মিরনজিল্লা হরিজনপল্লির বিবেক দাসের সাথে তাঁর বিয়ে হয়। বিবেক দাসও স্যানিটেশন কর্মী। তবে তিনি সরকারি কোনো প্রতিষ্ঠানে নয়, বাসা বাড়ির ময়লা সংগ্রহের কাজ করেন। অভাব অনটনের সংসারে দুই ছেলে অভিজিৎ (১৯) আর অমিতেরও (২৮) মায়ের মতোই নবম শ্রেনির পরে আর পড়াশোনা আগায়নি। সংসারকে সহযোগিতা করতে বাবা বিবেক দাসের সাথে তারাও বাসা-বাড়ির ময়লা সংগ্রহের কাজ করেন।
মিতা বলেন, ‘দিন নাই রাত নাই কাজ করি। যখন করপোরেশনের কঞ্জারভেন্সি ইন্সপেক্টর (সিআই)-এর ডাক পড়ে তখন কাজে চলে যাই। সকালে আসলে সন্ধ্যা পর্যন্ত। দুপুরে এলে মধ্যরাত। রাতে কাজ করলে ভোররাতে বাসায় যাই। স্বামী সন্তানও সকালে কাজে বের হয়। সবাই যে যার কাজে ব্যস্ত। এমনও দিন হয় যেদিন পরিবারের সব সদস্যের দিনে একবারের জন্যও দেখা হয় না। এরপরও সংসারে অভাব কাটে না। একমাত্র প্রগতি এবারে পুরান ঢাকার প্রভাতি আইডিয়াল স্কুলের নবম শ্রেনির ছাত্রী। মেয়ের স্কুলের বেতন ও পরীক্ষার ফি চারজন কাজ করেও দিতে পারি না।’
এ স্যানিটেশন কর্মী জানান, শুরুতে যখন কাজে যোগ দেই তখন বেতন ছিল পাঁচ হাজার টাকা। এখন বেতন আসে ১৭ হাজার টাকা। প্রতিদিন কাজ করতে হয়। ঝড়–বৃষ্টি–শীত কোনদিনও বাদ নেই। এছাড়া তো দেশে আন্দোলন সংগ্রাম আছে। আগুন জ্বালাও পোড়াও যাই হোক না কেন মাঠে যেতে হয় কাজে। কাজের চেয়েও যেন দায়িত্ববোধটাই বেশি। নগরীতে একদিন আমরা কাজ না করলে ময়লা আবর্জনায় ভাগাড়ের পরিস্থিতি তৈরি হবে সব জায়গায়। কিন্তু আমাদের ছুটি নেই। হাজিরা দিলেই বেতন না দিলে বেতন নাই। ঈদ পূজা পার্বনেও আমাদের কাজ করতে হয়। কিন্তু অন্যান্য সরকারি আর বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যেমন পূজা পার্বনে বোনাস ভাতা দেওয়া হয়। আমরা এসবের কিছুই পাই না। অসুখ বিসুখ হলে করপোরেশনের সিআইদের বলি তখন মানবিক কারণে তারা ছাড় দেন। কিন্তু হাজিরার খাতায় ঠিকই হাজিরা লিখতে হয়। আমরা চিকিৎসার কোনো ভাতা পাই না। আমাদের মধ্যে কেউ বড় কোনো রোগে আক্রান্ত হলে চিকিৎসা করতে পারি না। আবার কাউকে কোনো হাসপাতালে ভর্তি করালে আরেক বিপদ। হাসপাতালে মারা গেলে টাকার অভাবে ডাক্তাররা লাশ আটকে দেন। তখন আমরা কলোনির সবাই মিলে চাঁদা তুলে সে লাশ নিয়ে আসি।
এত হাড়ভাঙা পরিশ্রমের মধ্যে স্যানিটেশন কর্মীদের কাজের ঝুঁকি তো রয়েছেই। মধ্যরাতে সড়কে যখন ঝাড়ু দেন তখন বেপরোয়া গতির গাড়ি সড়কে সাঁইসাঁই করে চলে। একটু সতর্ক না থাকলে গাড়ির ধাক্কায় মৃত্যু নিশ্চিত। আবার কাজের সময় মাদকাসক্ত আর টোকাইদের উৎপাত তো আছেই। নারী হওয়ায় চ্যালেঞ্জ আর ঝুঁকিটা এক্ষেত্রে আরও বেশি। ছিনতাইয়ের সাথে নিজেকে রক্ষার যুদ্ধ করতে হয় রাস্তায়। মিতা রানী বলেন, ‘রাতে সড়কে কাজ করার সময় বেপরোয়া গাড়ি চললেও বাড়ি ফিরতে হয় হেঁটে। আসার সময় কোনো যানবাহন পাওয়া যায় না। এক্ষেত্রে অনেক ক্ষেত্রে দুর্ঘটনা ঘটে। কাজ করার সময় চোখের সামনে অনেকবার সড়ক দুর্ঘটনা দেখেছি। একদিন রাত তিনটার দিকে পুরান ঢাকার রায়সাহেব বাজারে এক বৃদ্ধ রাস্তা পার হচ্ছিলেন। একটি বেপরোয়া ট্রাক তাঁকে পিষে দিয়ে যায়। লোকটা সাথে সাথেই মারা যান। এসব দেখলে ভয় করে। আবার আরেকদিন ছোটবোনকে কাজে নিয়ে গেছিলাম। ছিনতাইকারীরা ছোটবোনের কানের দুল টান দিয়ে নিয়ে যায়। এ সময় বোনের দুলের সাথে কানও ছিঁড়ে গেছিল। তখন থেকে হাত, কান আর গলায় কোনো ধরনের অলংকার পরি না। আবার রাস্তার মধ্যে কুকুরের যন্ত্রণা তো আছেই। অনেক সময় কুকুরও কামড় দেয়। তখন কুকুরের কামড়ের টিকা দিতে গুনতে হয় টাকা। সে টাকাও পাই না আমরা।’
নারী হিসাবে স্যানিটেশন কর্মীদের কাজে রয়েছে আরও সমস্যা। ময়লা, আবর্জনা আর পয়োবর্জ্য পরিষ্কার করলেও সড়কে কাজ করার সময় প্রস্রাব-পায়খানা করার জন্য কোনো ব্যবস্থা নেই। করপোরেশন আর ওয়াটারএইডের যে টয়লেট আছে সেগুলো যেমন পর্যাপ্ত না তেমনি এসব টয়লেট সারারাত খোলাও থাকে না। আবার ইট পাথরের শহরে কারও বাসায় যাওয়ার সুযোগও নেই। মিতা বলেন, ‘মানুষের জন্য সারাজীবন কাজ করে যাই । কিন্তু নিজের প্রাকৃতিক প্রয়োজনের সময় কারও সাহায্য পাই না। আগের তুলনায় কমলেও এখনও অনেকেই হরিজন হিসাবে আমাদের অবজ্ঞা করেন। ছেলেমেয়ে স্কুলে গেলে অনেক অভিভাবক আমাদের সন্তানদের সাথে তাদের সন্তানদের মিশতে দেয় না। আমরা কোনো ব্যবসা বাণিজ্য করতে গেলে আমাদের যেমন পুঁজির সংকট আছে; তেমনি ব্যাংকও ঋণ দেয় না। সবচেয়ে বড় যে সমস্যা কেউ কোনো প্রতিষ্ঠান গড়ে তুললে সেখানে আবার কেউ কেনাকাটা করে না।’
এই নারী স্যানিটেশন কর্মী বলেন, ‘সিটি করপোরেশনে আমাদের চাকরি স্থায়ী নয়। তাই সবসময় চাকরি হারানোর ভয় থাকে। অনেকের নানান অজুহাতে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। দিন হাজিরার চাকরিতে তাই আমরা রোগে–শোকে বাধ্য হয়েই কাজ করি। আবার আমরা যে কলোনিতে থাকি সেটি নিয়েও শঙ্কা আছে। কিছুদিন আগেও সাবেক মেয়র এই কলোনি ভেঙে সেখানে মার্কেট করতে চেয়েছিলেন। তখন মনে হচ্ছিল খেতেই পারব না। এটি ভেঙে দিলে কোথায় গিয়ে উঠব। সর্বশেষ সদ্যপ্রয়াত স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা হাসান আরিফ আমাদের কলোনিতে গিয়েছিলেন। সেখানে তিনি আমাদের আশ্বস্ত করেন যে কলোনি ভাঙা হবে না। সেখানে আমরাই থাকব।’
নগরীর স্যানিটেশন যোদ্ধারা দিনশেষে চান তারাও ভালো থাকবেন। তাদেরও ঘর থাকবে।
মিতা রানী বলেন, ‘এখন কলোনির মধ্যে আমাদের ছয়–সাত হাত লম্বা–চওড়ার ঘর। এই ঘরে কোনোমতে একটি চৌকি। সেখানে আমি, ছোট ছেলে আর মেয়ে ঘুমাই। বড় ছেলে আর তাদের বাবা ঘুমায় চৌকির নিচের মেঝেতে। এই ঘরের মধ্যেই আমাদের সমস্ত সংসারের জিনিসপত্র থাকে। সরকার যদি আমাদের বেতন বাড়াতো, আমাদের মাথা গোঁজার জন্য ছোট্ট হলেও দুই রুমের ঘর দিত, হাসপাতালে আমাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করত, ছেলেমেয়েরদের পড়াশোনার জন্য স্কুল-কলেজে বিনা বেতনের ব্যবস্থা করত, তবে আমরাও ভালো থাকতাম। ছেলেমেয়ে নিয়ে শান্তিতে থাকতাম। দু’বেলা দুমুঠো ভালো খেতে পারতাম। ঈদ–পূজা–পার্বনে বোনাস ভাতা দিলে আমরাও উৎসবে নতুন কাপড় পরতাম। আমাদের জন্যও সরকারি ছুটি আর সাপ্তাহিক ছুটি থাকলে আমরাও বিশ্রাম নিতাম। আমরাও মানুষ হয়ে মানুষের মতো জীবনযাপন করতে পারতাম। মধ্যরাতে কাজ শেষে আমাদের যাতায়াত ব্যবস্থা থাকলে আমরা নিরাপত্তার সাথে ঘরে ফিরতে পারতাম।’
মিতা রানীর স্বপ্ন, ‘পরিবারের আমরা চারজন ময়লা পরিষ্কারের কাজ করি। আমি রাস্তা ঝাড়ু দেই। আমার স্বামী আর দুই ছেলে বাসা বাড়ির ময়লা সংগ্রহ করে। আমার মেয়েকে আমি এ কাজ করাব না। মেয়েকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন। মেয়ে পড়াশোনা করে অনেক বড় হবে। মেয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াবে। আমাদের সবার সংসারের হাল ধরবে। আমাদেরও ঘর হবে। আমরা আর দশজনের পরিবারের মতো করে ঘরে থাকব।’
- বিষয় :
- স্যানিটাইজার