কালের যাত্রা ২০২৫
নতুন দিনের ছাত্র রাজনীতি

আখতার হোসেন
আখতার হোসেন
প্রকাশ: ৩১ ডিসেম্বর ২০২৪ | ২২:৫৪ | আপডেট: ০১ জানুয়ারি ২০২৫ | ১৭:৫১
শিক্ষার্থীদের আবর্তন করে যে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয় সামগ্রিকভাবে সেটিকে আমরা ছাত্র রাজনীতি বলতে পারি। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে স্বাধীনতা-পূর্ব এবং স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে ছাত্র রাজনীতির ইতিবাচক ভূমিকার কথা আমরা জানি। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপট যখন আমরা খেয়াল করি, আমরা দেখি– ছাত্ররাই সে আন্দোলন সংঘটিত করেছে, ভাষার জন্য জীবন দিয়েছে এবং ভাষা আন্দোলন তারা সফল করেছে। এরপর ৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন, ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান এবং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধেও ছাত্রদের সক্রিয় অংশগ্রহণ আমরা দেখেছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সারাদেশের বিভিন্ন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা মুক্তিযুদ্ধে জীবন দিয়েছে।
আমরা দেখি, একাত্তর-পরবর্তী সময়ে নব্বইয়ের যে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন, সেখানেও ছাত্ররাই সর্বাধিক ভূমিকা পালন করেছে। আবার ১/১১-এর সময়ে ছাত্রদের বলিষ্ঠ অবস্থানের মুখে সে সরকার পিছু হটতে বাধ্য হয়। আমরা আরও দেখি, ২০১৮ সালে শিক্ষার্থীরাই এ দেশে কোটা সংস্কার আন্দোলন শুরু করে। সে বছরই তুলনামূলকভাবে কিশোর শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে নিরাপদ সড়ক আন্দোলন হয় এবং বর্তমানে আমরা যে ফ্যাসিবাদমুক্ত অবস্থায় উত্তীর্ণ হতে পেরেছি, তার পেছনে ছাত্রনেতৃত্ব সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
ইতিবাচকতার দিক থেকে ছাত্র-সংশ্লিষ্ট, ছাত্রদের দ্বারা সংগঠিত, ছাত্রদের নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত হওয়া ইতিহাসের বড় বড় সংগ্রামের ঘটনাগুলোতে বাংলাদেশের ছাত্রদের মধ্য থেকে যারা রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় এবং বিভিন্ন সময় ত্যাগের মহিমায় নিজেদের উত্তীর্ণ করতে পেরেছেন, তাদের প্রতি আমাদের অশেষ শ্রদ্ধা রয়েছে।
সব মিলিয়ে কাঠামোগত ছাত্র রাজনীতি, দলীয় ছাত্র রাজনীতি নিয়ে বিগত বছরগুলোতে বাংলাদেশে শিক্ষার্থীদের এবং জনমানুষের অভিজ্ঞতা সুখকর নয়। কিন্তু সামগ্রিকভাবে ছাত্ররা ন্যায্য অধিকার আদায়ে রাস্তায় দাঁড়িয়েছে, মানুষের পক্ষে তাদের কণ্ঠ উঁচু করেছে, জীবন দিতে অগ্রগামী হয়েছে। তবে ছাত্র রাজনীতি বলতে মূলত বোঝায়, শিক্ষার্থীদের দ্বারা পরিচালিত শিক্ষার্থীদের স্বার্থকে কেন্দ্র করে শিক্ষার্থীদের মধ্যে চর্চা হওয়া রাজনৈতিক পথপরিক্রমা, রাজনৈতিক কর্মশালা, রাজনৈতিক কার্যক্রমের সমষ্টি। কিন্তু আমরা জনমানুষের মধ্যে ছাত্র রাজনীতির বিষয়ে একধরনের নেতিবাচক রূপায়ণ দেখতে পাই। টেন্ডারবাজি, গেস্টরুম, গণরুম, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, মারধর, ক্যাম্পাসে দখলদারিত্ব– এই বিষয়গুলো ছাত্র রাজনীতির একটা ভয়াল রূপ হিসেবে মানুষের সামনে হাজির হয়েছে।
ছাত্র রাজনীতির যখন প্রশ্ন আসে, তখন আমরা বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠনের দেখা পাই– ছাত্রলীগ, ছাত্রদল, ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্রশিবির; এ রকম বেশ কিছু ছাত্র রাজনৈতিক সংগঠন বাংলাদেশে কার্যক্রম পরিচালনা করছে। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে আমরা দেখেছি– যে সরকার যখন ক্ষমতায়, তাদের ছাত্র সংগঠন ক্যাম্পাসে একাধিপত্য তৈরির সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছে। আমরা এটাও দেখি, ১৬ বছর ধরে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ ক্যাম্পাসগুলোতে ছাত্রলীগ ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গেস্টরুম কালচার, জোরপূর্বক প্রোগ্রামে নিয়ে যাওয়া; কোনো নেতার বিরুদ্ধে কেউ অবস্থান নিলে, এমনকি ফেসবুক পোস্টের জন্যও তাকে ‘শাস্তি’র মুখে পড়তে হতো।
ছাত্র রাজনীতির সবচেয়ে ভয়াবহ রূপ আমরা দেখেছি বুয়েটে আবরার ফাহাদ হত্যার মধ্য দিয়ে; যার পরিপ্রেক্ষিতে বুয়েটে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হলো এবং যখন জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান চলছিল, তখনও শিক্ষার্থীরা ৯ দফায় লেজুড়বৃত্তিক ছাত্র রাজনীতি বন্ধের দাবি জানিয়েছিল। আসলে শিক্ষার্থীরা ছাত্র রাজনীতির নামে যে অপকর্ম এবং অপরাধ হয়ে আসছে, তার বিরোধিতা করেছে এবং যেহেতু সে অপকর্মগুলো ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব হচ্ছে না তাই তারা ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধের আলাপ জোরালো করেছে। প্রসঙ্গত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রশাসনের নির্লিপ্ত ভূমিকা অত্যন্ত হতাশার। যদি প্রশাসন তাদের দায়িত্ব পালন করে, তাহলে ছাত্র রাজনীতির নামে এভাবে অপকর্ম সম্ভব নয়।
শিক্ষার্থীরা কারও অধীন থাকতে চায় না এবং কোনোভাবেই নিজেদের বন্দিত্বের মধ্যে ফেলতে চায় না। নিজেদের স্বাধীন এবং মুক্তভাবে চলতে পারার আকাঙ্ক্ষা থেকে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধের আলাপ উঠিয়েছে। এ জায়গায় আমার কাছে মনে হয় যে, ছাত্র রাজনীতি যখন বুয়েটে বন্ধ করা হলো, তারপর আমরা দেখেছি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন বিভিন্ন বিষয়ে আমরা প্রতিবাদী ভূমিকা পালন করেছিলাম; বুয়েটের শিক্ষার্থীরা সাধারণত সে প্রতিবাদী ভূমিকায় একটু দেরিতে উপস্থিত হতো। তাদের কাছে হয়তো মনে হতো, যে কোনো ধরনের প্রতিবাদী কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করাই ছাত্র রাজনীতি হিসেবে বিবেচিত হবে। এ কারণে তাদের শিক্ষাজীবনে ক্ষতির মুখে পড়তে হতে পারে।
যা-ই হোক, সামগ্রিকভাবে আমরা বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে শিক্ষার্থীদের অতীতের যে ভূমিকা, সে ভূমিকাকে মাথায় রেখে সামনের দিনে ছাত্র রাজনীতি পুরোপুরি নিষিদ্ধ করা, ছাত্রদের অ্যাক্টিভিজম বন্ধ করে দেওয়ার পক্ষপাতী হতে পারি না। বরং ছাত্র রাজনীতির ভবিষ্যৎ রূপায়ণ কেমন হবে, সে বিষয়ে আমাদের মনোযোগ দিতে পারি। আমরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র সংসদ আয়োজনের কথা বলতে পারি।
দীর্ঘ সময় থেকে বাংলাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ছাত্র সংসদ নেই। সে কারণে সেখানে শিক্ষার্থীবান্ধব ছাত্র রাজনীতি চর্চার জায়গাটা সংকুচিত হয়ে এসেছে। একই সঙ্গে শিক্ষার্থীদের অধিকার, দাবিদাওয়ার বিষয়ে তাদের বৈধ কোনো প্রতিনিধিত্বের জায়গা না থাকায় সংকটে পড়তে হয়েছে। আমরা দেখেছি, ২০১৯ সালে যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো তার অব্যবহিত পরের সময়টুকু ডাকসু নির্বাচন হওয়ার আগের সময় থেকে ভিন্নতর ছিল। ডাকসু নির্বাচনের পর বাক্স্বাধীনতা এবং অপরাপর শিক্ষার্থীদের রাজনৈতিক স্বাধীনতার দ্বার কিছুটা হলেও উন্মোচিত হওয়ার একটা সুযোগ তৈরি হয়েছিল। কিন্তু ডাকসুকে আবার বন্ধ করে সে সম্ভাবনা স্তিমিত করে দেওয়া হয়। সে জায়গায় আমার মনে হয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সারাদেশে সব বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলেজগুলোতে ছাত্র সংসদ নির্বাচন যদি সময়মতো অনুষ্ঠিত হয় সে ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীরা তাদের বৈধ প্রতিনিধিত্ব নির্বাচিত করতে পারবে এবং ক্যাম্পাসগুলোতে যে ধরনের ভয়াল রূপ আমরা দেখি তার থেকে শিক্ষার্থীদের মুক্ত থাকার পরিবেশ তৈরি হবে। এ জায়গায় একটা বড় প্রশ্ন দাঁড়িয়ে গেছে, ছাত্র রাজনীতি লেজুড়বৃত্তিক হবে কিনা। আমরা খেয়াল করে দেখি, জুলাই-আগস্টে আন্দোলনের পর প্রতিটি ছাত্র সংগঠন নিজেদের লেজুড়বৃত্তিহীন ছাত্র রাজনীতির অংশ হিসেবে দাবি করছে। এটা একটা ইতিবাচক দিক। কিন্তু এখন পর্যন্ত আমরা লেজুড়বৃত্তির যে ধারণা, তার বাইরে খুব অল্প ছাত্র সংগঠনকে সঠিকভাবে কার্যক্রম পরিচালিত করতে দেখছি। ফাদার বা মাদার অর্গানাইজেশনের লাঠিয়াল বাহিনী হিসেবে কাজ করার যে মানসিকতা, এখান থেকে তাদের বেরিয়ে আসতে হবে এবং সত্যিকার অর্থে শিক্ষার্থীর স্বার্থ, দেশের স্বার্থ, গবেষণা– এই বিষয়গুলোতে মনোযোগী হতে হবে।
আমরা নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের সময়ে এবং আগেকার সময়গুলোতে দেখেছি, ক্রিয়াশীল যে ছাত্র রাজনৈতিক সংগঠনগুলো আছে, তারা নিজেরা জোটবদ্ধ হয়ে দলীয় ব্যানারে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কর্মসূচি ঘোষণা করত এবং শিক্ষার্থীরা সে ডাকে সাড়া দিত। ছাত্র আন্দোলনগুলো সেভাবে পরিচালিত হতো। ২০১৮ সাল থেকে আমরা খেয়াল করি, সুনির্দিষ্ট কোনো ছাত্র রাজনৈতিক সংগঠনের ব্যানারে কোটা সংস্কার আন্দোলন, নিরাপদ সড়ক আন্দোলন সংঘটিত হয়নি।
বিগত বছরগুলোতে খুব সম্ভবত ছাত্র সংগঠনগুলো শিক্ষার্থীর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট না থেকে; বরং তাদের পিতৃ বা মাতৃ সংগঠনের কার্যক্রম পরিচালিত করতে বেশি ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েছিল। আমরা ২০২৪ সালে ছাত্র-জনতার যে অভ্যুত্থান দেখেছি, সেখানে ছাত্র সংগঠনগুলোর অংশগ্রহণ আমরা দেখেছি কিন্তু নেতৃত্বের বেলায় এককভাবে বা দলীয় ব্যানারে ছাত্র সংগঠনগুলোকে আমরা আসতে দেখিনি।
এটা একটি তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন হিসেবে আমাদের কাছে ধরা দেয় যে, ছাত্ররা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এবং বেশির ভাগ ছাত্রই দলীয় ছাত্র রাজনীতির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হতে চায় না। তারা হয়তো তাদের মতো করে ফ্রিল্যান্সার অ্যাক্টিভিস্ট হিসেবে মতামত ব্যক্ত করতে চায়। দলীয় বন্ধনে না থেকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে চায় এবং নিজেদের মধ্যে দলীয় ব্যানারের বাইরে এসে সংগঠিত হতে চায়। এই প্রবণতা আমরা এ সময়ে এসে খেয়াল করেছি।
এ বিষয়গুলো বিদ্যমান ছাত্র সংগঠনগুলোকে মাথায় রাখতে হবে এবং তাদের খুঁজে বের করতে হবে– কীভাবে তারা শিক্ষার্থীদের আস্থা অর্জন করবে। যেহেতু ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনগুলোকে দেখে শিক্ষার্থীরা একটা অনাস্থার জায়গায় চলে এসেছে– এই আস্থা ফিরিয়ে নিয়ে আসার জন্য প্রতিটি সংগঠনকে কাজে এবং কথায় প্রমাণ করতে হবে তারা আসলেই অপর কোনো রাজনৈতিক দলের লাঠিয়াল বাহিনী হিসেবে কাজ করছে না।
তারা শিক্ষার্থীদের অধিকার, গবেষণা, দেশীয় স্বার্থের বিষয়ে সোচ্চার ভূমিকা রাখবে। কোনোভাবেই ছাত্র রাজনীতির সাথে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডকে তারা যুক্ত করবে না। যদি এসবের ব্যত্যয় ঘটে সে ক্ষেত্রে তারা তাদের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। শুধু নিজের দলের কেউ হওয়ায় তার অন্যায় করার পরেও সেইফ করার প্রতিযোগিতা– সেখান থেকে বিরত থাকবে। আগামী দিনে ইতিবাচক ছাত্র রাজনীতির প্রয়োজনেই ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের এসব প্রতিশ্রুতি পালনে বদ্ধপরিকর থাকতে হবে।
লেখক: ডাকসুর সাবেক সমাজসেবা সম্পাদক ও সদস্য সচিব, জাতীয় নাগরিক কমিটি