ঢাকা রবিবার, ০৬ জুলাই ২০২৫

সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা

সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা

--

প্রকাশ: ২৬ অক্টোবর ২০২১ | ১২:০০

সাম্প্রদায়িক মনোবৃত্তির চূড়ান্ত পরিণতি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায়। একই এলাকাভুক্ত দুই সম্প্রদায়ের লোকদের পরস্পরবিরোধিতা ও তিক্ততা জান্তব এবং অস্বাভাবিক পর্যায়ে অবনমিত হলে তখনই সম্পূর্ণ হয় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার মানসিক প্রস্তুতি। এ অবস্থায় অনেক সাধারণ মানুষও লিপ্ত হয়। অস্বাভাবিক আচরণে। এ জন্যই সাধারণ জীবনযাত্রায় মানুষ ভালোমন্দ, সৎ-অসৎ এবং হিতাহিতের যে তারতম্য করে তার কোনোটিকেই দাঙ্গারত মানুষ আর রক্ষা করতে সক্ষম হয় না। মানুষের মধ্যে মনুষ্যত্বের হয় সম্পূর্ণ নিবৃত্তি। হিন্দু-মুসলমান অথবা শিখ যেই হোক না কেন, সাধারণ জীবনযাত্রারত মানুষের পক্ষে দাঙ্গার মানসিকতা স্বাভাবিক নয়। আদিম এবং জান্তব হিংস্রতা বহু সাধনায় অর্জিত মনুষ্যত্বকে অল্প সময়ের জন্য পরাভূত এবং বিধ্বস্ত করলেও সাধারণ মানুষ নিজেদের মনুষ্যত্বের এ পরাভবকে দীর্ঘস্থায়ী হতে দেয় না। তাদের প্রকৃতিই এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। ফলে অকস্মাৎ অসাম্প্রদায়িক হয়ে না উঠলেও তারা প্রকৃতিস্থ হয়। কাটিয়ে ওঠে দাঙ্গার উন্মত্ততা।
দুই
কিন্তু সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় মানুষ এমন উন্মত্ত হয় কেমন করে? এর উত্তর লাভের জন্য প্রয়োজন জনমত কীভাবে গঠিত হয় তার বিশ্নেষণ। জনমত গঠনের কতকগুলো প্রচলিত মাধ্যম আছে। যেমন সংবাদপত্র, সভা-সমিতি, বেতারযন্ত্র, টেলিভিশন, ইশতেহার এবং অন্যান্য প্রচারপত্র। যে কোনো নীতি অথবা কর্মপদ্ধতির সপক্ষে জনমতকে উপযুক্তভাবে গঠন করতে হলে এগুলোর সবগুলো না হলেও অন্তত কতকগুলোকে নিয়োগ ও নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজন অপরিহার্য। শুধু আমাদের ঘরের কাছাকাছি নয়, পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত দিবারাত্রি যা ঘটছে তার সংবাদ লাভের জন্য আমরা প্রচারমাধ্যমগুলোর, বিশেষত সংবাদপত্র এবং বেতারের ওপর নির্ভরশীল। যে কোনো ব্যাপারে জনমত গঠনের জন্য এই সংবাদ সরবরাহ প্রতিষ্ঠানগুলোর দায়িত্ব এবং গুরুত্ব সে জন্যেই খুব বেশি।
প্রচার মাধ্যমগুলো শুধু যে সংবাদ সরবরাহ করে তাই নয়, সংবাদের ব্যাখ্যা-বিশ্নেষণ করে জনমতকে নিজেদের প্রয়োজন অনুযায়ী গঠন ও চালনা করাও তাদের সাধারণ কার্যক্রমের অন্তর্গত। এজন্য জনমত যখন কোনো ব্যাপারে গঠিত হয়, তখন তার জন্য প্রচারযন্ত্রসমূহের দায়িত্বকে অস্বীকার করা চলে না। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম নেই। সেজন্য কোনো দেশে, প্রদেশে, শহরে অথবা পল্লি অঞ্চলে যখনই দাঙ্গার সূত্রপাত হয়, তখনই তার কার্যকারণ সূত্রের সন্ধানের জন্য প্রয়োজন জনমত গঠনকারী এই প্রচার যন্ত্রগুলোর প্রচারকার্যের বিশ্নেষণ। যেখানে এই প্রচারকার্যকে উপযুক্তভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয় সেখানে সাম্প্রদায়িকতা জনসাধারণের মধ্যে যতই প্রবল হোক মানুষকে সে মনোবৃত্তি দাঙ্গার পথে চালনা করে না। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা যেখানেই ঘটে সেখানে তাই সংবাদপত্র, বেতার, রাজনৈতিক সভা-সমিতি ইত্যাদির গুরুত্ব অনেক। কিছু সংখ্যক নিম্নচরিত্রের লোকজন ছাড়া সমাজের অধিকাংশ মানুষই এক্ষেত্রে শান্তিপ্রিয়। এই শান্তিপ্রিয় জনসাধারণের একাংশ হঠাৎ রক্তপাতের অথবা অন্যের সম্পত্তি নাশের নেশায় উন্মত্ত হয়ে উঠে না। তার জন্য প্রয়োজন হয় অনেকখানি মানসিক প্রস্তুতির। এ প্রস্তুতির সম্পূর্ণ দায়িত্ব তাদেরই যারা এই প্রচারযন্ত্রসমূহকে আংশিক অথবা সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ করে।
তিন
যে প্রচার মাধ্যমগুলোর উল্লেখ করা হলো সেগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করে কারা? এবং কোন স্বার্থের তারা প্রতিনিধি? সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার চরিত্রকে যথাযথভাবে বোঝার জন্য এ কথা জানা প্রয়োজন। আমাদের দেশের উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক দলগুলো এখন মোটামুটিভাবে মধ্যবিত্ত অর্থাৎ বুর্জোয়া স্বার্থের প্রতিনিধি। মধ্যবিত্তের মধ্যে অবশ্য অনেক স্তরভেদ আছে। কাজেই মধ্যবিত্তের প্রতিনিধিত্ব বলতে সব ক্ষেত্রে একই জিনিস বোঝায় না। কোনো কোনো রাজনৈতিক দলের মধ্যে নিম্ন মধ্যবিত্ত, কোনোটির মধ্যে মধ্য-মধ্যবিত্ত আবার কোনোটির মধ্যে হয়তো উচ্চ মধ্যবিত্তের প্রাধান্য। এজন্য সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ক্ষেত্রে সব রাজনৈতিক দলের অথবা মধ্যবিত্ত শ্রেণিভুক্ত লোকদের দায়িত্ব সমান থাকে না। তবে এ কথা বললে খুব বেশি ভুল হয় না যে, যেসব রাজনৈতিক দলের মধ্যে উচ্চ-মধ্যবিত্তের প্রাধান্য বেশি, দাঙ্গার দায়িত্বও তাদের সেই তুলনায় অধিকতর। কারণ বৃহত্তর দাঙ্গার মাধ্যমে সচেতনভাবে এবং পরিকল্পনা অনুযায়ী উচ্চবিত্তের স্বার্থকেই তারা পরিপুষ্ট করে। সারা পাক-ভারত উপমহাদেশের ক্ষেত্রেই এ কথা সাধারণভাবে প্রযোজ্য।
উচ্চ-মধ্যবিত্ত স্বার্থপ্রধান রাজনৈতিক দলগুলোই অধিকাংশ সংবাদপত্র এবং অন্যান্য প্রচার মাধ্যমের সমর্থক, মালিক এবং নিয়ন্তা। এজন্য এগুলোর মাধ্যমে শুধু দাঙ্গায় ক্ষেত্রেই নয়, জীবনের সব ক্ষেত্রেই উচ্চ-মধ্যবিত্ত স্বার্থ সূক্ষ্ণভাবে রক্ষার ব্যবস্থা হয়। এজন্যই দেখা যায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ক্ষেত্রে দেশের সব সংবাদপত্রের ভূমিকা এক হয় না, কোনো কোনো সংবাদপত্র হয়তো দাঙ্গা মনোবৃত্তির বিরোধিতা করে, কিন্তু জনমত গঠনে তাদের প্রভাব অন্যগুলোর তুলনায় থাকে অপেক্ষাকৃতভাবে অনেক দুর্বল।
চার
কিন্তু উচ্চ-মধ্যবিত্ত স্বার্থরক্ষার জন্য সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার প্রয়োজন কি? এর উত্তর খুব সহজ। এ প্রয়োজন হয় রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দ্বিবিধ কারণেই। দেশ শাসন এবং দেশের বিভিন্ন কার্য পরিচালনার ক্ষেত্রে উচ্চ-মধ্যবিত্ত শ্রেণিই তার আর্থিক শক্তির প্রতাপে সব থেকে প্রতিপত্তিশালী। এই প্রতিপত্তির মাধ্যমে তারা যা কিছু করে তার অধিকাংশই নিজেদের শ্রেণিস্বার্থ উদ্ধারের উদ্দেশ্যে। কিন্তু দেশের অগণিত জনসাধারণকে তাদের শাসন এবং শোষণের সত্যকার চরিত্র এবং তাৎপর্যকে বুঝতে না দেওয়া তাদের নিজেদের কাজকে সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার জন্য নিতান্ত প্রয়োজন। শুধু দুঃখ-দুর্দশার মধ্যে জীবনযাপন করলে এবং অন্যের দ্বারা শোষিত হলেই মানুষের মনে গণতান্ত্রিক এবং বৈপ্লবিক চেতনার সঞ্চার হয় না। এ চেতনার জন্য প্রয়োজন তারা যেভাবে এবং যাদের দ্বারা শোষিত হয় তার সম্পর্কেও উপযুক্তভাবে সচেতন এবং অবহিত হওয়া। সমাজ জীবনে এটা যাতে না ঘটে তার জন্য মধ্যবিত্ত বা বুর্জোয়া স্বার্থ সর্বদাই জাগ্রত ও সচেষ্ট থাকে। এজন্য বৃহত্তর রাজনৈতিক জীবনে মানুষ যাতে সুস্থ চিন্তার অবকাশ না পায় তার জন্য তারা ইচ্ছাকৃতভাবে সৃষ্টি করে চলে নানা বিভ্রান্তির জাল। অসাবধানী এবং বিশ্বাসপ্রবণ জনসাধারণ তার দ্বারা সহজেই হয় প্রতারিত এবং বিপথগামী।
বুর্জোয়া শ্রেণি সব সময়ে সচেষ্ট হয় নিজের স্বার্থের সঙ্গে সারাদেশের স্বার্থকে এক করে দেখতে। এ প্রচেষ্টায় তারা সাধারণত বিফল হয় না, কিন্তু কোনো কোনো ক্ষেত্রে অসুবিধার আশঙ্কা দেখা দিলে অথবা সত্যিকারের কোনো কোনো অসুবিধার সৃষ্টি হলে তখনই তারা চাতুর্যের সঙ্গে রচনা করে কোনো না কোনো রাজনৈতিক বিভ্রান্তি। আমাদের দেশের এই বিভ্রান্তিসমূহের মধ্যে সাম্প্রদায়িকতা এখন সর্বপ্রধান, সাপেক্ষা কার্যকরী এবং সর্বাপেক্ষা মারাত্মক।
সাম্প্রদায়িকতার মাধ্যমে বুর্জোয়া শ্রেণি চেষ্টা করে অন্যদের শ্রেণি-চেতনাকে বিনাশ করতে। স্বাধীনতাপূর্ব যুগে সাম্প্রদায়িকতার প্রয়োজন ছিল অন্য সম্প্রদায়ভুক্ত বুর্জোয়া প্রতিযোগিতা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য। কিন্তু স্বাধীনতা উত্তরকালে সাম্প্রদায়িকতার প্রয়োজন নিজেদের সম্প্রদায়বুক্ত নিম্নবিত্ত লোকদের শ্রেণি-চেতনার কণ্ঠরোধ করার জন্য। সম্প্রদায়গত বুর্জোয়া স্বার্থের প্রতিষ্ঠা এবং সম্প্রসারণ দুই ক্ষেত্রেই সাম্প্রদায়িকতার মুনাফা তাই পর্বতপ্রমাণ। এজন্য এ হাতিয়ার আজ পর্যন্ত সমগ্র পাক-ভারতীয় উপমহাদেশে বুর্জোয়া স্বার্থ উদ্ধার কার্যে ব্যবহারযোগ্য
সাম্প্রদায়িকতা
লেখক :বদরুদ্দীন উমর
প্রকাশক :হামিদা হোসেন
জনমৈত্রী প্রকাশন
প্রথম প্রকাশ :১৯৬৬

আরও পড়ুন

×