ঢাকা শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫

অনেক নতুন স্বপ্নের বীজ

অনেক নতুন স্বপ্নের বীজ

সালাহউদ্দিন লাভলু

প্রকাশ: ১৫ ডিসেম্বর ২০২১ | ১২:০০

স্বাধীনতার ৫০ বছর আমাদের জন্য একটি গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। ভাষার দাবিতে শুরু হয়েছিল বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন। তার শেষ পরিণতি হচ্ছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ ও আমাদের স্বাধীনতা। সারা পৃথিবীর ইতিহাসে বাংলাদেশের স্বাধীনতা একটি বড় ব্যাপার। স্বাধীনতার পর মঞ্চনাটক থেকে শুরু করে সিনেমা, নাটক, উপন্যাসসহ সব ক্ষেত্রে সোনালি ফসল ফলেছে। দারুণ একটি আলো পেয়েছি। যার ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশের শিল্প-সাহিত্যে সুন্দর কিছু সৃষ্টি পেয়েছি। এটি আমাদের উজ্জীবিত করেছিল। স্বাধীনতার আলোকে আমরা উজ্জীবিত হয়েছি নতুন বাংলাদেশ সৃষ্টির। আমাদের শিল্প ও সাহিত্য স্বাধীনতার আগে অবদমিত ছিল। আমরা মন খুলে কিছু প্রকাশ করতে পারতাম না। নানা বাধার পাহাড় পেরুতে হতো। এত সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও নাটক, সিনেমা ও সংগীতের ক্ষেত্রে অসাধারণ সৃষ্টি হয়েছে। স্বাধীনতার পর শিল্প-সাহিত্যের ক্ষেত্রে আমরা যে আশা করেছিলাম তার প্রতিফলন ওই সময়ের নতুন প্রজন্মের কাছ থেকে সেভাবে পাইনি।
এটা তাদের দোষ নয়। আমাদেরও চেষ্টার কমতি ছিল। আমরা পরবর্তী প্রজন্মকে বোধের জায়গায় যাওয়ার মতো করে তৈরি করতে পারিনি। অথবা নতুন প্রজন্ম এটি ফিল করে এগিয়ে আসেনি। সবকিছু মিলিয়ে আমাদের চাওয়া-পাওয়া, আশা-আকাঙ্ক্ষার জায়গায় কিছুটা শূন্যতা ছিল। পরবর্তীতে আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে অসাধারণ ব্যাপারও ছিল। বাংলাদেশের ৫০ বছর পর আমাদের নতুন প্রজন্মের কেউ কেউ চলচ্চিত্রকে আন্তর্জাতিক মাত্রায় নিয়ে গেছেন। খ্যাতিমান নির্মাতা তারেক মাসুদ এক সময় বাংলাদেশের চলচ্চিত্রকে বিশ্ব দরবারে তুলে ধরেছিলেন। তারপর দীর্ঘ বিরতি ছিল। এখন বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মের নির্মাতারা নিজেদের প্রমাণ করেছেন। এই তো কিছুদিনে আগে বিশ্বের মর্যাদাপূর্ণ চলচ্চিত্রের আসর কান চলচ্চিত্র উৎসবে তরুণ নির্মাতা আবদুল্লাহ মোহাম্মদ সাদের চলচ্চিত্র 'রেহানা মরিয়ম নূর' প্রদর্শিত হয়েছে। বিশ্বের সব চলচ্চিত্র বোদ্ধার প্রশংসা কুড়িয়েছে। এভাবে আরও অনেক নামিদামি চলচ্চিত্র উৎসবে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হচ্ছে। এসব চলচ্চিত্র নির্মাতারা পৃথিবীর বুকে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিকে উজ্জ্বল করছেন। তরুণ নির্মাতারা ক্রমেই এগিয়ে যাচ্ছেন। এটাই আমাদের আশান্বিত করে। বাংলাদেশের ক্রিকেট যে রকম সারাবিশ্বে বাংলাদেশকে চিনিয়েছে, সে রকম আমাদের চলচ্চিত্র সারা পৃথিবীর বুকে সম্মান অর্জন করছে। বাংলাদেশের একজন নাগরিক হিসেবে গৌরবান্বিত বোধ করি। তরুণ নির্মাতাদের জানাই স্যালুট। তাদের এই কাজ আমাদের দেশকে নতুন করে সামনে এনেছে। তাদের চলচ্চিত্র বিভিন্ন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে পুরস্কৃত হচ্ছে। আমাদের সংস্কৃতিকে তারা সারাবিশ্বের কাছে তুলে ধরেছেন। এটা অনেক বড় ব্যাপার। আমরা পারিনি। আমাদের তরুণ প্রজন্ম আমাদের সম্মানিত করেছে।


এটা যেমন একদিকে ধ্রুব তারার মতো সত্য, আবার অন্যদিকে গণভাবে যদি বলি সে ক্ষেত্রে সংগীত, নাট্যকলা, টেলিভিশন, চলচ্চিত্রে উদ্দীপনার জায়গায় একটু পিছিয়ে আছি। তবে আমি আশাবাদী মানুষ।
সৃষ্টিশীলতার জায়গায় ধীরে ধীরে হাঁটছি। আমাদের নতুন প্রজন্মও সেই পথে হাঁটছে। এটা আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি। আমাদের নাটকেরও কিন্তু গৌরব আছে। বাংলাভাষীসহ পৃথিবীর সব জায়গায় টেলিভিশন নাটক এক সময় বড় ব্যাপার ছিল। কাঙ্ক্ষিত বিষয়। তাদের একমাত্র বিনোদন ও শিকড়ের জায়গায় তারা টেলিভিশন নাটককে দেখতেন। এখনও প্রবাসী বাংলাদেশিরা তাই দেখেন। তারা আমাদের টিভি নাটক দেখেই বাংলাদেশকে অনুভব করেন। হৃদয়ে ধারণ করেন। এখানে তারা হারানো শৈশব ও নিজস্ব সংস্কৃতিকে খুঁজে পান। টেলিভিশন দেখে স্মৃতি হাতড়ে বেড়ান তারা। এখনও আমাদের টেলিভিশন নাটক কিন্তু সেই পর্যায়ে আছে। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে আমরা অনেক কিছু পেয়েছি। আবার অনেক হারিয়েছি। অর্জন-বিসর্জনের মধ্য দিয়েই পথ চলেছি। এরই মধ্যে অনেক নতুন স্বপ্ন তৈরি হয়েছে। সেই স্বপ্নের পথে আমরা হাঁটছি। করোনার কারণে গত প্রায় দুই বছর অনেক গুণী জাতীয় সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বকে হারিয়েছি। এখন প্রতিনিয়ত হারাচ্ছি। তাদের শূন্যতা পূরণ হওয়ার নয়। এগুলো আমাদের ভীষণ ব্যথিত করে। আমরা অভিভাবকশূন্য হচ্ছি। যারা আমাদের বটগাছের ছায়ায় আগলে রাখতেন সেই মানুষগুলো একে একে চলে যাচ্ছেন- এটা আমাদের বড় কষ্টের জায়গা। এই প্রজন্ম বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সংস্কৃতি জানার জন্য উদগ্রীব। তাদের মধ্যে শেখার আগ্রহ লক্ষ্য করেছি। তারা সবকিছু জানছেন, ধারণ করছেন এবং তাদের কর্মকাণ্ডে সেটা প্রকাশ করছেন। এটা আশার কথা। আমাদের মতো ছোট দেশে এই একুশে শতকে তারুণ্যের অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। পৃথিবী অনেক দেশে তরুণরা এগিয়েছে। তারা এমন একটি জায়গায় পৌঁছেছে তা ঈর্ষণীয়।
আমাদের তরুণরা যথাযথ সহযোগিতা পাচ্ছে না। জাতীয়ভাবে কাজের জন্য যে সহযোগিতা দরকার হয়, সেই জায়গায় তারা পিছিয়ে আছে। এর পরও তরুণরা নতুন বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। আমাদের দায়িত্ব তরুণদের সঠিক পথে পরিচালিত করা, দেশীয় সংস্কৃতি তাদের অনুধাবন করানো।
আমাদের প্রজন্ম মফস্বল শহরে যৌথ পরিবারে বোধের মধ্যে বেড়ে উঠেছে। এখনকার প্রজন্ম সেই বোধের মধ্যে বেড়ে উঠেতে পারছে না। তারা ইট-কাঠের শহরে ফ্ল্যাটের মধ্যে বড় হচ্ছে। খেলার মাঠে যেতে পারছে না। নদীতে কিংবা পুকুরে সাঁতার কাটতে ভুলতে বসেছে। নৌকায় উঠতে পারছে না। এখনকার প্রজন্ম অনেক সার্প। আমরা কিন্তু ছোটবেলায় একটু সাদাসিদা ছিলাম। পৃথিবীর সঙ্গে এত যোগাযোগ ছিল না। চিন্তার পরিধি ছিল খুব ছোট। কিন্তু এ প্রজন্ম ক্যারিয়ারের শুরুতে পৃথিবীকে নানাভাবে দেখছে। তথ্যই শক্তি। তারা তথ্যের শক্তি নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। তারা স্মার্ট। এই স্মার্টনেসের সঙ্গে আমরা যদি তাদের বুদ্ধি-পরামর্শ দিতে পারি তাহলে তারা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম মানুষ হবে বলে আমি মনে করি।
এখনকার তরুণরা প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারছে না। তাদের রুটিন জীবন। বইয়ের ভারী বোঝা তাদের বইতে হয়। সে খেলাধুলা, গান শোনার সুযোগ, পরিবারের সঙ্গে সময় কাটানোর সুযোগ পায় না। কীভাবে তারা তৈরি হবে? সামাজিক দায়িত্ব পালন থেকেও তারা পিছিয়ে রয়েছে। সামাজিক দায়িত্ব পালনের জন্য যে সময় ও পরিবেশ দরকার তারা সেটা পায় না। এই মুখস্থ বিদ্যা পড়তে পড়তে তারা কাহিল। শুধু একাডেমির পড়া পড়লেই সুশিক্ষিত হওয়া যায় না। তাকে বাইরের জগৎ সম্পর্কেও জানতে হবে।
এত সীমাবদ্ধতার মধ্যেও নতুন প্রজন্ম তাদের মেধা ও তীক্ষষ্ট বুদ্ধি ও প্রযুক্তিগত জ্ঞান নিয়ে এগিয়ে চলছে। সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের তরুণদের মনন ও মেধা গঠনের ব্যাপারে এগিয়ে আসা উচিত। তরুণদের প্রতি শুধু একটিই অনুরোধ- তারা হৃদয়ে যেন বাংলাদেশকে ধারণ করে। সব সৃষ্টিশীলতার মধ্যে বাংলাদেশে থাকে। তাহলে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম উপকৃত হবে।
লেখক
নির্মাতা ও অভিনেতা

আরও পড়ুন

×