ঢাকা রবিবার, ০৬ জুলাই ২০২৫

দেয়ালে দেয়ালে অবিনাশী গান, সৃষ্টি সুখের উল্লাস

দেয়ালে দেয়ালে অবিনাশী গান, সৃষ্টি সুখের উল্লাস

কোলাজ

 দ্রোহী তারা

প্রকাশ: ৩১ ডিসেম্বর ২০২৪ | ০১:৪৭ | আপডেট: ৩১ ডিসেম্বর ২০২৪ | ১২:২৫

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের উত্তুঙ্গ পর্যায়ে প্রাণ সংশয়ের ভয়ে এক দল তরুণ রং-তুলি, পেইন্ট স্প্রে নিয়ে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সাহসের পরিচয় দিয়েছে। ঢাকার ব্যস্ততম সড়ক ও এলাকার ছোট গলিতে মুখ ফেরালে এখনও দেখা যায় কাঁচা-পাকা হাতের দেয়াল লিখন

২৭ জুলাই, শনিবার রাত। গুগল মিটে চলছে সংবাদ সম্মেলন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে দেশ তখন উত্তাল। ছাত্ররা সেদিন সব মামলা প্রত্যাহারের দাবি জানান। আর আটক শিক্ষার্থীদের মুক্তির দাবিতে প্রতিবাদী গ্রাফিতি ও দেয়াল লিখন কর্মসূচি ঘোষণা করেন।
রোববার থেকে হাতে স্প্রে বোতল, রং-তুলি নেন শিক্ষার্থীরা। রঙিন হয়ে উঠতে থাকে শহরের দেয়ালগুলো। পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে চলতে থাকে অঙ্কন। গ্রাফিতি ও স্লোগানে ভরা দেয়ালগুলো রূপ নেয় প্রতিবাদী চরিত্রে। আন্দোলনের পরিপূরক হয়ে উঠেছিল দেয়ালের রং ও অবয়ব।

‘লাশের সংখ্যা কত?’ ‘স্বাধীনতা তুমি কার? স্বৈরাচারের, নাকি জনতার?’ ‘সোনার বাংলায় শকুনের থাবা’, আবু সাঈদের মায়ের আহাজারি– ‘হামাক বেটাক মারলু কেনে?’ ‘ছাত্র কেন রক্তাক্ত?’ ‘দিনে নাটক– রাতে আটক’, দুই হাত ছড়িয়ে আবু সাঈদের ছবিতে লেখা– ‘বুকের ভেতর অনেক ঝড়/ বুক পেতেছি গুলি কর’, ‘রক্ত দেখলে বাড়ছে সাহস’, ‘মেধা না কোটা?’ ‘পুলিশি হত্যার বিচার চাই’, ‘একদিকে নাটক করে– অন্যদিকে গুম করে’, ‘সোনার বাংলা আজ মৃত্যুপুরী কেন’, ‘নাটক কম করো পিও’, ‘সম্পদের হিসাব পরে– লাশের হিসাব আগে’, ‘হারুনের ভাতের হোটেল’, ‘তোর কোটা তুই নে, আমার ভাইকে ফেরত দে’, ‘আসছে ফাগুন– আমরা হবো দ্বিগুণ’– এ রকম অজস্র প্রশ্ন, দাবি ও কথায় দেয়াল ভরিয়ে তুলেছিলেন শিক্ষার্থীরা। যেখানে পরে যোগ দেন শিক্ষক-অভিভাবকসহ সাধারণ জনতা।
আন্দোলনের সময় এই গ্রাফিতিগুলো লেখা হয়ে থাকলেও পরে মুছে ফেলা হয়েছিল বেশ কিছু স্থানে। এই মুছে ফেলাটাই আবার নতুন করে রং-তুলি নিয়ে নামার শক্তি জুগিয়েছিল বলে জানান বাড্ডার বাসিন্দা ইমন। তিনি বলেন, ‘আমি সাধারণত ছবি আঁকতে পছন্দ করি। কিন্তু আন্দোলনের সময় আমার এই তুলি যে অস্ত্র হয়ে উঠবে, তা বুঝিনি। ঘোষণা আসার পর নিজের টাকায় রং-তুলি কিনে স্লোগান লিখেছিলাম। কিন্তু পরদিন সেগুলো কে যেন মুছে ফেলেছিল। সেটা দেখে আবার স্প্রে পেইন্ট কিনে মুখে মাস্ক পরে বিভিন্ন স্থানে লিখতাম আমি ও আমার বন্ধুরা।’

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের উত্তুঙ্গ পর্যায়ে প্রাণ সংশয়ের ভয় নিয়ে একদল তরুণ রং, তুলি, পেইন্ট স্প্রে নিয়ে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সাহসের পরিচয় দিয়েছেন। ঢাকার ব্যস্ততম সড়ক ও 

এলাকার ছোট গলিতে মুখ ফেরালে এখনও দেখা যায় কাঁচাপাকা হাতের দেয়াল লিখন। এর মধ্যে মুগ্ধর পানির কেস হাতে ‘এই পানি লাগবে, পানি’, ‘দেশটা কারও বাপের না’, ‘ধর্ম যার যার, দেশ সবার’, ‘বিকল্প কে?’ ‘চির উন্নত মম শির’ স্লোগান ছিল উল্লেখযোগ্য।
যে গ্রাফিতি ও দেয়াল লিখন প্রতিবাদের অংশ ছিল, সেগুলো এখন নষ্ট হওয়ার পথে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে দৃকের মহাব্যবস্থাপক রেজাউর রহমান বলেন, দেশের ১১ জেলা থেকে সংগ্রহ করা দেয়াল লিখন নিয়ে ‘পেইন্ট দ্য স্কাই, মেইক ইট ইয়োরস’ সংকলন করা হয়েছে। নতুন প্রজন্মের চিন্তার জায়গাটা গ্রাফিতির মাধ্যমে কীভাবে প্রতিফলিত হয়েছে, তা দেখার চেষ্টা।
তবে দেয়ালগুলো সংরক্ষণের কথা জানান আলোকচিত্রী নাসির আলী মামুন। তিনি বলেন, ‘পশ্চিমা দেশ হলে হয়তো দেয়াল কেটে নিয়ে জাদুঘরে রাখত। অথবা সারাবছর দেয়ালের পেছনে খরচ করত, যেন ফাঙ্গাস না পড়ে, রং না ওঠে। আমাদের দেশে সরকার চাইলে তেমনটা করা সম্ভব।’
এ ছাড়া এসব গ্রাফিতি ও দেয়ালচিত্র নিয়ে লেখক ও সমাজকর্মী আবু জাফর জুবায়েরের সম্পাদনায় ‘গ্রাফিতি অব রেভল্যুশন: বাংলাদেশ ২০২৪– দ্য স্টোরি অব আ মাস আপরাইজিং থ্রু আর্ট’ নামে প্যারিস থেকে একটি বই প্রকাশিত হয়েছে।

মুক্তিযুদ্ধে কামরুল হাসানের আঁকা ‘এই জানোয়ারদের হত্যা করতে হবে’ কার্টুন এবং এরশাদবিরোধী আন্দোলনে নূর হোসেনের বুক-পিঠে ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক/ গণতন্ত্র মুক্তি পাক’ স্লোগান আজ ইতিহাস। চব্বিশের এই দেয়াল লিখন, গ্রাফিতি ও স্লোগানও ইতিহাস হওয়ার অপেক্ষায়।

 

আরও পড়ুন

×